১৯৮৫ সাল। শ্রীনগরের ডাল লেকের জল তখনও আয়নার মতো স্বচ্ছ, তার বুকে প্রতিফলিত হয় পীর পাঞ্জালের বরফাবৃত চূড়া আর হাউসবোটের রঙিন সারি। বসন্তের শেষ লগ্ন, গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা নিয়ে কাশ্মীরের উপত্যকা সেজে উঠেছে এক অপরূপ সাজে। টিউলিপের বাগানগুলো তখনও তাদের শেষ সৌন্দর্যটুকু ধরে রেখেছে, আর চিনার গাছের নতুন পাতাগুলো সবুজ আভা ছড়াচ্ছে বাতাসে।
কলকাতার সাংবাদিক অরিন্দম সেন, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী, এই সময়েই শ্রীনগরে এসে পৌঁছেছিলেন। পেশার চাপ আর শহরের কোলাহল থেকে দূরে, কয়েকটা দিন শান্তিতে কাটানোর উদ্দেশ্যেই তাঁর এই কাশ্মীর ভ্রমণ। ডাল লেকের এক কোণে, “শীতলছায়া” নামের একটি পুরোনো কিন্তু সুসজ্জিত হাউসবোটে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। হাউsbোটের মালিক, এক বয়স্ক কাশ্মীরি, আব্দুল চাচা, তার উষ্ণ আতিথেয়তায় অরিন্দম মুগ্ধ।
প্রথম কয়েকটা দিন স্বপ্নের মতো কাটছিল। সকালে হাউসবোটের বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অরিন্দম দেখতেন শিকারারা কীভাবে লেকের জলে আলস্যে ভেসে বেড়ায়, স্থানীয় বিক্রেতারা তাদের পণ্য নিয়ে আসে হাউসবোটের দরজায়। দুপুরে শিকারায় ভেসে লেকের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো, শালিমার বাগানে মুঘল স্থাপত্যের নীরব সৌন্দর্য উপভোগ করা, আর সন্ধ্যায় হাউসবোটের ছাদে বসে তারায় ভরা আকাশের নিচে আব্দুল চাচার মুখে কাশ্মীরের লোককথা শোনা – এই ছিল তাঁর রুটিন। সাংবাদিকতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর কৌতূহলী মন নিয়ে অরিন্দম এখানকার জীবনযাত্রা, মানুষের সরলতা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গভীরে ডুব দিচ্ছিলেন।
কিন্তু কাশ্মীরের এই শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনে যে এক ভয়ঙ্কর ঝড় লুকিয়ে ছিল, তা তিনি তখনও টের পাননি।
তৃতীয় দিনের সন্ধ্যা। অরিন্দম সবেমাত্র লেকের ধারে হাঁটাহাঁটি সেরে হাউসবোটে ফিরেছেন। আব্দুল চাচা তাঁর জন্য গরম কাহওয়া নিয়ে এলেন। “আজকাল লেকে কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা, সাহেব,” আব্দুল চাচা বললেন, তাঁর চোখে এক ধরণের উদ্বেগ। “কাল রাতে ‘জান্নাত’ হাউসবোটে কী যেন একটা গোলমাল হয়েছে। পুলিশ এসেছিল।”
অরিন্দম চমকে উঠলেন। ‘জান্নাত’ হাউসবোট তাঁর ‘শীতলছায়া’ থেকে কয়েকটা হাউসবোট পরেই। তিনি খেয়াল করেননি। “গোলমাল? কীসের গোলমাল, আব্দুল চাচা?”
“জানি না সাহেব। খুব সকালে পুলিশ এসেছিল। শুনেছি, কলকাতার এক বড় সাহেব নাকি মারা গেছেন। খুন না কী যেন।” আব্দুল চাচার কণ্ঠস্বরে চাপা ভয়।
অরিন্দমের সাংবাদিক মন সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হয়ে উঠল। খুন! কাশ্মীরের এই শান্ত উপত্যকায়? তাও কলকাতার একজন? তাঁর ছুটির মেজাজ এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। “কোন সাহেব, আব্দুল চাচা? নাম জানেন?”
“শুনেছি তাঁর নাম দেবব্রত রায়। খুব বড় ব্যবসায়ী ছিলেন নাকি। অনেক টাকা ছিল।”
দেবব্রত রায়! অরিন্দম এই নামটা শুনেই চমকে উঠলেন। দেবব্রত রায় কলকাতার একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর নাম বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনামে এসেছে – কখনো বড় শিল্পপতি হিসেবে, কখনো বা তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের কারণে। অরিন্দম নিজেও একবার তাঁর বিরুদ্ধে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মাঝপথে তা থেমে গিয়েছিল অজ্ঞাত কারণে। দেবব্রত রায় কাশ্মীরে কী করছিলেন? আর খুন?
অরিন্দম আর এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। কাহওয়ার কাপ রেখে তিনি দ্রুত হাউসবোট থেকে বেরিয়ে এলেন। আব্দুল চাচা তাঁকে বারণ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অরিন্দমের চোখে তিনি এক সাংবাদিকের অদম্য কৌতূহল দেখতে পেলেন।
‘জান্নাত’ হাউসবোটের দিকে যেতেই অরিন্দম দেখলেন, সেখানে তখনও পুলিশের আনাগোনা। সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ অফিসার হাউসবোটের ভেতরে ঢুকছেন এবং বেরোচ্ছেন। হাউসবোটের চারপাশে লেকের জলে কিছু শিকারায় কৌতূহলী মানুষ ভিড় জমিয়েছে। অরিন্দম ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন।
হাউসবোটের প্রবেশপথে একজন পুলিশ কনস্টেবল দাঁড়িয়েছিল। অরিন্দম নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন। কনস্টেবল প্রথমে ইতস্তত করলেও, অরিন্দমের দৃঢ়তা দেখে শেষ পর্যন্ত পথ ছেড়ে দিল।
ভেতরে ঢুকেই অরিন্দম এক হিমশীতল নীরবতার মুখোমুখি হলেন। হাউসবোটের বিলাসবহুল সাজসজ্জা যেন এই মুহূর্তে তার সমস্ত ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলেছে। ভেতরের আলো-আঁধারিতে একটি ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ। তিনি দেখলেন, একজন দীর্ঘদেহী পুলিশ অফিসার, সম্ভবত ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার, একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তাঁর পাশে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ কিছু ছবি তুলছেন।
অরিন্দম ধীরে ধীরে সেই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই তাঁর নাকে এক তীব্র ধাতব গন্ধ এসে লাগল – রক্তের গন্ধ। ঘরের মাঝখানে, একটি দামি কাশ্মীরি কার্পেটের ওপর, দেবব্রত রায়ের নিথর দেহ পড়ে আছে। তাঁর পরনে ছিল একটি সিল্কের পায়জামা-পাঞ্জাবি। গলার কাছে গভীর ক্ষতচিহ্ন, যা থেকে বোঝা যাচ্ছিল, ধারালো কিছু দিয়ে তাঁকে আঘাত করা হয়েছে। চোখ দুটো খোলা, তাতে এক ধরণের আতঙ্ক আর বিস্ময় তখনও লেগে আছে।
ইনস্পেক্টর অরিন্দমকে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। “আপনি কে?” তাঁর কণ্ঠে রুক্ষতা।
অরিন্দম নিজের পরিচয় দিলেন। “আমি অরিন্দম সেন, কলকাতা থেকে এসেছি। সাংবাদিক। দেবব্রত রায়কে আমি চিনতাম।”
ইনস্পেক্টর কিছুক্ষণ অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর নাম ইনস্পেক্টর রফিক আহমেদ। তাঁর চোখে বুদ্ধিমত্তা আর অভিজ্ঞতা স্পষ্ট। “এখানে আপনার কী কাজ? এটা একটা খুনের ঘটনাস্থল।”
“আমি শুধু জানতে চাইছিলাম কী ঘটেছে। দেবব্রত রায় একজন পরিচিত মুখ ছিলেন। তাঁর মৃত্যু শুধু কলকাতার নয়, গোটা দেশের কাছেই একটা খবর।” অরিন্দম শান্ত গলায় বললেন।
ইনস্পেক্টর রফিক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “এখনও কিছুই স্পষ্ট নয়, মিস্টার সেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এটা একটা ডাকাতির চেষ্টা, যা খুনে পর্যবসিত হয়েছে। ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো, কিছু জিনিসপত্র খোয়া গেছে।”
অরিন্দম ঘরের চারদিকে চোখ বোলালেন। সত্যিই, আলমারির দরজা খোলা, জিনিসপত্র ছড়ানো-ছিটানো। কিন্তু অরিন্দমের মন মানছিল না। দেবব্রত রায় একজন অত্যন্ত সতর্ক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মতো একজন মানুষ, যিনি সব সময় নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকতেন, কীভাবে এমন অরক্ষিত অবস্থায় খুন হতে পারেন? আর শুধু ডাকাতি? দেবব্রত রায়ের মতো একজন মানুষের কাছে তো আরও অনেক শত্রু থাকতে পারে।
“ঘর থেকে কী কী খোয়া গেছে, ইনস্পেক্টর?” অরিন্দম জানতে চাইলেন।
“প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, তাঁর মানিব্যাগ, হাতের ঘড়ি আর কিছু গয়না। তবে আমরা এখনও সব কিছু খতিয়ে দেখছি।”
অরিন্দম নিচু হয়ে দেবব্রত রায়ের দেহের দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ দুটো তখনও খোলা। অরিন্দমের মনে হলো, দেবব্রত রায় যেন কিছু বলতে চাইছেন। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল দেবব্রত রায়ের ডান হাতের তর্জনীর দিকে। আঙুলটি সামান্য বাঁকানো, যেন তিনি কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। আর সেই আঙুলের ডগায়, অরিন্দম একটি ছোট, প্রায় অদৃশ্য, সবুজ রঙের সুতোর টুকরো দেখতে পেলেন। খুব সূক্ষ্ম, সামান্যই দেখা যাচ্ছে।
ইনস্পেক্টর রফিক বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ কেউই বোধহয় এটা খেয়াল করেননি। অরিন্দম দ্রুত তাঁর পকেট থেকে একটি ছোট রুমাল বের করে অত্যন্ত সাবধানে সুতোর টুকরোটি তুলে নিলেন। এটা খুব ছোট, প্রায় নগণ্য, কিন্তু অরিন্দমের সাংবাদিক মন বলল, এই সামান্য সুতোর টুকরো হয়তো এই রহস্যের প্রথম সূত্র হতে পারে।
“আপনারা কি কোনো সন্দেহভাজনকে আটক করেছেন?” অরিন্দম ইনস্পেক্টরকে জিজ্ঞেস করলেন।
“না, এখনও নয়। তবে হাউসবোটের স্টাফদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আর লেকের আশেপাশে যারা ছিল, তাদেরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।”
অরিন্দম আর কিছু বললেন না। তিনি বুঝলেন, এখন পুলিশকে তাদের কাজ করতে দেওয়া উচিত। তিনি ‘জান্নাত’ হাউসবোট থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে তখন রাতের আঁধার আরও গভীর হয়েছে। লেকের জলে চাঁদনী রাতের মায়াবী আলো পড়েছে। কিন্তু অরিন্দমের মনে সেই মায়া আর ছিল না। তাঁর মনে তখন শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল – কে খুন করল দেবব্রত রায়কে? আর কেন?
তাঁর ছুটির মেজাজ সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে। তিনি জানতেন, এই রহস্যের গভীরে তাঁকে ডুব দিতেই হবে। এই সবুজ সুতোর টুকরো হয়তো সেই ডুব দেওয়ার প্রথম ধাপ।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion