Episode 51116 words2 views

পঞ্চম অধ্যায়: মরণফাঁদ

অপূর্ব এবং রাধিকা সরকারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন সেই রহস্যময় ‘অন্ধকার ছায়া’ সংস্থার নজরে ছিল। তাদের ফোন ট্যাপ করা হচ্ছিল, তাদের গতিবিধি অনুসরণ করা হচ্ছিল। তাদের পরিচিত মহলে কিছু অদ্ভুত মুখ দেখা যাচ্ছিল, যারা তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, যেন তারা তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছিল। শহরের প্রতিটি কোণে যেন তাদের জন্য এক অদৃশ্য ফাঁদ পাতা ছিল, যা ক্রমশ শক্ত হচ্ছিল। অপূর্বর মনে হল, যেন বাতাসও তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, প্রতিটি শব্দ যেন তাদের অনুসরণ করছে। একদিন রাতে তারা একটি গোপন জায়গায় যাওয়ার জন্য ট্যাক্সিতে উঠল। ট্যাক্সিটি কিছুদূর যাওয়ার পরই একটি নির্জন, অন্ধকার রাস্তায় ঢুকে পড়ল, যেখানে কোনো আলো ছিল না, শুধু গাছের ছায়া আর নীরবতা। ট্যাক্সির ভেতরে এক অদ্ভুত রাসায়নিক গন্ধ ভেসে আসছিল, যা অপূর্বর মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলল। অপূর্ব দেখল, ট্যাক্সি ড্রাইভারের চোখে এক অদ্ভুত চতুরতা, যা তার মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলল। তার হাতটা রাধিকার হাত চেপে ধরল। “ড্রাইভার, আপনি কোন দিকে যাচ্ছেন? এটা তো আমাদের রাস্তা নয়,” অপূর্ব জিজ্ঞেস করল, তার গলায় চাপা উত্তেজনা, তার চোখ ড্রাইভারের দিকে স্থির। ড্রাইভার হাসল, তার হাসিটা ছিল শীতল এবং যান্ত্রিক, যেন সে কোনো রোবট। “যেদিকে যাওয়ার কথা, সেদিকেই।” তার কণ্ঠস্বরে কোনো আবেগ ছিল না, যেন সে এক পুতুল, যার প্রতিটি নড়াচড়া পূর্বনির্ধারিত। ঠিক তখনই, পেছনের দিক থেকে একটি কালো সেডান তাদের ট্যাক্সিকে ঘিরে ফেলল। সামনে থেকেও আরেকটি গাড়ি এসে তাদের পথ আটকে দিল। তারা যেন এক অদৃশ্য জালের মধ্যে আটকা পড়েছিল, পালানোর কোনো পথ ছিল না। সেই রহস্যময় লোকটি ট্যাক্সির জানালা দিয়ে উঁকি দিল। তার মুখে এক নিষ্ঠুর হাসি, যা অপূর্বর মনে এক তীব্র ঘৃণা জাগিয়ে তুলল। “অবশেষে খুঁজে পেলাম, রঞ্জনা। এবং তার নতুন সঙ্গী। পেনড্রাইভটা দাও, আর তোমাদের জীবন বাঁচাও। আর কোনো চালাকি নয়।” অপূর্ব রাধিকাকে জড়িয়ে ধরল, তার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। “রাধিকা, ভয় পেও না। আমরা একসাথে আছি। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।” লোকটি ট্যাক্সির দরজা খুলে দিল। তার হাতে একটি চকচকে বন্দুক, যা চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছিল। তার পেছনে আরও দুজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের হাতেও অস্ত্র, তাদের চোখগুলো ছিল হিংস্র, যেন তারা ক্ষুধার্ত নেকড়ে। “পেনড্রাইভটা দাও। আর কোনো চালাকি নয়। তোমাদের পালানোর কোনো পথ নেই। এটা তোমাদের শেষ রাত।” অপূর্ব জানত, তাদের কাছে আর কোনো উপায় নেই, কিন্তু সে হাল ছাড়তে রাজি ছিল না। সে পেনড্রাইভটি লোকটির দিকে ছুঁড়ে দিল, যেন সে আত্মসমর্পণ করছে। লোকটি পেনড্রাইভটি হাতে নিতেই অপূর্ব রাধিকাকে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে লাফিয়ে পড়ল, তাদের শরীর রাস্তায় আছড়ে পড়ল, ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। তারা একটি অন্ধকার, আবর্জনায় ভরা গলির দিকে দৌড়াতে শুরু করল, তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে ছিল এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এক নতুন জীবনের জন্য। পেছন থেকে গুলির শব্দ ভেসে এল, দেয়ালের গায়ে ছিটকে পড়ল পাথরের টুকরো। অপূর্ব রাধিকাকে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিল, তাদের পায়ের শব্দ অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, যেন মৃত্যুর পদধ্বনি। তাদের পেছনে সেই লোকগুলো তাড়া করছিল, তাদের টর্চের আলো অন্ধকারে ঘুরছিল, যেন শিকারী তার শিকার খুঁজছে। অপূর্ব দেখল, গলিটি একটি পুরনো, ভাঙা বাড়ির দিকে চলে গেছে। সে রাধিকাকে নিয়ে সেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল, যেন এক নতুন ফাঁদে প্রবেশ করছে। বাড়িটি ছিল একটি পুরনো, পরিত্যক্ত গোডাউন। ভেতরে অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, বাতাসে পচা গন্ধ আর ইঁদুরের আনাগোনা। প্রতিটি কোণে এক অজানা আতঙ্ক লুকিয়ে ছিল। অপূর্ব দেখল, গোডাউনের এক কোণে কিছু ভাঙা বাক্স, লোহার রড আর পুরনো যন্ত্রাংশ পড়ে আছে। সে রাধিকাকে নিয়ে একটি বিশাল ভাঙা বাক্সের পেছনে লুকিয়ে পড়ল, তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছিল, তাদের হৃদস্পন্দন কানে বাজছিল। লোকগুলো গোডাউনের ভেতরে ঢুকল। তাদের টর্চের আলো অন্ধকারে ঘুরছিল, প্রতিটি কোণ তন্নতন্ন করে খুঁজছিল। তাদের পায়ের শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল, যেন মৃত্যুর পদধ্বনি। অপূর্ব রাধিকাকে ফিসফিস করে বলল, “আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে। ওরা সব পথ চেনে। ওরা আমাদের শ্বাসরোধ করে দেবে। এই গোডাউনে একটা গোপন সুড়ঙ্গ থাকতে পারে, আমার মনে আছে বাবা একবার বলেছিলেন।” অপূর্ব দেখল, গোডাউনের এক কোণে একটি ছোট, মরিচা ধরা দরজা আছে। হয়তো সেটি দিয়ে বাইরে যাওয়া যাবে। কিন্তু দরজাটি তালাবদ্ধ ছিল, এবং তার পাশে একটি ছোট সেন্সর জ্বলছিল, যা তাদের উপস্থিতি জানান দেবে। অপূর্ব তার পকেট থেকে একটি ছোট তার বের করল, যা সে তার কোডিংয়ের কাজে ব্যবহার করত, এবং সেন্সরটি নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করল। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু তার মনোযোগ ছিল অবিচল। লোকগুলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। তাদের পায়ের শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল, তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল। অপূর্ব একটি ভারী লোহার রড হাতে নিল, তার চোখে এক দৃঢ় সংকল্প। “রাধিকা, তুমি প্রস্তুত থেকো। যখনই সুযোগ পাবে, দৌড়াবে। পিছন ফিরে তাকাবে না। সুড়ঙ্গটা খুঁজে বের করতে হবে।” লোকগুলো তাদের কাছাকাছি আসতেই অপূর্ব হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠল, রড দিয়ে সামনের লোকটির ওপর আক্রমণ করল। লোকটি অপ্রস্তুত ছিল, মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অপূর্ব অন্য লোকটির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকগুলো সংখ্যায় বেশি ছিল, এবং তারা প্রশিক্ষিত ছিল, তাদের প্রতিটি নড়াচড়ায় ছিল এক পেশাদারী দক্ষতা। অপূর্ব তাদের সাথে প্রাণপণে লড়াই করতে শুরু করল, তার প্রতিটি আঘাত ছিল প্রতিশোধের আগুন। রাধিকাও তাকে সাহায্য করছিল। সে ভাঙা বাক্সগুলো ছুঁড়ে লোকগুলোর মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দিচ্ছিল, তাদের ওপর ধুলোবালি ছিটিয়ে দিচ্ছিল, তাদের চোখে আঘাত করছিল। কিন্তু লোকগুলো সংখ্যায় বেশি ছিল, এবং তারা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছিল। অপূর্ব বুঝতে পারছিল, সে বেশি সময় টিকতে পারবে না, তার শক্তি কমে আসছিল। হঠাৎই তার চোখে পড়ল, গোডাউনের ছাদের একটি অংশ ভাঙা, সেখান দিয়ে বাইরে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটি অনেক উঁচুতে, এবং নিচে লাফ দিলে গুরুতর আঘাত লাগতে পারে। “রাধিকা, ছাদের দিকে! দ্রুত!” অপূর্ব চিৎকার করে বলল, একটি লোহার পাইপ দিয়ে এক লোককে ঠেকিয়ে রেখে, তার হাতে গভীর ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছিল। তারা দু’জনে মিলে ছাদের দিকে দৌড়াতে শুরু করল। লোকগুলো তাদের পেছন পেছন ছুটছিল, গুলি ছুঁড়ছিল, তাদের প্রতিটি গুলি যেন তাদের মৃত্যুর বার্তা দিচ্ছিল। অপূর্ব রাধিকাকে ধাক্কা দিয়ে ছাদের ভাঙা অংশ দিয়ে বাইরে বের করে দিল। সে নিজেও লাফিয়ে বাইরে চলে এল, তার হাতে একটি গভীর ক্ষত, তার শরীর ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছিল। তারা একটি নির্জন ছাদে এসে পড়ল, যেখানে কোনো আশ্রয় ছিল না। ছাদের এক পাশ দিয়ে একটি ছোট, সরু সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। তারা সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। লোকগুলোও ছাদে চলে এসেছিল, তাদের হিংস্র চিৎকার শোনা যাচ্ছিল, তাদের টর্চের আলো তাদের অনুসরণ করছিল, যেন তারা তাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাড়া করবে। “আমরা ধরা পড়ে গেছি,” রাধিকা ভয়ে কাঁপছিল, তার চোখে জল, তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ। অপূর্ব দেখল, সিঁড়িটি একটি সরু, অন্ধকার গলির দিকে চলে গেছে। গলির শেষ প্রান্তে একটি উজ্জ্বল আলো দেখা যাচ্ছিল, এবং সাইরেনের ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছিল, যা তাদের মনে এক নতুন আশা জাগিয়ে তুলল। অপূর্ব তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে রাধিকাকে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। “পুলিশ!” অপূর্ব চিৎকার করে উঠল, তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে, তার কণ্ঠস্বর অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। লোকগুলো পুলিশ স্টেশন দেখে থমকে গেল, তাদের চোখে এক তীব্র হতাশা ফুটে উঠল। তারা বুঝতে পারল, তাদের আর কিছু করার নেই, তাদের মিশন ব্যর্থ হয়েছে। তারা দ্রুত উল্টো দিকে ঘুরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, যেন তারা কোনো ছায়া, যা আলোর স্পর্শে অদৃশ্য হয়ে যায়। অপূর্ব এবং রাধিকা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সব কথা খুলে বলল। পুলিশ তাদের কথা বিশ্বাস করল, কারণ তাদের কাছে পেনড্রাইভ এবং রাধিকার বাবার ডায়েরি ছিল, যা তাদের গল্পের সত্যতা প্রমাণ করছিল। তারা পেনড্রাইভটি বাজেয়াপ্ত করল এবং রাধিকার বাবার গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে পারল। সরকার রাধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা করল এবং সেই আন্তর্জাতিক গুপ্তচর সংস্থা ‘অন্ধকার ছায়া’র বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করল।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion