Episode 4680 words0 views

ছায়াবাজির পুতুল : চতুর্থ পর্ব

অমাবস্যার আগের রাত। কলকাতার আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। রাত যখন গভীর, ভবতোষ একাই বেরিয়ে পড়লেন তাঁর বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে। তাঁর গন্তব্য—কেওড়াতলা মহাশ্মশান। ‘ছায়া-দর্পণ’ শোধনের চূড়ান্ত পর্বটি সেখানেই সারতে হবে। পুঁথির নির্দেশ কঠোর—জ্বলন্ত চিতার পাশে বসে, প্রেতভূমির শক্তিকে সাক্ষী রেখে এই কাজ করতে হয়। শ্মশানের পরিবেশ ছিল ভয়ঙ্কর। বৃষ্টির জলে চিতার আগুন নিভে গিয়ে ধোঁয়া উঠছে, বাতাসে পোড়া মাংসের তীব্র গন্ধ। দূরে শেয়ালের ডাক আর মাঝে মাঝে কোনো ডোমের কর্কশ গলার আওয়াজ নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিচ্ছিল। ভবতোষ নির্ভীক পায়ে এগিয়ে চললেন। তিনি এমন পরিবেশে অভ্যস্ত। একটি সদ্য জ্বলে ওঠা চিতার থেকে নিরাপদ দূরত্বে তিনি তাঁর আসন পাতলেন। আসনটি ছিল ব্যাঘ্রচর্মের। সামনে রাখলেন অষ্টধাতুর দর্পণটি। তারপর চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসলেন। মন্ত্র জপ শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি একা নন। শ্মশানের অতৃপ্ত আত্মারা, যারা মুক্তি পায়নি, তারা তাঁর সাধনার শক্তি অনুভব করে আকৃষ্ট হচ্ছে। তাঁর চারপাশে এক অদৃশ্য ভিড় জমে উঠল। তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন ফিসফিসানি, কান্নার শব্দ, আর চাপা দীর্ঘশ্বাস। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল নানা ভয়ঙ্কর দৃশ্য—দুর্ঘটনায় মৃত মানুষের বীভৎস মুখ, অপঘাতে মৃত্যুর যন্ত্রণা। এ সবই ছিল তাঁর মনঃসংযোগ ভাঙার চেষ্টা। কিন্তু ভবতোষ ছিলেন পর্বতের মতো অটল। তাঁর গুরু শিখিয়েছিলেন, “বাইরের জগৎটা মায়া, ভেতরের জগৎটাই সত্যি। নিজের মনকে যে জয় করতে পারে, ত্রিভুবনে তাকে ভয় দেখানোর মতো শক্তি কারও নেই।” তিনি তাঁর সমস্ত চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করলেন দর্পণটির উপর। ‘মহাকালী’র বীজমন্ত্র জপ করতে করতে তিনি তাঁর প্রাণশক্তিকে চালিত করতে লাগলেন সেই ধাতব চাকতির গভীরে। একসময় দর্পণটি ঈষৎ কাঁপতে শুরু করল এবং তার বুক থেকে এক শীতল, নীল আভা বিচ্ছুরিত হতে লাগল। চারপাশের অতৃপ্ত আত্মারা সেই আলোয় ছিটকে দূরে সরে গেল। ভবতোষ বুঝলেন, তাঁর কাজ সফল হয়েছে। দর্পণটি এখন জাগ্রত। তিনি সাবধানে সেটিকে একটি কালো রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে নিলেন। শরীরে ক্লান্তি, কিন্তু মনে এক কঠিন সংকল্প। অমাবস্যার সন্ধ্যায় ভবতোষ যখন তাঁর পূজার ঘর থেকে বেরোলেন, তখন তাঁর মুখ থমথমে। শরৎ আগেই এসে অপেক্ষা করছিল। তার মুখ শুকিয়ে আমসি। সে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “পারলাম না, ভবতোষ। অনাদিবাবুকে কিছুতেই আটকাতে পারলাম না। ঘরের দরজা ভেঙে তিনি বেরিয়ে গেছেন। তাঁর চোখ দুটো টকটকে লাল, মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। শুধু বলছেন, ‘যেতে হবে… ওস্তাদ ডাকছে…’। আরও কয়েকজনকেও তাদের বাড়ির লোক ধরে রাখতে পারেনি। মনে হচ্ছে যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওই নাটমন্দিরের দিকে।” ভবতোষ শান্ত স্বরে বললেন, “যা হওয়ার, তা হবেই, শরৎ। ওদের ছায়া এখন পুরোপুরি মনোহরের নিয়ন্ত্রণে। আজ সে ওই ছায়াগুলোকে ব্যবহার করেই তার চূড়ান্ত চাল চালবে। কিন্তু আমরাও প্রস্তুত। তুমি বাইরে অপেক্ষা করবে। কোনোমতেই ভিতরে ঢুকবে না। যদি সকালের আলো ফোটার আগে আমি না ফিরি, তবে পুলিশে খবর দেবে।” শরৎ ভয়ে শিউরে উঠল, কিন্তু ভবতোষের আদেশের বাইরে যাওয়ার সাহস তার হলো না। ভবতোষ যখন নাটমন্দিরের সামনে পৌঁছলেন, তখন চারপাশ নিঃশব্দ। আজ আর কোনো দর্শক নেই, শুধু সেই কয়েকজন—অনাদিবাবু এবং আরও জনা চারেক—যারা সম্পূর্ণরূপে মনোহরের বশীভূত। তারা জীবন্ত মূর্তির মতো চাতালের নীচে বসে আছে। তাদের চোখ খোলা, কিন্তু তাতে কোনো দৃষ্টি নেই। মঞ্চের উপরে মনোহর ওস্তাদ বসে আছে। তার সামনে সেই কালো পাথরটা আজ যেন আরও কালো, আরও জীবন্ত। আর তার পাশে, একটি সাদা চাদরে ঢাকা রয়েছে একটি মানব-আকৃতির অবয়ব। সেটি যে তার মৃত কন্যা মায়ার দেহ, তা বুঝতে ভবতোষের অসুবিধা হলো না। ভবতোষকে দেখেই মনোহরের চোখে আগুন জ্বলে উঠল। সে কর্কশ স্বরে বলল, “এসেছ, তান্ত্রিক? আমি জানতাম তুমি আসবে। আমার সাধনায় বাধা দেওয়ার স্পর্ধা তোমার!” ভবতোষ শান্তভাবে বললেন, “মনোহর, তুমি যা করতে চলেছ, তা সাধনা নয়, এ এক ভয়ঙ্কর পাপ। তুমি তোমার মেয়ের আত্মাকে শান্তি দিচ্ছ না, বরং এক অতৃপ্ত প্রেতকে জন্ম দিতে চলেছ। এখনও সময় আছে, ফিরে এসো।” মনোহর বিকটভাবে হেসে উঠল। “ফিরে আসার পথ আমি পাঁচ বছর আগেই বন্ধ করে দিয়েছি। আজ রাতে আমার মায়া আমার কাছে ফিরে আসবে। আর তার জন্য প্রয়োজন সবচেয়ে শক্তিশালী ছায়া। এই ছায়াগুলো আজ আমার মেয়ের নতুন শরীরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে।” এই বলে সে তার সারেঙ্গিতে ছড়ি টানল। কিন্তু আজ সেই সুর করুণ নয়, সে এক তীব্র, উন্মত্ত আর্তি। সেই সুরের সাথে সাথে নীচে বসে থাকা মানুষগুলোর শরীর থেকে তাদের ছায়াগুলো যেন ঘন কালো ধোঁয়ার মতো বেরিয়ে এসে মঞ্চের দিকে এগোতে লাগল। ছায়াগুলো আর जमिनीতে লেগে নেই, তারা যেন জীবন্ত সাপের মতো বাতাসে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাচ্ছে সেই চাদরে ঢাকা দেহটির দিকে। ভবতোষ বুঝলেন, আর দেরি করা চলবে না। তিনি তাঁর চাদরের ভিতর থেকে সেই কালো রেশমি কাপড়ে জড়ানো বস্তুটি বের করলেন। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion