This entry is part 1 of 6 in the series গঙ্গার ধারে শেষ রাতআবিষ্কার
কলকাতার দুপুরগুলো বড় অদ্ভুত। বিশেষ করে আগস্ট মাসের দুপুর। আকাশের মুখ ভার, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। ঘামে ভেজা শরীর আর ট্রাফিকের তীব্র হর্নের মধ্যে একটা দমবন্ধ করা অস্বস্তি। অনিন্দিতা সেন তার অফিসের ডেস্কটপে ঝুঁকে একটা আর্টিকেলের শেষ অংশটা টাইপ করছিল। ‘হেরিটেজ ক্রাইম ইন কলকাতা’—এই ছিল তার আজকের বিষয়। শহরের পুরনো বাড়িগুলো কীভাবে প্রোমোটারদের লোভের শিকার হচ্ছে, তা নিয়েই তার এই প্রতিবেদন। রিপোর্টিং তার রক্তে, কিন্তু মাঝে মাঝে এই শহরের প্রতি একরাশ বিতৃষ্ণা এসে ভর করে।
ফোনটা যখন বাজল, তখন সে ঠিক ‘বিল্ডার-মাফিয়া-প্রশাসন’ এই শব্দ তিনটিকে একটা লাইনে গাঁথার চেষ্টা করছিল। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে ভ্রূ কুঁচকে গেল—‘ভোলাদা’।
ভোলাদা, অর্থাৎ ভোলানাথ সামন্ত। চন্দননগরে তাদের পৈতৃক বাড়ির কেয়ারটেকার। ঠিক কেয়ারটেকার বললে ভুল হবে, সে ছিল অনিন্দিতার দাদু, অর্থাৎ তার বাবার বড় জ্যাঠা, অরিন্দম সেনের ছায়াসঙ্গী। গত চল্লিশ বছর ধরে ওই বাড়ি আর অরিন্দম সেনের সবকিছুর দায়িত্ব তার কাঁধে। কিন্তু ভোলাদা তো বিশেষ কারণ ছাড়া ফোন করে না। শেষবার করেছিল মাস ছয়েক আগে, যখন অরিন্দম সেনের পায়ে চোট লেগেছিল।
“হ্যালো ভোলাদা,” ফোনটা কানে চেপে ধরে বলল অনিন্দিতা।
ওপার থেকে কোনো উত্তর এল না। শুধু একটা চাপা কান্নার মতো শব্দ ভেসে এল। অনিন্দিতার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।
“ভোলাদা? কী হয়েছে? কথা বলছ না কেন? দাদু ঠিক আছে তো?”
এবার উত্তর এল, কিন্তু সেটা কান্নার চেয়েও ভয়ঙ্কর। একটা ভাঙা, কাঁপা কাঁপা স্বর, “দাদাবাবু আর নেই, দিদিমণি।”
অনিন্দিতার হাত থেকে মোবাইলটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। সে কোনোমতে সামলে নিল। চারপাশের কোলাহল হঠাৎ করে থেমে গেছে বলে মনে হলো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসের মধ্যেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল।
“নেই মানে? কী বলছ কী? কাল রাতেও তো কথা হলো আমার সাথে। শরীর তো ভালোই ছিল।”
“জানি না গো দিদিমণি। সকালে যখন চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকলাম, তখন দেখলাম… চেয়ারে বসে আছেন, মাথাটা টেবিলের ওপর। ডাক্তার এসে বলল, সব শেষ।” ভোলার কান্নার শব্দটা এবার স্পষ্ট হলো। “পুলিশ এসেছিল। তারা বলছে, ঘুমের মধ্যেই সব শান্ত হয়ে গেছে। হার্ট অ্যাটাক।”
অনিন্দিতার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল। অরিন্দম সেন। তার দাদু। বিখ্যাত লেখক, কিন্তু চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক আর নিঃসঙ্গ। গোটা পৃথিবীর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন চন্দননগরের ওই ফরাসি আমলের বিশাল বাড়িটায়। অনিন্দিতার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর এই দাদুই ছিলেন তার একমাত্র নিকটাত্মীয়। সম্পর্কটা ভালোবাসার চেয়েও বেশি ছিল সমীহ আর দূরত্বের। কিন্তু তা সত্ত্বেও, শিকড়ের শেষ টান তো তিনিই ছিলেন।
“আমি আসছি,”—এইটুকু বলে ফোনটা কেটে দিল অনিন্দিতা। এডিটরকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য চন্দননগর।
গঙ্গার ধার ঘেঁষে রাস্তাটা যখন বাঁক নিল, তখন বিকেলের আলো নরম হয়ে এসেছে। আকাশে মেঘ জমেছে, কিন্তু তার ফাঁক গলে রুপোলি আলো নদীর জলে পড়ে চিকচিক করছে। এই আলো-আঁধারি চন্দননগরের এক নিজস্ব সম্পদ। অনিন্দিতাদের বাড়িটা স্ট্র্যান্ডের একেবারে শেষ প্রান্তে। ‘সেন বাড়ি’—এক নামে সবাই চেনে। ফরাসি স্থাপত্যের নিদর্শন, কিন্তু এখন অযত্ন আর অবহেলায় তার গায়ে শ্যাওলা জমেছে, দেওয়ালে ফাটল ধরেছে। এককালে এই বাড়ির ঘাট থেকে ফরাসি বণিকদের জাহাজ ছাড়ত। এখন সেখানে শুধু ভাঙা সিঁড়ির ধাপ আর কচুরিপানার জটলা।
গাড়ি থেকে নামতেই ভোলাদা ছুটে এল। মানুষটা বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছে। ফর্সা রঙ রোদে পুড়ে তামাটে, কিন্তু চোখ দুটো এখনও সজাগ। আজ সেই চোখে জল।
“সব শেষ হয়ে গেল গো দিদিমণি,” বলে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
অনিন্দিতা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “শান্ত হও ভোলাদা। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। পুলিশ কী বলে গেল?”
“তারা তো সব দেখে শুনে চলে গেল। বলল, স্বাভাবিক মৃত্যু। বয়স হয়েছিল, তার ওপর একা থাকতেন। পোস্টমর্টেমও করতে চাইল না। বলল, আপনারা যদি চান তো করতে পারেন, কিন্তু হয়রানি বাড়বে।”
অনিন্দিতা বাড়ির ভেতরে ঢুকল। বাইরে থেকে যতটা জীর্ণ মনে হয়, ভেতরটা ততটা নয়। ভোলাদা সাধ্যমতো গুছিয়ে রাখে। কিন্তু বাড়ির বিশালতা আর শূন্যতা মিলে একটা অদ্ভুত শীতল স্রোত বইছে। দেওয়ালে টাঙানো পুরনো অয়েল পেন্টিংগুলো যেন জীবন্ত হয়ে তাকে দেখছে।
অরিন্দম সেনের ঘরটা ছিল দোতলায়, তার লাইব্রেরি সংলগ্ন। সেই লাইব্রেরি, যা ছিল তার পৃথিবী। হাজার হাজার বইয়ের দুর্গ বানিয়ে তিনি নিজেকে বাইরের জগৎ থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। অনিন্দিতা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। লাইব্রেরির দরজাটা খোলাই ছিল।
ভেতরে পা রাখতেই নাকে এল পুরনো কাগজের সেই পরিচিত গন্ধটা। তার সাথে মিশে আছে পাইপের তামাকের হালকা সুবাস। অরিন্দম সেনের লেখার টেবিলটা ঘরের একেবারে শেষ প্রান্তে, বিশাল একটা জানলার সামনে। সেই জানলা দিয়ে গঙ্গার একটা অংশ দেখা যায়। টেবিলের ওপর একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। আর সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে চেয়ারে এলিয়ে থাকা একটা শরীর।
অনিন্দিতা এগিয়ে গেল। অরিন্দম সেনের মুখটা শান্ত, যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার পাকা চুলগুলো সামান্য অবিন্যস্ত। পরনে তার প্রিয় খদ্দরের পাঞ্জাবি। টেবিলের ওপর একটা বই খোলা, তার পাশে একটা চায়ের কাপ আর তার অ্যাশট্রে। দেখে মনে হচ্ছে, পড়তে পড়তে বা লিখতে লিখতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, আর সেই ঘুম ভাঙেনি।
পুলিশের কথাগুলোই সত্যি বলে মনে হচ্ছিল। একজন একা, বয়স্ক মানুষের জন্য এমন মৃত্যু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অনিন্দিতার সাংবাদিক মন খুঁতখুঁত করছিল। সে খুব কাছ থেকে টেবিলটা দেখতে লাগল।
হঠাৎ একটা জিনিসে তার চোখ আটকে গেল। চায়ের কাপটা। অরিন্দম সেন কড়া লিকার চা খেতেন, চিনি ছাড়া। কিন্তু কাপের ধারে একদানা চিনি লেগে আছে। তিনি নিজে হাতে চা বানালেও, চিনির কৌটো ছুঁতেন না। ভোলাদা চা দিলে সেও জানে দাদাবাবুর এই অভ্যাসের কথা। তাহলে?
হয়তো ভুল করে… কিন্তু অরিন্দম সেন ছিলেন পারফেকশনিস্ট। তার টেবিলে একটা পিনও ভুল জায়গায় থাকত না।
তার চোখ গেল খোলা বইটার দিকে। ফরাসি কবি বোদলেয়ারের ‘লে ফ্লর দ্যু মাল’ (Les Fleurs du mal)। বইটার একটা নির্দিষ্ট পাতায় একটা লাইন পেন্সিল দিয়ে দাগানো— “Le poison qui découle / De tes yeux, de tes yeux verts” (The poison that flows / From your eyes, from your green eyes)।
অরিন্দম সেনের চোখ সবুজ ছিল না। তবে কি এটা কোনো সংকেত? অনিন্দিতার মনে হলো, সে একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। আত্মহত্যা বা স্বাভাবিক মৃত্যু—কোনোটাই তার মন মেনে নিতে পারছিল না।
এমন সময় দরজায় এসে দাঁড়াল একজন পুলিশ অফিসার। মাঝবয়সী, সামান্য ভুঁড়ি, কিন্তু চোখ দুটো তীক্ষ্ণ।
“আমি ইন্সপেক্টর চ্যাটার্জী। খবরটা পেয়ে আর একবার এলাম। আপনিই তো ওনার নাতনি?”
“আমি ওনার বাবার ভাইয়ের নাতনি। অনিন্দিতা সেন।”
“ওহ। দেখুন, আমাদের যা মনে হয়েছে, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু। কোনো রকম জোরজবরদস্তির চিহ্ন নেই। ঘর থেকেও কিছু খোয়া যায়নি। উনি কি ডিপ্রেশনে ভুগতেন?”
“না, ঠিক ডিপ্রেশন নয়। তবে উনি একাকীত্ব পছন্দ করতেন। কিন্তু উনি মানসিকভাবে খুব শক্ত ছিলেন।”
ইন্সপেক্টর চ্যাটার্জী একবার ঘরের চারদিকে চোখ বোলালেন। “হুম। যাই হোক, আমরা কেস ক্লোজ করে দিয়েছি। আপনাদের কোনো সন্দেহ থাকলে জানাতে পারেন। বডি কাল সকালে সৎকারের জন্য নিয়ে যেতে পারেন।”
পুলিশ অফিসারটি চলে যাওয়ার পরেও অনিন্দিতা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল, এই শান্ত, নীরব ঘরটার দেওয়ালে অনেক না বলা কথা জমে আছে। তার দাদুর মৃত্যুটা এতটাও সহজ নয়।
সে ভোলাদাকে ডাকল। “ভোলাদা, দাদুর এই চায়ের কাপটা কে এনেছিল?”
ভোলাদা কাপটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তো সকালে আনিনি, দিদিমণি। এটা কাল রাতের চা হবে। দাদাবাবু অনেক রাত অবধি কাজ করতেন, তখন নিজেই বানিয়ে নিতেন।”
“কিন্তু ভোলাদা, দাদু তো চিনি খেতেন না। কাপে চিনি লেগে আছে।”
ভোলাদার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে ভালো করে কাপটা দেখে বলল, “তাই তো! এটা তো আমি খেয়াল করিনি। কিন্তু…।”
অনিন্দিতা বুঝল, তার সন্দেহ অমূলক নয়। এই বাড়িতে, এই মৃত্যুর পেছনে একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। সে সিদ্ধান্ত নিল, আপাতত কলকাতাতে ফিরবে না। এখানেই থাকবে। সত্যিটা তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
সে টেবিলের ড্রয়ারগুলো খুলতে শুরু করল। প্রথম দুটো ড্রয়ারে পুরনো পাণ্ডুলিপি, কলম আর দরকারি কাগজপত্র। শেষ ড্রয়ারটা খুলতেই সে পেল জিনিসটা। একটা পুরনো, চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি। এটা অরিন্দম সেনের হাতের লেখার ডায়েরি নয়। আরও পুরনো, কালির হরফে লেখা। প্রথম পাতায় কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা—‘রাধাকান্ত সেনের রোজনামচা, সন ১২৬০’।
রাধাকান্ত সেন ছিলেন তাদের পূর্বপুরুষ। এই বাড়ির প্রথম মালিক। অনিন্দিতার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় দ্রুত চলতে শুরু করল। সে বুঝতে পারছিল, সে এমন একটা রহস্যের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, যার শিকড় হয়তো এই বাড়ির মতোই পুরনো।
গঙ্গার দিক থেকে একটা দমকা হাওয়া এসে জানলার কাঁচের ওপর আছড়ে পড়ল। বাইরে তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। অনিন্দিতা ডায়েরিটা হাতে নিয়ে চেয়ারটায় বসল। তার মনে হলো, অরিন্দম সেনের শেষ রাতটা এখনও শেষ হয়নি। বরং, সেই রাতের আসল গল্পটা সবে শুরু হতে চলেছে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion