আশগ্রামের বিষাদ ও প্রবাদ
আশগ্রাম, এককালে যে গ্রামটি সবুজের সমারোহে ভরে থাকত, এখন তা কেবল ধুলো আর বালির মরুভূমি। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ থেকে যেন মেঘেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাদের সাদা, নরম উপস্থিতি এখন কেবল স্মৃতিতে। গত তিন বছর ধরে একটি ফোঁটা বৃষ্টিও পড়েনি এই মাটিতে। মাঠের পর মাঠ ফেটে চৌচির, সেগুলোতে এখন কেবল গভীর ফাটল আর ধূসর ধুলো খেলা করে। ফসলের অভাবে কৃষকদের চোখে গভীর হতাশা, তাদের কঠোর পরিশ্রমে গড়া স্বপ্নগুলো যেন সূর্যের উত্তাপে শুকিয়ে গেছে। শুকনো নদীখাতগুলো পড়ে আছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তাদের বুকে এখন কেবল চিকচিক বালির স্তূপ, যেন নিজের হারিয়ে যাওয়া জলধারার জন্য শোক করছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই ক্ষুধার্ত শিশুদের ম্লান মুখ আর খাদ্যের জন্য হাহাকার – এই ছিল আশগ্রামের বর্তমান নির্মম বাস্তবতা। বাতাস ছিল ভারী, ধুলোয় মাখা, প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে যেন বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হতো, ফুসফুস ভরে উঠত বালুকণার তীক্ষ্ণ স্পর্শে। দিনের বেলা সূর্যটা যেন আকাশের বুকে এক আগুনের গোলা হয়ে জ্বলত, আর মাটি থেকে উঠে আসত অসহ্য তাপ, যা চামড়া ভেদ করে হাড় পর্যন্ত পুড়িয়ে দিত। রাতের বেলা তারার মেলা দেখা যেত বটে, কিন্তু সেই সৌন্দর্যও যেন তাদের বিষণ্ণতাকে ঢাকতে পারছিল না। গ্রামের মানুষের ফিসফাস এখন আর সুখের গল্প বলে না, বলে এক অজানা অভিশাপের কথা, ড্রাগনের অভিশাপ। কেউ কেউ বলত, রাতে নাকি শুকিয়ে যাওয়া নদীর ধারে পিশাচদের দেখা যায়, যারা মানুষের আশা শুষে নেয়। এই গল্পগুলো গ্রামের বাতাসে এক চাপা ভয় আর অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে দিয়েছিল, প্রতিটি হৃদয়ে ছিল এক অজানা আতঙ্কের ছায়া। সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল সেই নীরবতা – এমন এক নীরবতা যা কানে বাজত, যেন কোনো অদৃশ্য সত্তা তাদের প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস শুনছে, তাদের শেষ আশাটুকুও চুষে নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। কখনো কখনো, দূর থেকে ভেসে আসত শুকনো বাঁশির সুর, যা শুনলে মনে হতো কোনো হারানো আত্মা কাঁদছে, আর সেই সুর যেন গ্রামবাসীদের হৃদয়ের গভীরে আরও ভয় ঢুকিয়ে দিত।
ছোট্ট আশগ্রাম, যেখানে একসময় সবুজ বনানী আর উর্বর মাটি ছিল প্রাণবন্ততার প্রতীক, এখন তা যেন মৃত্যুপুরী। মাটির প্রতিটি কণা, প্রতিটি শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি যেন একটাই কথা বলছিল – “ফিরে এসো বৃষ্টি, ফিরে এসো প্রাণ।” গ্রামের কুয়োগুলি শুকিয়ে গেছে, পাতাল থেকে জল তোলার প্রতিটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। নলকূপের হ্যান্ডেলগুলি জং ধরে পড়ে আছে, তাদের থেকে এক ফোঁটা জলও আর বের হয় না। পূর্বে যে খালটি গ্রামের প্রাণ ছিল, সেটি এখন শুকনো সাপের মতো পড়ে আছে, তার তলদেশে দেখা যাচ্ছে ফাটলযুক্ত কাদা। শিশুরা এখন আর খেলা করে না, তাদের ছোট শরীরগুলো কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছে, খেলার শক্তি নেই, কেবল চোখগুলোতে এক ভয়ানক শূন্যতা। তাদের পেটগুলো ফোলা, মুখে জ্বরের উষ্ণতা, আর তাদের কণ্ঠ থেকে হাসি আর খেলার শব্দ চিরতরে হারিয়ে গেছে। বুড়ো-বুড়িরা তাদের জীর্ণ কুটিরের কোণে বসে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, তাদের মুখে ছিল অজানা আশঙ্কার চিহ্ন। তাদের চোখের কোণে জমে থাকা জল শুকিয়ে যেত না, বরং যেন আরও বিষাদ বাড়াত। খাবারের জন্য যে অল্পকিছু শুকনো ফল আর শিকড় পাওয়া যেত, তাও দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল, প্রতিদিনের সংগ্রহ ছিল অনিশ্চিত। আশগ্রামের মানুষের জীবনে প্রতিটি দিন ছিল এক নতুন সংগ্রাম, এক নতুন পরীক্ষা। সূর্যের প্রতিটি নতুন উদয় যেন নতুন কোনো আশার বার্তা আনত না, বরং নিয়ে আসত আরও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার চাপ, যা তাদের শেষ জীবনীশক্তিও কেড়ে নিচ্ছিল।
গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ, জ্ঞানবৃদ্ধ দাদীমা, যিনি শত শত বছরের গল্প ও কিংবদন্তির জীবন্ত ভাণ্ডার, আজ তাঁর জীর্ণ কুটিরের বাইরে এলেন। তাঁর কাঁপা হাতে ধরা একটি প্রাচীন পুঁথি, যার পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে সময়ের ভারে, তার অক্ষরগুলো প্রায় অস্পষ্ট। পুঁথির পাতা থেকে যেন প্রাচীন ধূলোর গন্ধ ভেসে আসছিল, তাতে ছিল বহু শতাব্দী পুরোনো ইতিহাসের ঘ্রাণ। তাঁর কণ্ঠস্বর বয়সের ভারে দুর্বল হলেও, তাতে এক অদ্ভুত শক্তি ছিল, এক জাদু ছিল, যা আশগ্রামের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ল, প্রতিটি মরিয়া আত্মাকে স্পর্শ করল, যেন এক অদৃশ্য সুর তাদের হৃদয়ে বাজছে, এক নতুন আশার বীজ বপন করছে। “শুনো গ্রামবাসী,” তিনি বললেন, তাঁর চোখ দুটি যেন এক গভীর অতীতে হারিয়ে গেছে, যেখানে ড্রাগনরা বিচরণ করত, “এককালে যখন পৃথিবী ভয়ংকর দানবদের করায়ত্ত ছিল, যখন অশুভ শক্তি চারদিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরত, যখন মানুষ ছিল অসহায় ক্ষুদ্র প্রাণীর মতো, তখন ড্রাগনরাই ছিল আমাদের একমাত্র রক্ষাকর্তা। তারা পর্বতকে শাসন করত, তাদের বিশাল ডানা আকাশকে ঢেকে দিত, আর তাদের গর্জন মেঘমালাকে ডেকে আনত। তাদের অগ্নিশ্বাস শয়তানকে দূরে রাখত, আর তাদের চোখের জল ছিল বৃষ্টির ধারা। বৃষ্টি তাদের আশীর্বাদ ছিল, আর তাদের শক্তি ছিল এই পৃথিবীর ভারসাম্য। তারা শুধু শক্তির প্রতীক ছিল না, ছিল জ্ঞানের প্রতীক, প্রজ্ঞার প্রতীক। তারা ছিল পৃথিবীর আত্মা, প্রকৃতির প্রাণ। কিন্তু মানুষের লোভ আর লালসা তাদের পবিত্রতাকে কলুষিত করল। মানুষ স্বর্ণের প্রতি আকৃষ্ট হলো, ক্ষমতার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠল, তারা ড্রাগনদের জ্ঞান ও শক্তিকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার চাইল। তারা ড্রাগনদের কাছ থেকে শুধু ক্ষমতা চেয়েছিল, তাদের পবিত্রতা বা প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাকে ভুলে গিয়েছিল। এই বিশ্বাসঘাতকতা তাদের শান্তি ও ধৈর্য কেড়ে নিল। তারা ক্রুদ্ধ হয়ে এক এক করে অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন তারা কোনোদিন ছিলই না, কেবল কিংবদন্তিতে তাদের নাম রয়ে গেল। শুধু এক বিশাল, ঘুমন্ত ড্রাগন রয়ে গেল এই পর্বতের গভীরে। কিংবদন্তি বলে, তার কাছেই আছে শেষ ড্রাগন ডিম। সেই ডিমের শক্তিই কেবল আমাদের বাঁচাতে পারে, এই ভয়াবহ খরা থেকে মুক্তি দিতে পারে, পৃথিবীকে আবার প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে।”
দাদীমার কথা শুনে গ্রামের প্রতিটি মানুষের মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ড্রাগনের গুহা? অসাধ্য, দুর্গম। ড্রাগনের নাম শুনলেই তাদের মনে ভয় ও শ্রদ্ধার এক মিশ্র অনুভূতি জেগে উঠত। তাদের মনে পড়ে গেল সেইসব সাহসী যোদ্ধা, সেইসব ধন-সম্পদের লোভী বণিকদের কথা, যারা সেই গুহার পথে পা বাড়িয়েছিল। তাদের কেউ ফিরে আসেনি। তাদের ব্যর্থতার গল্প আশগ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই শোনা যেত, প্রতিটি মায়ের মুখে তার শিশুকে ভয় দেখানোর গল্পে ড্রাগনের গুহার নাম উচ্চারিত হতো। কেউ হয়তো ড্রাগনের ক্রোধের শিকার হয়েছিল, তাদের শরীরগুলো পাথরে পরিণত হয়েছিল। কেউ হয়তো গুহার রহস্যময় গভীরে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল, তাদের আর্তনাদ এখনো বাতাসের সাথে ভেসে আসে বলে শোনা যেত। তাদের ছিন্নভিন্ন বর্ম, তাদের হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রের গল্পগুলি বাতাসের সাথে ভেসে বেড়াত, যা আশগ্রামের মানুষের মনে নতুন করে ভয়ের সৃষ্টি করত। তবে, দাদীমার কণ্ঠে একটি চাপা সতর্কবাণী ছিল, যা গ্রামের সবাই বুঝতে পারছিল – ডিমের শক্তিকে যদি ভুল হাতে ব্যবহার করা হয়, তবে তা আশগ্রামকে চিরতরে ধ্বংস করে দেবে। এই সতর্কবাণী বাতাসের সাথে মিশে এক গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করল, আয়ানের মনেও এক চাপা ভয় তৈরি হলো – সে কি পারবে এই বিশাল দায়িত্ব বহন করতে? দাদীমার চোখ দুটি যেন তার ভেতরের প্রতিচ্ছবি দেখছিল, আর সেই প্রতিচ্ছবিতে ছিল এক অজানা পরীক্ষার ইঙ্গিত। এক ঝলকের জন্য তার বৃদ্ধ মুখটি যেন এক প্রাচীন ড্রাগনের মুখচ্ছবিতে পরিণত হলো, তার চোখে জ্বলজ্বল করছিল এক অজানা রহস্যের দীপ্তি, কিন্তু পরক্ষণেই তা মিলিয়ে গেল, যেন আয়ানেরই মনের ভুল।
আয়ানের বুকটা দ্রুত স্পন্দিত হতে শুরু করল। সে কোনো যোদ্ধা ছিল না। তলোয়ারের ঝনঝনানি বা বর্মের ওজন তার কাছে অপরিচিত ছিল, সে কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে পা রাখেনি। তার হাত দুটো লাঙল ধরায় অভ্যস্ত ছিল, জমি কর্ষণে আর বীজ বোনাতেই ছিল তার একমাত্র দক্ষতা। তার শরীর ছিল ক্ষীণ, মাসল বলতে কিছুই ছিল না, কেবল কৃষিকাজের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে তার শরীর কঠোর হয়েছিল। কিন্তু তার চোখের সামনে ভেসে উঠল তার ছোট বোন রিয়ার মুখটা। রিয়া, যার উজ্জ্বল চোখগুলো একসময় হাসি আর কৌতূহলে ভরা থাকত, প্রজাপতির পেছনে ছুটত, এখন খাদ্যের অভাবে সেই চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে, তার শরীরটা শুকিয়ে কাঠি হয়ে যাচ্ছে, তার কণ্ঠ থেকে হাসি আর খেলার শব্দ চিরতরে হারিয়ে গেছে। রিয়ার মুখে একফোঁটা হাসি ফোটানোর জন্য সে নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। গ্রামের অন্যান্য শিশুদের মতো রিয়াও প্রতিদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, তাদের ভবিষ্যৎ যেন এক কালো অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আয়ানের মনে হলো, তার বোনের জীবন যদি সে বাঁচাতে না পারে, তবে তার নিজের জীবনের কোনো অর্থ নেই। তার ভেতরের এক দুর্বল কৃষক নয়, বরং এক অদম্য ভাইয়ের আত্মা জেগে উঠল। আয়ান আর স্থির থাকতে পারল না। তার বুক চিড়ে এক অদম্য সংকল্প বেরিয়ে এল। তার কণ্ঠস্বর ছিল দৃঢ়, যা তার ক্ষীণ শারীরিক গড়নের সঙ্গে বেমানান মনে হলো, কিন্তু তাতে ছিল এক অদম্য শক্তি, এক নতুন আশার অগ্নিশিখা। “আমি যাবো দাদীমা,” সে বলল, তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিল এক নতুন আশায়, “আমিই যাবো শেষ ড্রাগন ডিম আনতে।”
আয়ানের কথা শুনে গ্রামের মানুষ হতবাক হয়ে গেল। এই সাধারণ, নিরীহ ছেলেটি, যার সাহস নিয়ে কখনো কেউ তেমন কথা বলেনি, সে এমন এক ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা করছে! দাদীমা আয়ানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তার চোখে ছিল এক গভীর উপলব্ধি, এক প্রাচীন জ্ঞান। তিনি আয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে যেন তার ভেতরের পবিত্রতাকে দেখতে পেলেন। “আয়ানের ছেলে,” তিনি ধীরে ধীরে বললেন, তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত পবিত্রতা, “এই পথ শুধু বলের পথ নয়, এই পথ জ্ঞানের, এই পথ ধৈর্যের, আর সর্বোপরি, এই পথ হৃদয়ের। ড্রাগনের শক্তি শুধু ধ্বংস করতে পারে না, তা সৃষ্টিও করতে পারে। যারা লোভ নিয়ে যায়, তারা কেবল ধ্বংস দেখে। তাদের মন অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। যারা বিশুদ্ধ হৃদয় নিয়ে যায়, যারা নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করতে পারে, তারাই প্রকৃত শক্তি লাভ করে, তারাই আলো দেখে।” দাদীমার কথাগুলো আয়ানের কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল – ‘বলের পথ নয়, মনের পথ’। এই কথাগুলো যেন তার হৃদয়ে গেঁথে গেল, তার যাত্রার একমাত্র পাথেয় হয়ে দাঁড়াল, যা তাকে প্রতিটি বিপদে শক্তি যোগাবে।
গ্রামের প্রায় প্রতিটি শিশুই যখন ক্ষুধার্ত আর অসুস্থ, তখন তাদের পাশে এসে দাঁড়াত নিলিমা। আয়ানেরই সমবয়সী, কিন্তু তার মুখে ছিল বয়সের চেয়েও বেশি পরিপক্কতার ছাপ। নিলিমা ছিল গ্রামের একমাত্র ভরসা, সে প্রকৃতির কাছ থেকে শেখা গাছগাছড়ার গুণে রোগ সারাতে পারত, যা প্রাচীনকালের প্রথা। গ্রামের মানুষরা তাকে ‘বন-কন্যা’ বলে ডাকত, কারণ তার চোখ ছিল বনের মতোই সবুজ আর গভীর। তার পোশাক ছিল সাধারণ, কিন্তু তার চুল ছিল আলগা, বন্য, আর তাতে মাঝে মাঝেই শুকনো পাতা বা ছোট ফুল লেগে থাকত, যেন সে নিজেই বনেরই অংশ। তার হাতগুলো ছিল নরম, কিন্তু তাতে ছিল এক অদ্ভুত নিরাময় শক্তি, যা তার হাতের ছোঁয়ায় রোগীদের বেদনা উপশম করত।
নিলিমা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামের অসুস্থ শিশুদের দেখাশোনা করত। রিয়ার কপালে তার নরম হাতের ছোঁয়া প্রতিদিনের জ্বর কমিয়ে দিত, তার মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করত, যা আয়ানের হৃদয়ে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিত। রিয়া যখন ভয় পেত, তখন নিলিমা তাকে গান শোনাতো, যা রিয়ার চোখে ঘুম এনে দিত, আর সে তখন কিছুটা সময়ের জন্য হলেও তার কষ্ট ভুলে যেত। নিলিমা নিজেই খাবার জোটানোর জন্য সংগ্রাম করত, কিন্তু তবুও তার নিজের অল্প খাবারটিও সে রিয়ার মুখে তুলে দিত, তার চোখ দুটি ছিল করুণায় ভরা।
আয়ানের প্রতি নীলিমার ছিল এক গভীর বিশ্বাস, এক অদ্ভুত সংযোগ। তারা দুজনেই গ্রামের এই ভয়াবহ দশায় ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু একে অপরের চোখের দিকে তাকালে যেন এক নতুন আশা খুঁজে পেত। নীলিমা জানত, আয়ানের হৃদয়ে কতটা অদম্য সংকল্প লুকিয়ে আছে। সে আয়ানের সিদ্ধান্ত শুনে প্রথমে ভয় পেয়েছিল, তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল, তার মনে হয়েছিল সে তাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু আয়ানের চোখের দৃঢ়তা দেখে সে বুঝতে পারল, তাকে আটকানোর কোনো উপায় নেই।
আয়ান যখন পরের দিন সকালে যাত্রা শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন নিলিমা তার কাছে এলো। তার চোখে ছিল গভীর উদ্বেগ, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত ও দৃঢ়। “তুমি ফিরবেই, আয়ান,” সে বলল, তার হাতে ছিল একটি ছোট, শুকনো গোলাপের পাপড়ি। “এই পাপড়িটি তোমার কাছে রেখো। এটি সেই শেষ গোলাপ যা আমাদের গ্রামের বাগানে ফুটেছিল, তারপর থেকে আর কোনো গোলাপ ফোটেনি। এটি আমাদের শেষ আশা। তুমি যখন ক্লান্ত হবে, যখন পথ হারাবে, তখন এই পাপড়ি তোমাকে পথ দেখাবে। মনে রেখো, আমাদের সবার জীবন তোমার হাতে।” নীলিমার চোখে ছিল এক বিশুদ্ধ ভালোবাসা আর এক অদম্য বিশ্বাস, যা আয়ানের মনে এক নতুন শক্তি যোগাল। আয়ান পাপড়িটি তার পকেটে রাখল, তার হৃদয়ে নীলিমার বিশ্বাস আর রিয়ার ম্লান মুখ তাকে অদম্য করে তুলল। কিন্তু নীলিমার চোখে এক অজানা ভয় ছিল, যা সে আড়াল করার চেষ্টা করছিল। তার কণ্ঠস্বরে যেন এক চাপা আর্তনাদ লুকিয়ে ছিল, যা আয়ানের অজানা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিচ্ছিল। “সাবধানে থেকো, আয়ান,” তার শেষ ফিসফিসানি আয়ানের কানে বাজল, “পথটা খুব কঠিন। ফিরে আসার আগে নিজেকেও চিনতে পারবে না। সেখানে এমন কিছু আছে যা তোমার সাহসকে পরীক্ষা করবে, যা তোমার মনকে ভুলিয়ে দিতে চাইবে। তুমি নিজেকে বিশ্বাস করো, আর তোমার হৃদয়কে। কিন্তু মনে রেখো, আলো যত তীব্র হবে, ছায়াও তত গাঢ় হবে।”
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion