ইনস্পেক্টর রফিক আহমেদ মীর জাফরকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন। মীর জাফার একজন সুপুরুষ, মাঝবয়সী ব্যক্তি। তাঁর মুখে এক ধরণের আত্মবিশ্বাসের ছাপ। তাঁর চোখের গভীরে এক শীতল চাতুর্য লুকিয়ে ছিল। তিনি রফিক সাহেবের সামনে বসে শান্তভাবে অরিন্দম এবং রফিক সাহেবের কথা শুনলেন। তাঁর হাবভাবে কোনো উদ্বেগের চিহ্ন ছিল না, যেন তিনি এই ধরণের পরিস্থিতি সামলাতে অভ্যস্ত।
“মীর সাহেব, আমরা দেবব্রত রায়ের খুনের তদন্ত করছি,” রফিক সাহেব বললেন। “আমরা জানতে পেরেছি, খুনের রাতে আপনি দেবব্রত রায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।”
মীর জাফরের মুখে কোনো ভাবান্তর হলো না। তিনি আলতো করে হাসলেন। “হ্যাঁ, আমি গিয়েছিলাম। একটি ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য। তাতে কী হয়েছে? আমি তো পুলিশকে জানিয়েছিলাম।”
“আপনি কি সেদিন সন্ধ্যায় এই শালটি পরেছিলেন?” অরিন্দম সবুজ শালটি মীর জাফরের দিকে এগিয়ে দিলেন। শালের ছেঁড়া অংশটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
মীর জাফর শালটি দেখে সামান্য ভ্রু কুঁচকালেন, যেন তিনি শালটি চিনতে পারছেন না। তারপর এক ঝলক অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে একটি কৃত্রিম হাসি দিলেন। “হ্যাঁ, এটা আমার বাবার শাল। আমি মাঝেমধ্যে পরি। কিন্তু এর সঙ্গে খুনের কী সম্পর্ক? আমার কাছে তো আরও অনেক শাল আছে।”
“এই শালের একটি সুতোর টুকরো দেবব্রত রায়ের হাতের কাছে পাওয়া গেছে,” অরিন্দম বললেন। “আপনি যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন কি কোনো ধস্তাধস্তি হয়েছিল?”
মীর জাফরের হাসি মিলিয়ে গেল। তাঁর চোখে এক ধরণের শীতলতা নেমে এল। “ধস্তাধস্তি? কী বলছেন আপনারা? আমি দেবব্রত রায়ের সঙ্গে শান্তভাবে কথা বলেছিলাম। আমাদের মধ্যে কোনো ধস্তাধস্তি হয়নি। তিনি আমার একজন ভালো অংশীদার ছিলেন।”
“তাহলে সুতোর টুকরোটি কীভাবে তাঁর হাতের কাছে গেল?” রফিক সাহেব প্রশ্ন করলেন।
মীর জাফর হাসলেন। “আমি জানি না। হয়তো তিনি আমার শাল থেকে কোনো সুতো তুলে নিয়েছিলেন, অজান্তেই। অথবা হয়তো অন্য কোনো সময়, অন্য কোনো স্থানে। এটা কোনো প্রমাণ হতে পারে না, ইনস্পেক্টর। এটা নিছকই কাকতালীয়।” তাঁর কণ্ঠস্বরে এক ধরণের আত্মবিশ্বাস ছিল, যা অরিন্দমকে অস্বস্তিতে ফেলল।
“আপনারা কি দেবব্রত রায়ের পর্যটন প্রকল্পের অংশীদার ছিলেন?” অরিন্দম জানতে চাইলেন।
“হ্যাঁ, আমরা অংশীদার ছিলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। আমরা দুজনেই এই প্রকল্প থেকে লাভবান হতাম। বরং, দেবব্রত রায়ের মৃত্যুতে আমারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো।” মীর জাফরের কণ্ঠে এক ধরণের দুঃখের ভান ছিল।
মীর জাফরের কথা অরিন্দমের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। লোকটি অত্যন্ত ধূর্ত। সে খুব সাবধানে কথা বলছে, কোনো ফাঁদে পা দিচ্ছে না।
“মীর সাহেব, আপনার কি কোনো শত্রু ছিল?” রফিক সাহেব প্রশ্ন করলেন।
“শত্রু? ব্যবসায়ী জীবনে প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে, শত্রু নয়। আমার কোনো ব্যক্তিগত শত্রু নেই। আমি একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ।” মীর জাফার দৃঢ় কণ্ঠে বললেন। তাঁর চোখে এক ধরণের চ্যালেঞ্জ ছিল।
রফিক সাহেব মীর জাফরকে ছেড়ে দিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সরাসরি প্রমাণ ছিল না। শুধু একটি সুতোর টুকরো আর ইসমাইলের অস্পষ্ট বর্ণনা, যা মীর জাফর খুব সহজেই উড়িয়ে দিতে পারল।
অরিন্দম হতাশ হলেন। তিনি জানতেন, মীর জাফর কিছু লুকাচ্ছেন। কিন্তু কী? মীর জাফরের প্রভাব এতটাই বেশি যে, পুলিশও তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করছে।
তিনি আবার আব্দুল হামিদের কাছে গেলেন। আব্দুল হামিদ মীর জাফরের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আমি জানতাম, মিস্টার সেন। মীর জাফরের মতো লোককে ধরা সহজ নয়। সে টাকার জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। তার বাবা একজন ভালো মানুষ ছিলেন, কিন্তু সে বাবার মতো নয়। সে একটি বিষাক্ত সাপ।”
“আপনি কি মীর জাফরের কোনো গোপন শত্রু বা কোনো খারাপ দিক সম্পর্কে কিছু জানেন?” অরিন্দম জানতে চাইলেন।
আব্দুল হামিদ কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তাঁর চোখ দূরে, যেন তিনি কিছু স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন। “মীর জাফরের একটি গোপন অভিসন্ধি ছিল। সে দেবব্রত রায়ের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল, তা ছিল একটি ফাঁদ।”
অরিন্দম চমকে উঠলেন। “ফাঁদ? কীসের ফাঁদ?”
“দেবব্রত রায় জানতেন না, মীর জাফরের এই পর্যটন প্রকল্পের আড়ালে অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিল। মীর জাফার আসলে এই প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু অবৈধ অর্থ লেনদেন করতে চেয়েছিল। সে এই প্রকল্পের জন্য কিছু জমি কিনেছিল, যা আসলে বিতর্কিত জমি ছিল। এই জমিগুলো আসলে স্থানীয় কিছু দরিদ্র পরিবারের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সে জানত, দেবব্রত রায় এই বিষয়গুলো জানতে পারলে চুক্তি বাতিল করে দেবেন।”
অরিন্দমের মনে সব কিছু স্পষ্ট হতে শুরু করল। মীর জাফার দেবব্রত রায়কে খুন করেছে, কারণ দেবব্রত রায় তার গোপন অভিসন্ধি জেনে ফেলেছিলেন।
“আপনি কিভাবে এই সব জানেন, আব্দুল সাহেব?” অরিন্দম জানতে চাইলেন।
আব্দুল হামিদ নিচু গলায় বললেন, “আমার একজন পরিচিত ছিল, রফিউদ্দিন। সে মীর জাফরের হয়ে কাজ করত। সে আমাকে সব কিছু জানিয়েছিল। সে এই অবৈধ কাজের অংশীদার হতে চায়নি, তাই সে আমাকে সব কিছু ফাঁস করে দিয়েছিল।”
“রফিউদ্দিন? সে কোথায় এখন?” অরিন্দম জিজ্ঞেস করলেন।
“সে এখন আর বেঁচে নেই, মিস্টার সেন। কিছুদিন আগে তার মৃত্যু হয়েছে, একটি দুর্ঘটনায়। সে লেকের জলে ডুবে মারা গিয়েছিল। পুলিশ বলেছিল, এটা একটি দুর্ঘটনা।” আব্দুল হামিদের চোখে এক ধরণের বিষাদ আর সন্দেহ। “কিন্তু আমার মনে হয় না এটা দুর্ঘটনা ছিল। রফিউদ্দিন সাঁতার জানত।”
অরিন্দমের মনে হলো, এই দুর্ঘটনা হয়তো দুর্ঘটনা ছিল না। হয়তো মীর জাফার তাকেও সরিয়ে দিয়েছে, যাতে তার গোপন অভিসন্ধি ফাঁস না হয়। মীর জাফরের ক্ষমতার গভীরতা অরিন্দমকে ভাবিয়ে তুলল।
“আপনার কাছে কি এই অবৈধ লেনদেনের কোনো প্রমাণ আছে?” অরিন্দম জানতে চাইলেন।
“না, আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। রফিউদ্দিন সব তথ্য আমাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছিল। সে বলেছিল, তার কাছে কিছু কাগজপত্র আছে, যা মীর জাফরের অবৈধ কাজের প্রমাণ। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সেই কাগজপত্রগুলো আর পাওয়া যায়নি।”
অরিন্দম আবার হতাশ হলেন। প্রমাণ ছাড়া মীর জাফরকে ধরা অসম্ভব। মীর জাফরের প্রভাব এতটাই বেশি যে, সে সহজেই সব প্রমাণ মুছে ফেলতে পারে।
তিনি আব্দুল হামিদকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁর মনে হলো, এই রহস্যের জট খুলতে হলে তাঁকে মীর জাফরের গোপন অভিসন্ধির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে। আর সেই প্রমাণ হয়তো লুকিয়ে আছে রফিউদ্দিনের হারিয়ে যাওয়া কাগজপত্রের মধ্যে। কিন্তু কোথায় সেই কাগজপত্র? আর রফিউদ্দিনের মৃত্যু কি সত্যিই দুর্ঘটনা ছিল? এই প্রশ্নগুলো অরিন্দমের মনে এক নতুন উদ্বেগের জন্ম দিল। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি এক ভয়ঙ্কর খেলায় জড়িয়ে পড়েছেন।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion