Episode 21058 words0 views

দ্বিতীয় অধ্যায়: রহস্যের জাল

পরের দিন সকালে, শ্রীনগরের আকাশ মেঘলা ছিল। অরিন্দমের মনও যেন সেই মেঘে ঢাকা। তিনি আব্দুল চাচার কাছ থেকে জানতে পারলেন, দেবব্রত রায়ের দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে এবং পুলিশ হাউসবোট ‘জান্নাত’-কে সিল করে দিয়েছে। হাউসবোটের স্টাফদের, বিশেষ করে কেয়ারটেকার এবং রাঁধুনিকে, পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। অরিন্দম তাঁর নোটবুক আর পেন নিয়ে বসলেন। সাংবাদিকতার প্রথম নিয়ম – তথ্য সংগ্রহ। তিনি প্রথমেই দেবব্রত রায় সম্পর্কে তাঁর পুরোনো ফাইলগুলো ঘাঁটতে শুরু করলেন। দেবব্রত রায় ছিলেন একজন ইস্পাত ব্যবসায়ী। তাঁর সাম্রাজ্য শুধু ইস্পাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, রিয়েল এস্টেট, হোটেল এবং পর্যটন শিল্পেও তাঁর বিনিয়োগ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে শ্রমিক অসন্তোষ, পরিবেশ দূষণ এবং অবৈধ অর্থ লেনদেনের অভিযোগও ছিল। কিন্তু কোনো অভিযোগই শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। তাঁর প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে, অনেক সময় মনে হতো তিনি আইনের ঊর্ধ্বে। অরিন্দমের মনে প্রশ্ন জাগল, দেবব্রত রায় কাশ্মীরে কী করতে এসেছিলেন? শুধুমাত্র ছুটি কাটাতে? নাকি তাঁর এখানে কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থ ছিল? কাশ্মীরের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁর মতো একজন বিতর্কিত ব্যবসায়ীর উপস্থিতি কি কোনো গোপন উদ্দেশ্য বহন করছিল? তিনি মনে মনে একটি তালিকা তৈরি করলেন: ১. দেবব্রত রায়ের কাশ্মীরে আসার উদ্দেশ্য। ২. তাঁর সঙ্গে আর কে কে ছিল? ৩. হাউসবোটের স্টাফদের বক্তব্য। ৪. সবুজ সুতোর টুকরোর উৎস। ৫. সম্ভাব্য শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী। অরিন্দম ঠিক করলেন, ইনস্পেক্টর রফিক আহমেদের সঙ্গে আবার দেখা করবেন। কিন্তু তার আগে তিনি নিজেই কিছু প্রাথমিক খোঁজখবর নিতে চাইলেন। তিনি আব্দুল চাচার কাছে ‘জান্নাত’ হাউsbোটের স্টাফদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। “ওরা ভালো ছেলে, সাহেব,” আব্দুল চাচা বললেন। “হাউসবোটের কেয়ারটেকার ইসমাইল, আর রাঁধুনি করিম। দুজনেই অনেক বছর ধরে এখানে কাজ করছে। খুব বিশ্বাসী।” “ওদের কি কোনো শত্রু ছিল?” অরিন্দম জিজ্ঞেস করলেন। আব্দুল চাচা মাথা নাড়লেন। “না সাহেব। ওরা নিজেদের কাজ নিয়ে থাকত। কোনো ঝামেলার মধ্যে যেত না।” অরিন্দম লেকের ধারে হাঁটতে শুরু করলেন। কাল রাতের ঘটনা তাকে অস্থির করে তুলেছে। তিনি ভাবছিলেন, যদি এটা ডাকাতিই হয়, তাহলে খুনি কেন এত ঝুঁকি নিল? শুধু মানিব্যাগ আর ঘড়ির জন্য? দেবব্রত রায়ের মতো একজন ধনী ব্যক্তির কাছে তো আরও অনেক মূল্যবান জিনিস থাকতে পারত। তিনি হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারের একটি ছোট চায়ের দোকানে এসে বসলেন। দোকানদার তাকে চিনত। “কী খবর, সাহেব? কাল রাতের ঘটনা শুনেছেন?” অরিন্দম মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ। খুব খারাপ ঘটনা। আপনি কিছু শুনেছেন?” “শুনেছি সাহেব। সবাই বলাবলি করছে, ডাকাতি। কিন্তু আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।” দোকানদার ফিসফিস করে বলল। “কেন?” “দেবব্রত সাহেব নাকি খুব সতর্ক ছিলেন। তাঁর হাউসবোটে সব সময় দুজন দেহরক্ষী থাকত। কাল রাতে তারা কোথায় ছিল?” অরিন্দম চমকে উঠলেন। দেহরক্ষী! এই তথ্যটা তো পুলিশ বলেনি। “দেহরক্ষী? আপনি নিশ্চিত?” “হ্যাঁ সাহেব। আমি দেখেছি। উনি যখনই শিকারায় বের হতেন, দুজন লোক তাঁর সঙ্গে থাকত। খুব শক্তপোক্ত চেহারার লোক।” অরিন্দমের মনে নতুন প্রশ্নের জন্ম হলো। যদি দেবব্রত রায়ের দেহরক্ষী থাকত, তাহলে খুনের রাতে তারা কোথায় ছিল? তাদের অনুপস্থিতি কি কোনো যোগসূত্র বহন করে? তিনি দ্রুত ইনস্পেক্টর রফিক আহমেদের অফিসে গেলেন। রফিক সাহেব তখন ব্যস্ত ছিলেন। অরিন্দমকে দেখে তিনি কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করলেন। “আবার আপনি, মিস্টার সেন? আমি আপনাকে বলেছিলাম, আমাদের কাজ করতে দিন।” “ইনস্পেক্টর, আমার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে,” অরিন্দম বললেন। “দেবব্রত রায়ের কি কোনো দেহরক্ষী ছিল?” রফিক সাহেব কিছুক্ষণ অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। “হ্যাঁ, ছিল। দুজন। কিন্তু খুনের রাতে তারা হাউসবোটে ছিল না।” “কেন ছিল না?” অরিন্দম জানতে চাইলেন। “তারা সেদিন সন্ধ্যায় শ্রীনগরের বাইরে গিয়েছিল, দেবব্রত রায়ের নির্দেশে। সম্ভবত কোনো ব্যবসায়িক কাজে। তারা ফিরে আসার আগেই ঘটনা ঘটে গেছে।” “তারা কি দেবব্রত রায়ের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রুর সম্পর্কে কিছু জানে?” “আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা কিছুই জানে না। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, দেবব্রত রায় তাদের কোনো ব্যক্তিগত বিষয় বা ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে কিছু বলতেন না।” অরিন্দম তাঁর পকেট থেকে সবুজ সুতোর টুকরোটি বের করলেন। “এটা আমি দেবব্রত রায়ের হাতের কাছে পেয়েছি। এটা কি ফরেনসিক টিমের নজরে এসেছে?” রফিক সাহেব সুতোর টুকরোটি হাতে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। তাঁর ভ্রু কুঁচকে গেল। “না, এটা তো আমাদের নজরে আসেনি। এটা খুব ছোট।” তিনি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞকে ডেকে সুতোর টুকরোটি পরীক্ষা করতে বললেন। “এটা সম্ভবত কোনো কাশ্মীরি শালের সুতো,” ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ বললেন। “এই ধরণের সুতো এখানে খুব সাধারণ।” অরিন্দম হতাশ হলেন। যদি এটা সাধারণ সুতো হয়, তাহলে এর কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু তাঁর মন মানছিল না। দেবব্রত রায়ের মতো একজন মানুষ, যিনি সব সময় দামি পোশাক পরতেন, তাঁর হাতের কাছে কাশ্মীরি শালের সুতো কেন থাকবে? “ইনস্পেক্টর, আমি কি হাউসবোটের স্টাফদের সঙ্গে কথা বলতে পারি?” অরিন্দম জানতে চাইলেন। রফিক সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন। “ঠিক আছে। কিন্তু বেশি প্রশ্ন করবেন না। তারা এমনিতেই খুব ভয় পেয়েছে।” অরিন্দম পুলিশ স্টেশনের একটি ছোট ঘরে ইসমাইল এবং করিমের সঙ্গে দেখা করলেন। ইসমাইল, হাউসবোটের কেয়ারটেকার, একজন মধ্যবয়সী লোক। তার চোখে ভয় আর ক্লান্তি স্পষ্ট। করিম, রাঁধুনি, তার থেকে কিছুটা ছোট, সেও ভীত সন্ত্রস্ত। “আমি জানি এটা আপনাদের জন্য খুব কঠিন সময়,” অরিন্দম শান্ত গলায় বললেন। “আমি শুধু জানতে চাইছিলাম, খুনের রাতে কী ঘটেছিল?” ইসমাইল ভয়ে ভয়ে বলল, “আমরা কিছুই জানি না, সাহেব। আমরা তখন রান্নাঘরে ছিলাম। রাত প্রায় বারোটা হবে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনলাম। ধুপ করে কিছু পড়ার শব্দ। আমরা ভয়ে জমে গিয়েছিলাম। তারপর আর কোনো শব্দ শুনিনি। সকালবেলা যখন দেবব্রত সাহেবকে ডাকতে গেলাম, তখন দেখি…” ইসমাইলের গলা ধরে এল। “আপনারা কি কোনো অপরিচিত লোককে হাউসবোটের আশেপাশে দেখেছিলেন?” অরিন্দম জিজ্ঞেস করলেন। করim মাথা নাড়ল। “না সাহেব। লেকের ধারে সব সময় শিকারারা থাকে। আমরা কাউকে খেয়াল করিনি।” “দেবব্রত রায়ের সঙ্গে কি সেদিন সন্ধ্যায় কেউ দেখা করতে এসেছিল?” ইসমাইল কিছুক্ষণ ভাবল। “হ্যাঁ, একজন এসেছিল। সন্ধ্যাবেলা। একজন স্থানীয় লোক। খুব দামি পোশাক পরা ছিল। আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি।” অরিন্দমের কান খাড়া হয়ে গেল। “কে ছিল সে? নাম জানেন?” “না সাহেব। শুধু জানি, সে দেবব্রত সাহেবের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিল। তারপর চলে গিয়েছিল।” “সে দেখতে কেমন ছিল?” ইসমাইল লোকটির একটি অস্পষ্ট বর্ণনা দিল – লম্বা, দোহারা চেহারা, মুখে দাড়ি, মাথায় ফেজ টুপি। অরিন্দম সবুজ সুতোর টুকরোটির কথা ভাবলেন। এই সুতো কি সেই অপরিচিত লোকটির পোশাকের অংশ হতে পারে? তিনি ইসমাইল এবং করিমকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁর মনে হলো, এই রহস্যের জট আরও গভীর হচ্ছে। ডাকাতির তত্ত্ব ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসছে। দেবব্রত রায়ের দেহরক্ষীদের অনুপস্থিতি, অপরিচিত ব্যক্তির আগমন, এবং সেই সবুজ সুতোর টুকরো – সবকিছুই এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অরিন্দম শ্রীনগরের বাজারগুলোতে ঘুরতে শুরু করলেন। তিনি বিভিন্ন শালের দোকানে গেলেন, সবুজ সুতোর মতো কোনো শালের খোঁজ করলেন। কিন্তু কাশ্মীরি শাল এত বৈচিত্র্যময় যে, একটি নির্দিষ্ট সুতোর টুকরো থেকে কোনো শালের উৎস খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। তবে তিনি হাল ছাড়লেন না। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে, ছোট ছোট সূত্রগুলোই অনেক সময় বড় রহস্যের সমাধান করে। তিনি জানতেন, দেবব্রত রায়ের খুনের পেছনে শুধু ডাকাতি নয়, আরও গভীর কোনো কারণ লুকিয়ে আছে। আর সেই কারণ খুঁজতে হলে তাঁকে কাশ্মীরের এই শান্ত উপত্যকার গভীরে প্রবেশ করতে হবে, যেখানে চিনার গাছের ছায়ায় লুকিয়ে আছে অনেক অজানা গল্প, অনেক গোপন রহস্য। অরিন্দম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি এই রহস্যের সমাধান না করে কাশ্মীর ছাড়বেন না।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion