Episode 5904 words0 views

পঞ্চম অধ্যায়: গোপন ডায়েরি এবং একটি নতুন বিপদ

অরিন্দম আবার ‘জান্নাত’ হাউসবোটের দিকে গেলেন। যদিও হাউসবোটটি সিল করা ছিল, অরিন্দম ইনস্পেক্টর রফিক আহমেদের অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। রফিক সাহেব তাকে সতর্ক করে দিলেন, “মিস্টার সেন, আপনি যা করছেন, তা বিপজ্জনক হতে পারে। মীর জাফরের অনেক ক্ষমতা।” অরিন্দম জানতেন, দেবব্রত রায় একজন অত্যন্ত সতর্ক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মতো একজন মানুষ নিশ্চয়ই তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র বা গোপন তথ্যগুলো সুরক্ষিত রাখতেন। রফিউদ্দিনের কথা মনে পড়ল, তার কাছে কিছু কাগজপত্র ছিল। দেবব্রত রায়ের কাছেও কি এমন কিছু থাকতে পারে? অরিন্দম দেবব্রত রায়ের ঘরের প্রতিটি কোণ খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। আলমারি, দেরাজ, বিছানার নিচে – সব জায়গায় তিনি তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। কিন্তু কিছুই পেলেন না। হতাশা তাঁকে গ্রাস করতে শুরু করল। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল বিছানার পাশে রাখা একটি ছোট টেবিলের দিকে। টেবিলের ওপর একটি পুরোনো কাশ্মীরি নকশার কাঠের বাক্স রাখা ছিল। বাক্সটি দেখতে সাধারণ মনে হলেও, অরিন্দমের মনে হলো, এর ভেতরে কিছু গোপন থাকতে পারে। বাক্সটি সাধারণ দৃষ্টিতে খালি মনে হলেও, অরিন্দম দেখলেন বাক্সের তলায় একটি সূক্ষ্ম ফাঁক। তিনি বাক্সটি হাতে নিলেন। বাক্সটি বেশ ভারী ছিল। তিনি বাক্সটি খুলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেটি তালাবদ্ধ ছিল। অরিন্দম তাঁর পকেট থেকে একটি ছোট পিন বের করে তালাটি খোলার চেষ্টা করলেন। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর, তালাটি খুলে গেল। বাক্সের ভেতরে একটি ছোট, চামড়ার ডায়েরি রাখা ছিল। ডায়েরিটি বেশ পুরনো, তার পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে। অরিন্দম ডায়েরিটি হাতে নিলেন। তাঁর মনে হলো, এটাই হয়তো সেই গোপন তথ্য, যা তিনি খুঁজছিলেন। ডায়েরির প্রথম পাতায় দেবব্রত রায়ের নাম লেখা ছিল। অরিন্দম পাতা উল্টাতে শুরু করলেন। ডায়েরিতে দেবব্রত রায় তাঁর দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা, ব্যবসায়িক লেনদেন এবং তাঁর গোপন পরিকল্পনাগুলো লিখে রাখতেন। অরিন্দম দ্রুত পাতা উল্টে খুনের রাতের ঘটনার কাছাকাছি এলেন। তিনি দেখলেন, দেবব্রত রায় খুনের রাতের ঘটনাটি লিখে রেখেছেন। “আজ সন্ধ্যায় মীর জাফার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সে আমার সঙ্গে তার নতুন পর্যটন প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা করছিল। কিন্তু আমি তার কথা শুনে সন্দেহ করতে শুরু করলাম। তার কথায় কেমন যেন একটা লুকানো উদ্দেশ্য ছিল।” অরিন্দম আরও পাতা উল্টালেন। “আমি মীর জাফরের প্রকল্প নিয়ে খোঁজ নিলাম। জানতে পারলাম, সে কিছু বিতর্কিত জমি এই প্রকল্পের জন্য কিনেছে। এই জমিগুলো আসলে অবৈধভাবে দখল করা হয়েছিল। আমি তাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলাম। সে প্রথমে অস্বীকার করল, কিন্তু পরে স্বীকার করতে বাধ্য হলো।” অরিন্দমের হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হতে শুরু করল। এটাই সেই প্রমাণ, যা তিনি খুঁজছিলেন। “আমি তাকে বললাম, আমি এই অবৈধ চুক্তিতে অংশ নিতে পারব না। আমি তাকে হুমকি দিলাম, যদি সে এই অবৈধ কাজ থেকে সরে না আসে, তাহলে আমি সব কিছু ফাঁস করে দেব। সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আমি রাজি হলাম না। সে আমাকে হুমকি দিল, যদি আমি তার বিরুদ্ধে যাই, তাহলে আমার পরিণতি ভালো হবে না। আমি জানি, সে একজন ভয়ঙ্কর মানুষ। আমাকে সতর্ক থাকতে হবে।” ডায়েরির শেষ অংশটুকু ছিল অস্পষ্ট, রক্তে ভেজা। বোঝা যাচ্ছিল, দেবব্রত রায় শেষ মুহূর্তে কিছু লেখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তার আগেই খুনি তাকে আঘাত করেছে। ডায়েরির শেষ পাতায় একটি অস্পষ্ট নাম লেখা ছিল – “র…ফি…উ…”। রফিউদ্দিন! অরিন্দম নিশ্চিত হলেন, রফিউদ্দিনের কাছেও মীর জাফরের অবৈধ কাজের প্রমাণ ছিল। ডায়েরিটি হাতে নিয়ে অরিন্দম যখন হাউসবোট থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন হঠাৎ লেকের জলে একটি শিকারার শব্দ শুনতে পেলেন। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে শিকারার শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে। অরিন্দম দ্রুত নিজেকে হাউসবোটের আড়ালে লুকিয়ে ফেললেন। শিকারায় দুজন লোক ছিল। তাদের মুখ অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তারা ‘জান্নাত’ হাউসবোটের দিকে এগিয়ে এল। অরিন্দম ভয়ে জমে গেলেন। এরা কারা? মীর জাফরের লোক নয় তো? লোক দুজন হাউসবোটের চারপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করল, যেন কিছু খুঁজছে। তাদের হাবভাবে এক ধরণের অস্থিরতা ছিল। অরিন্দম বুঝতে পারলেন, তারা হয়তো এই ডায়েরিটিই খুঁজছিল। ভাগ্যক্রমে, তারা অরিন্দমকে দেখতে পেল না। কিছুক্ষণ পর তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেল। অরিন্দম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি জানতেন, তিনি একটি বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। ডায়েরিটি হাতে নিয়ে তিনি দ্রুত ইনস্পেক্টর রফিক আহমেদের অফিসের দিকে রওনা দিলেন। তাঁর মনে হলো, এই ডায়েরিই মীর জাফরের মুখোশ খুলে দেবে। কিন্তু এই ডায়েরি হাতে আসার পর তাঁর জীবন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। রফিক সাহেব ডায়েরিটি দেখে চমকে উঠলেন। তিনি দ্রুত ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে গেলেন। দেবব্রত রায়ের হাতের লেখা এবং তাঁর গোপন তথ্যগুলো পড়ে রফিক সাহেব নিশ্চিত হলেন, মীর জাফারই খুনি। রফিউদ্দিনের নাম দেখে তিনি আরও অবাক হলেন। “এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ, মিস্টার সেন,” রফিক সাহেব বললেন। “এই ডায়েরি মীর জাফরকে ফাঁসিতে ঝোলাতে যথেষ্ট। আর রফিউদ্দিনের মৃত্যুর রহস্যও এবার উন্মোচিত হবে।” রফিক সাহেব দ্রুত মীর জাফরকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলেন। পুলিশ মীর জাফরের বাড়িতে অভিযান চালালো এবং তাকে গ্রেফতার করল। মীর জাফর প্রথমে সবকিছু অস্বীকার করলেও, দেবব্রত রায়ের ডায়েরি এবং সবুজ শালের সুতোর টুকরোর প্রমাণ দেখে সে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হলো। সে স্বীকার করল, দেবব্রত রায় তার অবৈধ লেনদেনের কথা জেনে ফেলেছিলেন এবং তাকে ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। তাই সে দেবব্রত রায়কে খুন করেছে। সে আরও স্বীকার করল যে, রফিউদ্দিনও তার অবৈধ কাজের কথা জেনে গিয়েছিল এবং তাকে হুমকি দিয়েছিল, তাই সে রফিউদ্দিনকেও খুন করেছে এবং তার কাগজপত্রগুলো সরিয়ে ফেলেছে। অরিন্দম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এই রহস্যের সমাধান হয়েছে। কাশ্মীরের শান্ত উপত্যকায় যে অশনি সংকেত এসেছিল, তার কারণ উন্মোচিত হয়েছে। উপসংহার: শান্ত উপত্যকার নীরবতা কয়েকদিন পর। শ্রীনগরের আকাশ আবার পরিষ্কার হয়েছে। ডাল লেকের জল আবার আয়নার মতো স্বচ্ছ। অরিন্দম তাঁর হাউসবোট ‘শীতলছায়া’-এর বারান্দায় বসে আছেন। তাঁর হাতে চায়ের কাপ। আব্দুল চাচা তাঁর পাশে এসে বসলেন। “সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে, সাহেব। আপনি একজন মহান মানুষ।” অরিন্দম হাসলেন। “আমি শুধু আমার কাজ করেছি, আব্দুল চাচা।” তিনি কাশ্মীরের দিকে তাকালেন। এই উপত্যকা অনেক রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। এই উপত্যকা একই সঙ্গে সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর। তিনি জানতেন, তাঁর এই কাশ্মীর ভ্রমণ শুধু ছুটি কাটানোর জন্য ছিল না, এটি ছিল এক গভীর রহস্যের সমাধান করার এক অপ্রত্যাশিত যাত্রা। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি আবার আসবেন কাশ্মীরে। হয়তো অন্য কোনো রহস্যের সন্ধানে, অথবা শুধু এই শান্ত উপত্যকার নীরবতা উপভোগ করার জন্য।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion