তাদের সম্পর্ক যখন আরও গভীর হচ্ছে, ঠিক তখনই অদ্ভুত, শীতল ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করল, যা নিছকই কাকতালীয় মনে হলেও অপূর্বর মনে এক গভীর সন্দেহ জাগিয়ে তুলল। প্রথমে ছোটখাটো ব্যাপার। অপূর্ব দেখল, তার অফিসের ডেস্কে কিছু ফাইল এলোমেলো হয়ে আছে, যেন কেউ তার অনুপস্থিতিতে ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, অথচ সে নিশ্চিত ছিল যে ফাইলগুলো গুছিয়ে রেখেছিল। ফাইলগুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ফাইল, যার নাম ছিল ‘প্রজেক্ট জিরো’, বারবার তার জায়গা থেকে সরে যাচ্ছিল। তার গাড়ির চাকার হাওয়া কমে যেত বারবার, যদিও সে আগের দিনই চেক করেছিল, এবং টায়ারে কোনো ছিদ্র ছিল না। একবার হাইওয়েতে তার গাড়ির ব্রেক হঠাৎ করে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল, অল্পের জন্য সে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল। একদিন তার ল্যাপটপে একটি অদ্ভুত, এনক্রিপ্টেড ফাইল পেল, যার উৎস সে খুঁজে পেল না, এবং ফাইলটি খোলার কোনো উপায় ছিল না। ফাইলটির নাম ছিল ‘লুমিনা_প্রজেক্ট.এনসিআর’, যা অপূর্বর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল, কিন্তু তার মনে এক অদ্ভুত অনুরণন সৃষ্টি করছিল। এসব ঘটনাকে সে প্রথমে নিছকই কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু মনের গভীরে এক অজানা, শীতল ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন এক অদৃশ্য জালে আটকা পড়ছে, যা ক্রমশ শক্ত হচ্ছে, এবং তার জীবন আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই।
একদিন রাতে অপূর্ব রাধিকাকে নিয়ে লং ড্রাইভে বেরিয়েছিল। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, ফাঁকা রাস্তায় তাদের গাড়ি চলছিল, চাঁদের আলোয় রাস্তা চিকচিক করছিল। হঠাৎই অপূর্ব দেখল, তাদের গাড়ির পেছনে একটি কালো সেডান গাড়ি অদ্ভুতভাবে তাদের অনুসরণ করছে। প্রথমে সে পাত্তা দিল না, কিন্তু যখনই সে গতি বাড়াল, পেছনের গাড়িটিও গতি বাড়াল, যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। অপূর্ব গতি কমালে, সেটিও গতি কমিয়ে দিল। গাড়ির কাঁচগুলো ছিল কালো, ভেতরে কে আছে তা বোঝার উপায় ছিল না, কিন্তু তাদের উপস্থিতি ছিল এক হিমশীতল হুমকির মতো, যা তাদের শ্বাসরোধ করে দিচ্ছিল। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় অপূর্ব একবার গাড়ির পেছনে সেই ভাঙা তারার মতো প্রতীকটি দেখতে পেল, যা তার মনে এক তীব্র ভয় জাগিয়ে তুলল। প্রতীকটি যেন অন্ধকারে জ্বলছিল।
অপূর্বর বুকটা ধুকপুক করে উঠল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। “রাধিকা, মনে হচ্ছে কেউ আমাদের ফলো করছে। খুব কাছ থেকে। আর… আমি তাদের গাড়িতে সেই প্রতীকটা দেখেছি। সেই ভাঙা তারার প্রতীক।”
রাধিকা ভয় পেয়ে অপূর্বর হাত চেপে ধরল। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখ দুটো ভয়ে বিস্ফারিত। তার শরীর কাঁপছিল। “অপূর্ব, তুমি ঠিক দেখেছো? এটা কি সেই প্রতীক? ওরা কি আমাকে খুঁজে পেয়েছে?” তার কণ্ঠস্বর এতটাই ক্ষীণ ছিল যে, অপূর্ব প্রায় শুনতে পেল না, যেন সে তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে কথা বলছে। তার চোখে সেই অদেখা ভয়ের ছায়া আরও স্পষ্ট হল, যেন সে এই পরিস্থিতির সাথে পরিচিত, যেন এই প্রতীক তার জীবনের এক অভিশাপ, এক মরণফাঁদ।
অপূর্ব দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে একটি সরু, অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়ল। পেছনের গাড়িটি গলিতে ঢুকতে পারল না, তার হেডলাইটের আলো গলির মুখে আটকে গেল। অপূর্ব কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিল, ইঞ্জিনের শব্দ বন্ধ হতেই চারদিকে এক পিনপতন নীরবতা নেমে এল, যা তাদের হৃদস্পন্দনকে আরও দ্রুত করে তুলল। সে দেখল, কালো সেডানটি মেইন রোড ধরে সোজা চলে গেল। কিন্তু অপূর্বর মন মানছিল না। সে জানত, এটা নিছকই ভুল দেখা নয়, এটা ছিল এক স্পষ্ট বার্তা, এক নীরব হুমকি, যা তাদের জীবনকে বিপদে ফেলছিল।
পরের দিন থেকে ঘটনাগুলো আরও স্পষ্ট হতে লাগল, আরও ব্যক্তিগত হয়ে উঠল, যেন কেউ তাদের জীবনকে পুতুলের মতো নিয়ন্ত্রণ করছে। অপূর্ব দেখল, তার অ্যাপার্টমেন্টের নিচে একজন লোক প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কোনো অদৃশ্য প্রহরী। লোকটির মুখ ঢাকা থাকত একটি স্কার্ফ দিয়ে, কিন্তু তার চোখ দুটো ছিল খুব তীক্ষ্ণ, শিকারীর মতো শীতল, যেন তারা অন্ধকারে জ্বলছিল। অপূর্ব লিফটে উঠলে লোকটিও উঠত, কিন্তু অন্য ফ্লোরে নেমে যেত, যেন তার উদ্দেশ্য শুধু অপূর্বকে অনুসরণ করা, তাকে এক অদৃশ্য জালে আটকে রাখা। অপূর্ব যখন রাধিকার সাথে থাকত, তখন লোকটিকে দেখত না। কিন্তু যখনই সে একা থাকত, লোকটির উপস্থিতি টের পেত, যেন এক অদৃশ্য ছায়া তাকে অনুসরণ করছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে। একদিন সে তার অ্যাপার্টমেন্টের দরজার নিচে একটি ছোট, ভাঁজ করা কাগজ পেল। তাতে শুধু একটি ছবি আঁকা ছিল – সেই অদ্ভুত প্রতীক, যা সে রাধিকার গিটার কেসে দেখেছিল। প্রতীকটি যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল, এক অশুভ ইঙ্গিত নিয়ে, যেন তাকে সতর্ক করছিল, বা উপহাস করছিল। কাগজের পেছনে অস্পষ্টভাবে লেখা ছিল, “সময় ফুরিয়ে আসছে।”
অপূর্ব রাধিকাকে এই সব কথা বলতে চাইল। কিন্তু সে ভাবল, রাধিকা ভয় পাবে। তার সরল মন এই সব রহস্যের জন্য প্রস্তুত নয়। সে সিদ্ধান্ত নিল, নিজেই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবে। তার যুক্তি তাকে বলছিল, এই সব ঘটনার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, এবং সেই কারণ তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
একদিন রাতে অপূর্ব অফিস থেকে ফিরছিল। তার অ্যাপার্টমেন্টের কাছে আসতেই সে দেখল, সেই লোকটি তার ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখে এক শীতল দৃষ্টি। তার হাতে একটি ছোট চকচকে বস্তু ছিল, যা অন্ধকারেও জ্বলছিল। অপূর্ব দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল, তার মনে এক অদম্য সাহস, কিন্তু তার বুকের ভেতরটা কাঁপছিল। “কে আপনি? কেন আমার পিছু নিচ্ছেন? কী চান আপনি?”
লোকটি অপূর্বর দিকে তাকাল, তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি ছিল না, যেন সে পাথরের তৈরি। তার চোখ দুটো ছিল পাথরের মতো শীতল, নিষ্পাপ, কিন্তু তার গভীরে এক অশুভ চতুরতা লুকিয়ে ছিল। তার হাতে থাকা চকচকে বস্তুটি ছিল একটি ছোট লেজার পয়েন্টার, যা সে অপূর্বর বুকের দিকে তাক করে রেখেছিল। তারপর সে দ্রুত হেঁটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, যেন সে কোনো ছায়া, যা আলোর স্পর্শে অদৃশ্য হয়ে যায়। অপূর্ব তাকে ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তার মনে হল, লোকটি যেন এক অদৃশ্য ছায়া, যা তার জীবনকে গ্রাস করতে চাইছে, তাকে এক অজানা বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার শেষ কোথায়, তা সে জানে না।
অপূর্বর মনে হল, এই সব ঘটনার সাথে রাধিকার কোনো সম্পর্ক আছে। রাধিকার অতীত নিয়ে তার নীরবতা, সেই রহস্যময় চোখ, আর এখন এই প্রতীক – সব মিলিয়ে এক জটিল ধাঁধা তৈরি হচ্ছিল। সে রাধিকাকে সন্দেহ করতে শুরু করল না, বরং তার জন্য আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারছিল, রাধিকা হয়তো কোনো ভয়ঙ্কর বিপদে আছে, আর সেই বিপদ তাকেও অজান্তেই জড়িয়ে ফেলছে। তার নিজের ছকবাঁধা জীবন এখন এক অজানা থ্রিলারের অংশ হয়ে উঠেছে, যার শেষ কোথায়, তা সে জানে না।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion