Episode 21431 words0 views

ঘুমন্ত ড্রাগনের শেষ ডিম : দ্বিতীয় পর্ব

অরণ্যের অভিশপ্ত পথ আয়ানের যাত্রা শুরু হলো পরের দিন ভোরে, যখন প্রথম সূর্যের আলো পূর্বের আকাশকে কমলা রঙে রাঙিয়ে তুলছিল। গ্রাম তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন, কেবল কিছু পাখি কিচিরমিচির করছিল। সে সামান্য জল আর কিছু শুকনো রুটি নিয়েছিল, যা হয়তো তার পুরো যাত্রার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তার পরনে ছিল সাধারণ কৃষক পোশাক, যা তার দীর্ঘ যাত্রায় কোনো সুরক্ষা দিতে পারতো না, কেবল তার ত্বককে সূর্য থেকে রক্ষা করছিল। গ্রাম থেকে বেরোনোর সময় গ্রামের মানুষরা তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়েছিল। কেউ কেউ ক্ষীণ কণ্ঠে সাহস জুগিয়েছিল, কেউ কেউ আশা হারিয়ে ফেলেছিল, তাদের চোখে ছিল বিদায়ের বিষণ্ণতা। আয়ানের কানে আসছিল তাদের ফিসফাস: “সে কি ফিরে আসবে?” “এ তো আত্মহত্যার সমান!” কিন্তু আয়ান সেসব কথায় কান দিল না। আশগ্রামের ধূসর পথ পেরিয়ে সে হাঁটতে শুরু করল। তার পেছনে পড়ে রইল শুকিয়ে যাওয়া মাঠ, নিস্তব্ধ গ্রাম আর রিয়ার ম্লান মুখ, আর তার সাথে নীলিমার শান্ত, ভরসা ভরা চোখ, যা তাকে প্রতিনিয়ত তাগিদ দিচ্ছিল এগিয়ে যাওয়ার। প্রথম কয়েকদিন সে বনপথে হেঁটে চলল। যে বন একসময় সবুজে ছাওয়া ছিল, পাখির কলরবে মুখরিত থাকত, তা এখন কেবল কাঁটাঝোপ আর মরা গাছপালা দিয়ে ঢাকা। গাছের পাতাগুলো শুকিয়ে খসখসে হয়ে গেছে, তাদের স্পর্শে এক কর্কশ শব্দ হতো, যেন প্রকৃতিরই এক প্রতিবাদ, এক দীর্ঘশ্বাস। তাদের ফাটল থেকে মশা ও ছোট পোকামাকড় বের হয়ে আসছে, যা তার পথের সঙ্গী। বুনো পশুরা খাবারের সন্ধানে ক্লান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের চোখেও সেই একই হতাশা, তারা যেন তাদের শেষ নিঃশ্বাস ফেলছে। একটি হরিণকে সে দেখতে পেল, তার চোখ দুটি নিস্তেজ, চামড়া হাড়ের সাথে লেগে গেছে, সে যেন ধুঁকে ধুঁকে মরছে। হরিণটি একবার আয়ানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেন তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করল। আয়ানের বুট পরা পাগুলো শুকনো পাতা আর কাঁটাঝোপের উপর দিয়ে যেতে গিয়ে অনেকবারই ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল, রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছিল। সে প্রতিটি পদক্ষেপে অনুভব করছিল মাটির রুক্ষতা, তার পায়ের নিচে কড়মড় শব্দ হতো শুকনো পাতার। সূর্যের তীব্র তাপ তার মাথার ওপর ঝলসে উঠছিল, আর বাতাস ছিল গরম। তার শুকনো রুটিগুলো যেন গলায় আটকে যাচ্ছিল, আর জলপাত্রের জল ফুরিয়ে আসছিল দ্রুত। প্রতিটি পদক্ষেপেই আয়ানের মনে হচ্ছিল, এই বুঝি তার শেষ। ক্ষুধার জ্বালা আর তৃষ্ণার্ত গলা তাকে প্রতি মুহূর্তে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছিল। সে অনুভব করছিল যেন এক অদৃশ্য ভার তার কাঁধের উপর চেপে বসেছে, আর তার পেছনে রিয়ার ম্লান মুখ তাকে তাড়া করছিল, এক ভয়ংকর স্বপ্ন হয়ে। কিন্তু তার মনের ভেতরের সংকল্প তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। রিয়ার মুখ, গ্রামের মানুষের নিস্তব্ধ হাহাকার, তাকে থামতে দিচ্ছিল না। তার হৃদয় জুড়ে ছিল আশগ্রামকে বাঁচানোর এক অদম্য ইচ্ছে, যা তাকে প্রতিটি মুহূর্তে শক্তি যোগাচ্ছিল। ধীরে ধীরে বন আরও ঘন হতে শুরু করল। পুরোনো, বিশাল গাছগুলো যেন একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে, তাদের ডালপালাগুলো অদ্ভুতভাবে বেঁকে গেছে, যেন শত শত বছরের গল্প বলছে, তাদের কালো ছায়া পথকে আরও রহস্যময় করে তুলছিল। বাতাস আরও ঠান্ডা হতে লাগল, আর বনের গভীরে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল, যা আয়ানের মনে এক অজানা ভয় সৃষ্টি করছিল। এই নীরবতা ছিল না পাখির কলরবহীনতা, বরং যেন এক মৃত্যুপুরীর নিশ্চুপতা। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, সেই নীরবতা ভেদ করে অস্পষ্ট ফিসফিস শব্দ ভেসে আসছে, যেন অসংখ্য অদৃশ্য কণ্ঠস্বর তাকে ঘিরে ধরেছে, তার নাম ধরে ডাকছে। মনে হচ্ছিল, সেই কণ্ঠস্বরগুলো বিগত যুগের শিকারীদের আত্মা, যারা ড্রাগনের গুহায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিল এবং এই পথেই তাদের শেষ হয়েছিল। তারা আয়ানকে থামিয়ে দিতে চাইছে, তাকেও তাদের মতো এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। আয়ান জানত না ড্রাগনের গুহা কোথায়, কেবল পুরোনো কিংবদন্তি আর দিকনির্দেশনার অস্পষ্ট গল্প ছিল তার ভরসা। তার পুঁথিতে উল্লেখ করা ছিল “সূর্যের প্রথম আলো যেখানে পর্বত চূড়ায় চুম্বন করে, সেখানেই ড্রাগনের ঘুমন্ত নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।” সে সেই অস্পষ্ট সূত্র ধরেই এগোতে লাগল, তার চোখ দুটি ছিল সামনের দিকে স্থির। একসময় সে বনের এমন এক অংশে পৌঁছাল, যা ‘ফিসফিসিয়ে ওঠার জঙ্গল’ নামে পরিচিত ছিল। এখানে গাছগুলো এতটাই ঘন ছিল যে সূর্যের আলো প্রায় প্রবেশ করত না, কেবল কিছু আবছা রশ্মি মাটিতে পড়ত। মাটির নিচে লুকিয়ে ছিল কাদা ও পচা পাতার এক স্তূপ, যেখানে মাঝে মাঝেই তার পা গভীরে ডুবে যেত। এই কাদা মাড়িয়ে এগোতে গিয়ে সে কয়েকবার ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল, তার পোশাক কাদায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। বনের ভেতরে অদ্ভুত ফিসফিস শব্দ শোনা যেত, যেন গাছগুলো একে অপরের সাথে কথা বলছে, বা কোনো অশরীরী আত্মা তার কানে কানে কিছু বলছে। এই শব্দগুলো আয়ানের মনে এক অজানা ভয় সৃষ্টি করছিল, সে বারবার চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা। মাঝে মাঝে সে অদ্ভুত ছায়া দেখতে পেত, যা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেত। বনের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল এক পচা গন্ধ আর শ্যাওলার আর্দ্রতায়, যা তার নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন করে তুলছিল। তার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে স্পর্শ করছে। সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল, দ্রুত এই জঙ্গল থেকে বের হতে পারলে সে যেন প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু গভীর রাতে, যখন চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকাতো, তখন সেই ফিসফিসানি আরও তীব্র হতো। মনে হতো, অদৃশ্য হাত তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে গভীর জঙ্গলের আরও গভীরে, যেখানে সূর্যের আলো কোনোদিন পৌঁছায় না। তার ঘুম ভেঙে যেত এক অজানা আতঙ্কে, আর সে বুঝতে পারত না, সে স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তব। একবার সে একটি গাছের মরা ডাল ধরেছিল, কিন্তু মনে হলো যেন সেই ডালটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে, আর তার আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরে তাকে নিচে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। সেই রাতে, সে তার স্বপ্নের মধ্যে এক ভয়ংকর মুখোশ পরা সত্তাকে দেখেছিল, যার চোখ দুটি ছিল আগুনের মতো লাল, আর সে ফিসফিস করে বলছিল, “তুমি কি জানো, কাকে তুমি বিশ্বাস করছো? কে তোমাকে পথ দেখাচ্ছে? তোমার গ্রামের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, আর তুমি কেবল এক পুতুল।” এর পরপরই সে এক গভীর জলাভূমির পাশে চলে গিয়েছিল, যার কালো জল থেকে এক তীব্র দুর্গন্ধ আসছিল, মনে হচ্ছিল যেন পচা মাংসের গন্ধ। দাদীমার পুঁথিতে এর নাম ‘বিষাক্ত মর্শ’ লেখা ছিল, যেখানে একবার পা পিছলে গেলে আর ফেরা যায় না, তার কালো জল নাকি জীবনের সমস্ত শক্তি শুষে নেয়। জলাভূমির ওপর দিয়ে হালকা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছিল, যা পরিবেশকে আরও রহস্যময় করে তুলেছিল। সে সাবধানে একটি মরা গাছের ডাল ধরে এগিয়ে গেল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত সতর্ক। জলাভূমির গভীরে সে অদ্ভুত কিছু প্রাণীর চলাচলের শব্দ শুনতে পেল, মনে হলো কোনো বিশাল সরীসৃপ জলে সাঁতরাচ্ছে। জলের নিচ থেকে অদ্ভুত চোখের মতো কিছু ঝলক দিচ্ছিল, যেন কোনো প্রাচীন, ক্ষুধার্ত প্রাণী তার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ানের মনে হলো, এই জল কোনো জীবের প্রাণ নেয় না, বরং তাদেরকে তার গভীরে আটকে রাখে, তাদের আত্মাকে গ্রাস করে। সে যেন অনুভব করছিল শত শত বছরের আটকে থাকা আত্মার আর্তনাদ, যা জলের গভীরে চাপা পড়ে আছে। তার শুকনো রুটিগুলো পচে গিয়েছিল এই স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে, আর তার কাছে জলও ছিল না। ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তার মন দুর্বল হয়ে পড়ছিল। কয়েকবার সে মনে করল, জলের গভীর থেকে তার নাম ধরে কেউ ডাকছে, আর তাদের কণ্ঠস্বর এতটাই লোভনীয় ছিল যে সে প্রায় জলের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। প্রতিটি মুহূর্তেই তার মনে হচ্ছিল, সে বুঝি এই বিষাক্ত মর্শের গভীরে চিরতরে হারিয়ে যাবে, তার আত্মাও অন্য দুর্ভাগাদের মতো এর অংশ হয়ে যাবে। সে একটি ছোট, উজ্জ্বল মাছ দেখতে পেল, যা জলের মধ্যে ঝলমল করছিল। সে সেটিকে ধরতে হাত বাড়াতেই, মাছটি দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল, আর তার হাত থেকে একটি তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল, মনে হলো যেন অদৃশ্য দাঁত তার ত্বকে বিঁধে গেছে। তার পায়ের নিচে কাদার ভেতর থেকে পচা হাড়ের মতো কিছু বেরিয়ে আসছিল, যা তার মনে এক ভয়ংকর দৃশ্য তৈরি করছিল। এক রাতে, যখন সে একটি বিশাল গাছের গুঁড়ির নিচে আশ্রয় নিয়েছিল, তখন একদল ক্ষুধার্ত বুনো নেকড়ে তাকে ঘিরে ফেলল। তাদের চোখগুলো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল, যেন জ্বলন্ত অঙ্গার। তাদের মুখ থেকে তীব্র গর্জন বেরোচ্ছিল, যা বনের নীরবতাকে ভেঙে দিচ্ছিল। আয়ানের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না, তার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল নিজেকে বাঁচানো। সে দ্রুত একটি ভাঙা গাছের ডাল তুলে নিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করল, তার হৃদয় দ্রুত গতিতে ধুকধুক করছিল। নেকড়েগুলো হিংস্রভাবে তার দিকে এগিয়ে আসছিল, তাদের ধারালো দাঁতগুলো অন্ধকারে চকচক করছিল। আয়ান পিছু হটতে হটতে গাছের গুঁড়ির সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল, তার মনে হচ্ছিল তার প্রতিটি নিশ্বাসই তার শেষ নিশ্বাস। একটি নেকড়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার ধারালো থাবা আয়ানের গাল ছুঁয়ে গেল, তীব্র জ্বালায় আয়ান চিৎকার করে উঠল। তার চোখের সামনে রিয়ার মুখটা ভেসে উঠল, তার মনে হলো সে তার বোনের জন্য আর কিছু করতে পারবে না। ঠিক তখনই, দূরে একটা তীব্র আলো জ্বলে উঠল এবং নেকড়েগুলো আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে গেল। আয়ান অবাক হয়ে দেখল, তার হাতের শিকড়গুলো মৃদুভাবে জ্বলছে, যা বৃদ্ধ পথিক তাকে দিয়েছিলেন। এটি ছিল সেই অদৃশ্য প্রাচীর, যা হিংস্রতাকে দূরে সরিয়ে দিল, যেন তার ভেতরের পবিত্রতাই তাকে রক্ষা করল। সে বুঝতে পারল, পথিকের দেওয়া প্রতিটি জিনিসই কোনো না কোনো কাজে আসবে, সেগুলো শুধু সাধারণ জিনিস নয়। তবে, নেকড়েগুলো পালিয়ে যাওয়ার পরেও আয়ান একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেল, যা গাছের আড়ালে দ্রুত মিলিয়ে গেল। সে নিশ্চিত ছিল না, এটা তার চোখের ভুল নাকি সত্যিই কেউ তাকে অনুসরণ করছিল। তার মনে এক চাপা ভয় আর অনিশ্চয়তা জেঁকে বসল। সেই রাতে, সে তার পকেটে থাকা নীলিমার শুকনো গোলাপের পাপড়িটি হাতে নিয়েছিল। মনে হলো, পাপড়িটি মৃদুভাবে কাঁপছে, আর তার থেকে এক ঠান্ডা অনুভূতি তার হাতে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন পাপড়িটিও তাকে কোনো অজানা বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করছে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion