গুপ্তধনের কথা
রাতের নিস্তব্ধতা যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। বাইরে বৃষ্টির শব্দটা এখন একটা একটানা সুরের মতো শোনাচ্ছে। অরিন্দম সেনের নিথর দেহটা পাশের ঘরে সৎকারের জন্য রাখা হয়েছে, কিন্তু অনিন্দিতার মনে হচ্ছিল, তার উপস্থিতি সারা বাড়িতে ছড়িয়ে আছে। টেবিল ল্যাম্পের হলদে আলোয় সে চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরিটার প্রথম পাতা খুলল। পুরনো তুলোট কাগজের ওপর কালচে হয়ে আসা কালি। লেখাগুলো খুব যত্ন করে লেখা, যেন প্রত্যেকটা অক্ষর গেঁথে দেওয়া হয়েছে।
‘শ্রী শ্রী হরি স্মরণং। রোজনামচা, শ্রীরাধাকান্ত সেন। সন ১২৬০ বঙ্গাব্দ, মাঘ মাস।’
অনিন্দিতা সাংবাদিকতার ছাত্রী, ইতিহাসের প্রতি তার বরাবরই একটা টান ছিল। ১২৬০ বঙ্গাব্দ মানে ১৮৫৩ সাল। সিপাহী বিদ্রোহের ঠিক আগে। চন্দননগর তখন ফরাসিদের অধীনে। রাধাকান্ত সেন ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী, ফরাসিদের সাথে তার ভালো যোগাযোগ ছিল। ডায়েরির প্রথম কয়েকটি পাতায় সাধারণ ব্যবসার কথা, সামাজিক অনুষ্ঠানের বর্ণনা, আর ফরাসি গভর্নর মসিয়ে দ্যুবঁসের সাথে তার সাক্ষাতের কথা লেখা।
কিন্তু অনিন্দিতার চোখ আটকে গেল ফাল্গুন মাসের একটি লেখায়।
“অদ্য রজনীতে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিল। আমার ফরাসি বন্ধু, জ্যাঁ-পিয়ের, যিনি ‘Compagnie des Indes’ (ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি)-এর একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী, গোপনে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। তাহার মুখ শুষ্ক, চক্ষু ভীত। তিনি বলিলেন, কোম্পানির অবস্থা ভালো নহে। ইংরেজদের সহিত প্রতিযোগিতায় তাহারা ক্রমাগত হারিয়া যাইতেছে। এমনও হইতে পারে যে, শীঘ্রই ফরাসিরা চন্দননগর ত্যাগ করিতে বাধ্য হইবে। এই কথা বলিয়া তিনি আমার নিকট একটি প্রস্তাব রাখিলেন। কোম্পানির কিছু অতি মূল্যবান সম্পদ—স্বর্ণমুদ্রা, হীরা এবং একটি পান্নাখচিত তরবারি—তিনি আমার নিকট গচ্ছিত রাখিতে চাহেন। কারণ, এই সম্পদ কোম্পানির হিসাবের বাহিরে। যদি ফরাসিরা ফিরিয়া আসে, তবে তাহারা ইহা ফেরত লইবে। আর যদি না আসে, তবে ইহা আমার। বিনিময়ে, আমাকে শুধু এই গুপ্তধনের রক্ষক হইতে হইবে।”
অনিন্দিতার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। গুপ্তধন! তার মানে, গ্রামের লোকমুখে যা শোনা যায়, তা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। সে দ্রুত পাতা ওল্টাতে লাগল। পরের কয়েকটি পাতায় রাধাকান্ত সেনের ভয় আর উত্তেজনার কথা লেখা। তিনি কীভাবে বাড়ির নিচে, গঙ্গার দিকে মুখ করা একটি গোপন কুঠুরিতে সেই সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন, তার বর্ণনা দেওয়া আছে।
কিন্তু গল্পের মোড় ঘুরল অন্য জায়গায়। চৈত্র মাসের একটি লেখায় নতুন একটি গোষ্ঠীর কথা উঠে এল।
“জ্যাঁ-পিয়ের আজ পুনরায় আসিয়াছিলেন। তিনি একা আসেন নাই, সঙ্গে আরও দুইজন ফরাসি ভদ্রলোক ছিলেন। তাহারা নিজেদের ‘Les Gardiens du Lys’ বা ‘লিলির রক্ষক’ বলিয়া পরিচয় দিলেন। লিলি ফুল ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের প্রতীক। তাহারা বলিলেন, এই গুপ্তধন শুধু কোম্পানির নয়, ইহা ফ্রান্সের এক প্রাচীন পরিবারের সম্মান ও ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। তাহারা আমাকে এই গুপ্ত সমিতির সদস্য হিসাবে গ্রহণ করিলেন এবং একটি শপথ পাঠ করাইলেন। এই গুপ্তধনের কথা বংশপরম্পরায় শুধু একজন যোগ্য উত্তরসূরীর নিকট হস্তান্তর করা যাইবে। যদি কেহ লোভের বশবর্তী হইয়া ইহা আত্মসাৎ করিবার চেষ্টা করে, তবে তাহার মৃত্যু নিশ্চিত। রক্ষকদের চোখ সর্বদা এই বাড়ির ওপর থাকিবে।”
অনিন্দিতার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ‘লিলির রক্ষক’—এই নামটা সে আগে কোথাও শুনেছে কি? মনে করার চেষ্টা করল। তার দাদুর লেখা কোনো উপন্যাসে? নাকি কোনো ঐতিহাসিক প্রবন্ধে?
হঠাৎ তার মনে পড়ল, অরিন্দম সেনের খোলা বইটাতে দাগানো লাইনটার কথা— “Le poison qui découle / De tes yeux, de tes yeux verts” (The poison that flows / From your eyes, from your green eyes)। সবুজ চোখ! জ্যাঁ-পিয়েরের চোখের রঙ কি সবুজ ছিল? ডায়েরিতে তার কোনো বর্ণনা নেই।
ডায়েরিটা বন্ধ করে অনিন্দিতা চেয়ারে হেলান দিল। মাথাটা কাজ করছে না। তাহলে কি তার দাদু এই গুপ্তধনের কথা জানতে পেরেছিলেন? আর সেই কারণেই তাকে খুন হতে হয়েছে? কিন্তু ‘লিলির রক্ষক’ নামের এই গুপ্ত সমিতি কি এখনও সক্রিয়? দেড়শো বছরেরও বেশি সময় পরেও? ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল।
চায়ের কাপের মধ্যে লেগে থাকা চিনির দানাটার কথা আবার মনে পড়ল। বিষ? চায়ের মধ্যে কি বিষ মেশানো হয়েছিল? এমন কোনো বিষ, যা হার্ট অ্যাটাককে ত্বরান্বিত করে এবং পোস্টমর্টেমেও সহজে ধরা পড়ে না? একজন সাংবাদিক হিসেবে সে এই ধরনের বিষের কথা পড়েছে।
পরদিন সকালে অরিন্দম সেনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো। আত্মীয়-স্বজন বলতে যারা এসেছিলেন, তারা সবাই দূর সম্পর্কের। তাদের চোখে শোকের চেয়ে বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে লোভটাই বেশি দেখা যাচ্ছিল। অনিন্দিতার এক কাকা, প্রশান্ত সেন, যিনি কলকাতায় ব্যবসা করেন, তিনি বারবার প্রোমোটারের কথা তুলছিলেন।
“বাড়িটা তো এখন ভুতুড়ে হয়ে গেছে। তুই একা একটা মেয়ে এখানে কী করবি? তার চেয়ে একজন ভালো প্রোমোটার আছে আমার চেনা, তাকে দিয়ে দে। ফ্ল্যাট পাবি, টাকাও পাবি।”
অনিন্দিতা শক্তভাবে উত্তর দিল, “এ বাড়ি বিক্রি হবে না। দাদুর শেষ স্মৃতি এটা। আমিই দেখব।”
প্রশান্ত সেনের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। “তোর যা ভালো মনে হয় করিস। কিন্তু এই ভাঙা বাড়ি আগলে পড়ে থাকলে পস্তাবি।”
তাদের কথাবার্তার মাঝখানেই ভোলাদা এসে জানাল, একজন ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন। নাম, অধ্যাপক পার্থসারথি ঘোষ। স্থানীয় কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং চন্দননগরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন।
পার্থসারথি বাবু ঘরে ঢুকলেন। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে সাধারণ পাজামা-পাঞ্জাবি। হাতে একটা পুরনো বই।
“আমি অরিন্দমবাবুর লেখার খুব ভক্ত ছিলাম। খবরটা পেয়ে খুব খারাপ লাগল। উনি শুধু একজন লেখক ছিলেন না, চন্দননগরের জীবন্ত ইতিহাস ছিলেন।”
অনিন্দিতা তাকে বসতে বলল। পার্থসারথি বাবু ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বললেন, “এই বাড়িটা একটা মিউজিয়াম। এর প্রত্যেকটা ইঁটে ইতিহাস লেগে আছে। অরিন্দমবাবু আমাকে মাঝে মাঝে এখানে এসে গবেষণা করার অনুমতি দিতেন। আচ্ছা, উনি কি সম্প্রতি ফরাসি আমলের কোনো গোপন সমিতি নিয়ে কিছু বলছিলেন আপনাকে?”
অনিন্দিতা চমকে উঠল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “গোপন সমিতি? ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
“আসলে আমি গবেষণা করতে গিয়ে একটা অদ্ভুত তথ্য পেয়েছি। ‘Les Gardiens du Lys’ বা ‘লিলির রক্ষক’ নামে একটি সমিতির কথা। এরা নাকি ফরাসি আমলের কোনো গুপ্তধন রক্ষা করত। শোনা যায়, তাদের প্রতীক ছিল সবুজ রঙের লিলি ফুল। আর তাদের সদস্যদের বংশধররা এখনও চন্দননগরেই বাস করে। অরিন্দমবাবু এই বিষয়টা নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন। মাসখানেক আগে উনি আমাকে ফোন করে এই সমিতি নিয়ে কিছু প্রশ্নও করেছিলেন।”
অনিন্দিতার বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল। তাহলে তার দাদু সত্যিই কিছু একটা জানতে পেরেছিলেন।
পার্থসারথি বাবু বলতে লাগলেন, “সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন? এই সমিতির সদস্যদের নাকি সবুজ চোখ ছিল। এটা তাদের বংশের একটা বৈশিষ্ট্য। জ্যাঁ-পিয়ের নামে এক ফরাসি কর্মচারী ছিলেন এই সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। তার চোখ ছিল পান্নার মতো সবুজ।”
বোদলেয়ারের কবিতার সেই লাইনটা আবার অনিন্দিতার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। ‘তোমার সবুজ চোখ থেকে যে বিষ ঝরে পড়ে…’
এটা কোনো কাকতালীয় হতে পারে না। তার দাদু তাকে কোনো বার্তা দিয়ে যেতে চেয়েছেন।
পার্থসারথি বাবু চলে যাওয়ার পর অনিন্দিতা আবার লাইব্রেরি ঘরে এল। সে ঠিক করল, এই রহস্যের শেষ তাকে দেখতেই হবে। সে রাধাকান্ত সেনের ডায়েরিটা আবার খুলল। শেষ পাতায় একটা অদ্ভুত নকশা আঁকা। একটা মানচিত্রের মতো, কিন্তু কোনো জায়গার নাম নেই। শুধু কয়েকটা সাংকেতিক চিহ্ন আর একটা ফরাসি শব্দ লেখা—‘Sous la lune’—অর্থাৎ, ‘চাঁদের নিচে’।
অনিন্দিতা বুঝতে পারছিল, এই নকশাটাই হলো গুপ্তধনের মানচিত্র। কিন্তু এর মানে কী? ‘চাঁদের নিচে’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
সে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গঙ্গার জল জোয়ারের টানে ফুলে উঠছে। তার মনে হলো, এই বাড়ির প্রতিটি কোণায়, নদীর জলের গভীরে, ইতিহাসের পরতে পরতে একটা ভয়ঙ্কর রহস্য লুকিয়ে আছে। আর সেই রহস্যের চাবিকাঠি তার হাতে। এই মুহূর্তে সে শুধু একজন সাংবাদিক নয়, সে একজন গোয়েন্দা। আর তার প্রথম কেস—তার নিজের দাদুর মৃত্যু।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion