অপূর্বর জীবনটা ছিল এক নিখুঁত জ্যামিতিক নকশা, যেখানে প্রতিটি রেখা ছিল সুনির্দিষ্ট, প্রতিটি কোণ ছিল পরিমাপকৃত। সকালে অফিসের কংক্রিটের খাঁচা, দুপুরে ক্যান্টিনের একঘেয়ে খাবারের গন্ধ, বিকেলে জিমের ঘর্মাক্ত শরীরচর্চা আর রাতে বইয়ের পাতায় অথবা সিনেমার পর্দায় ডুব। কলকাতার এই তীব্র গতিময় জীবনে সে যেন এক বিচ্ছিন্ন গ্রহ, যেখানে সম্পর্ক বা প্রেম ছিল তার কাছে এক অপ্রয়োজনীয় জটিলতা, এক অযৌক্তিক বিচ্যুতি। তার কাছে জীবন মানেই হিসেব আর যুক্তি, আবেগ নয়। কিন্তু সেই নিখুঁত হিসেব একদিন এলোমেলো হয়ে গেল এক অচেনা, অথচ তীব্র চেনা সুরের টানে।
সেদিন ছিল এক মেঘলা বিকেল, আকাশ থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। কফি শপের কাঁচের দেওয়ালে বৃষ্টির ফোঁটা লেগে এক মায়াবী আভা তৈরি হয়েছিল। ভেতরের উষ্ণ আলো আর বাইরের ধূসর আবহাওয়া মিলে এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। অপূর্ব তার প্রিয় কফি শপের কোণে বসে ল্যাপটপে কোডিং করছিল, তার মনোযোগ ছিল কোডের জটিল বিন্যাসে, যেন সে তার নিজস্ব জগতে ডুবে আছে, বাইরের কোলাহল তাকে স্পর্শ করতে পারছিল না। হঠাৎই কানে ভেসে এলো এক মিষ্টি, অথচ গভীর বিষণ্ণ সুর। সেদিকে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেল। একটি মেয়ে, সম্ভবত তার থেকে বছর দুয়েক ছোট, ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণে বসে গিটার বাজাচ্ছে আর গুনগুন করে গাইছে। তার পরনে ছিল একটি সাধারণ নীল সালোয়ার-কামিজ, খোলা চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু তার চোখ দুটো, সে যেন এক গভীর রহস্যের আধার, এক অদেখা সমুদ্রের মতো, যার গভীরে কি লুকিয়ে আছে তা বোঝা অসম্ভব। অপূর্ব জীবনে এত সুন্দর, এত গভীর চোখ দেখেনি। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল, যেন তার সমস্ত যুক্তি, সমস্ত হিসেব এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তার মনে হল, এই সুর শুধু তার কানে নয়, তার আত্মার গভীরেও এক অজানা অনুরণন সৃষ্টি করছে, এক অদেখা টান তাকে আকর্ষণ করছে, যা তাকে তার ছকবাঁধা জীবন থেকে টেনে বের করে আনছিল।
গান শেষ হতেই মেয়েটি গিটার নামিয়ে রাখল, তার হাতে গিটারের তারগুলো যেন তখনও কাঁপছিল, সুরের রেশ তখনও বাতাসে ভাসছিল। অপূর্ব নিজেকে সামলে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। তার প্রতিটি পদক্ষেপে এক অদ্ভুত টান অনুভব করছিল, যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, এক অজানা গন্তব্যের দিকে। “আপনার গানটা খুব ভালো লাগলো,” সে বলল, তার গলায় সামান্য জড়তা, যেন শব্দগুলো তার নিজের নয়, অন্য কেউ তাকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে।
মেয়েটি হাসল। সে হাসি যেন এক ঝলক রোদ্দুর, যা মেঘলা আকাশকে মুহূর্তে আলোকিত করে দিল। তার হাসিতে এক স্নিগ্ধতা ছিল, কিন্তু তার চোখের গভীরে অপূর্ব এক ক্ষণিকের জন্য এক অদেখা ভয়ের ছায়া দেখতে পেল, যা বিদ্যুতের ঝলকের মতো মিলিয়ে গেল, যেন সে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। “ধন্যবাদ। আমি রাধিকা।”
“আমি অপূর্ব।”
সেই শুরু। এরপর থেকে প্রতিদিন বিকেলে অপূর্ব ওই কফি শপে যেত, শুধু রাধিকার গান শোনার জন্য। রাধিকা একজন ফ্রিল্যান্স মিউজিশিয়ান ছিল। সে বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানে গান গাইত, আর অবসর সময়ে এই কফি শপে বসে নিজের সুর তৈরি করত। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গভীর হতে শুরু করল। অপূর্ব দেখল, রাধিকা শুধু সুন্দরী নয়, তার মনটাও খুব সরল আর পবিত্র। সে যেন এক খোলা বই, যার প্রতিটি পাতা ভালোবাসায় ভরা। কিন্তু মাঝে মাঝে, যখন সে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকত, অপূর্বর মনে হত, রাধিকার চোখে সেই অদেখা ভয়ের ছায়া আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেন সে কোনো অদৃশ্য বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে, যা তাকে নিঃশব্দে গ্রাস করছে। তার গিটার কেসের এক কোণে সে একবার একটি অদ্ভুত, প্রায় অস্পষ্ট প্রতীক দেখেছিল, যা একটি ভাঙা তারার মতো দেখতে ছিল, যার কেন্দ্রে একটি চোখ আঁকা, যা তার মনে এক অকারণ কৌতূহল জাগিয়েছিল। কফি শপের ভিড়ের মধ্যেও অপূর্ব মাঝে মাঝে অনুভব করত, যেন কেউ তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এক অদৃশ্য নজর তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। একবার সে কাঁচের দেওয়ালে তার নিজের প্রতিচ্ছবিতে এক ক্ষণিকের জন্য এক অচেনা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল, যা মুহূর্তে মিলিয়ে গেল, যেন তার চোখের ভুল। কিন্তু তার মন মানছিল না।
রাধিকাও অপূর্বকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল। অপূর্ব তার ছকবাঁধা জীবনের বাইরে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। তার যুক্তিপূর্ণ কথাগুলো রাধিকার শিল্পী মনকে এক নতুন চিন্তার খোরাক দিত। তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে প্রেমের দিকে মোড় নিল। কফি শপের কোণটা তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রইল, কিন্তু সেই সাক্ষীর আড়ালে এক অজানা বিপদ ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল, যার পূর্বাভাস কেবল অপূর্বর অবচেতন মনই পাচ্ছিল, যেন এক অদৃশ্য ঘড়ি টিক টিক করে চলছিল।
একদিন রাধিকা অপূর্বর হাত ধরে বলল, “অপূর্ব, তুমি আমার জীবনে আসার পর থেকে সব কিছু যেন বদলে গেছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি।” তার চোখে জল চিকচিক করছিল, কিন্তু সেই জলের গভীরে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল, এক গোপন ইতিহাস যা সে বলতে পারছিল না।
অপূর্বর বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠল। সে রাধিকাকে গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরল। “আমিও তোমাকে ভালোবাসি, রাধিকা। খুব ভালোবাসি।”
তাদের প্রেম ছিল সহজ, সুন্দর। কিন্তু অপূর্বর যুক্তিবাদী মন মাঝে মাঝে একটা তীব্র অস্বস্তি অনুভব করত। রাধিকা তার অতীত নিয়ে খুব একটা কথা বলত না। যখনই অপূর্ব তার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করত, রাধিকা কেমন যেন চুপ হয়ে যেত, তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যেত, যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তাকে ঘিরে ফেলত। বলত, “আমার পরিবারে আমি একা। বাবা-মা নেই।” এর বেশি কিছু সে বলতে চাইত না, তার চোখ দুটোয় এক গভীর যন্ত্রণা ফুটে উঠত, যা অপূর্বর মনে এক তীব্র কৌতূহল জাগিয়ে তুলত। অপূর্ব ভাবত, হয়তো সে দুঃখ পেতে চায় না, তাই এড়িয়ে যায়। সে আর জোর করত না। কিন্তু সেই অস্পষ্ট ভয়ের ছায়া, সেই অদ্ভুত প্রতীক, আর রাধিকার নীরবতা তার মনে এক অদৃশ্য কাঁটার মতো বিঁধে থাকত, যা তাকে এক অজানা আশঙ্কায় আচ্ছন্ন করে রাখত। তার মনে হত, রাধিকার প্রতিটি হাসির পেছনে এক গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে, যা তাকে ক্রমশ গ্রাস করছিল।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion