Episode 101432 words1 views

দশম অধ্যায়: দ্বন্দ্ব, পরিবর্তন ও পুনর্মিলন

অদিতির সাথে লাঞ্চের আগের রাতটা ছিল দীর্ঘ এবং অস্থির। অরুণ বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল, কিন্তু ঘুম আসছিল না। পাশে রিয়াও জেগে আছে, সেটা সে তার শান্ত, নিয়মিত নিঃশ্বাসের অনুপস্থিতি দেখেই বুঝতে পারছিল। কিন্তু কেউই নীরবতা ভাঙার চেষ্টা করছিল না। অরুণের মনে হচ্ছিল, এই নীরবতা যেন তাদের দুজনের মাঝখানে এক অস্বস্তিকর দেওয়াল তুলে দিয়েছে। তার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। সে জানত, সে রিয়াকে ভালোবাসে, এই জীবনটাকেই সে বেছে নিয়েছে। কিন্তু তার মনের গভীরে, সেই দশ বছর আগের পরাজিত 'অরুণ'-এর ভূতটা যেন আবার জেগে উঠছিল। অদিতি শুধু একজন মহিলা নয়, সে ছিল একটা প্রতীক—সেই পৃথিবীর প্রতীক, যে পৃথিবী তাকে একদিন প্রত্যাখ্যান করেছিল, আবার সেই পৃথিবীই তাকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। অদিতির প্রস্তাবটা শুধু একটা চাকরির প্রস্তাব নয়, এটা ছিল তার পুরোনো 'আমি'-কে প্রমাণ করার একটা শেষ সুযোগ। সে কি সত্যিই সেই জগৎটাকে পুরোপুরি পেছনে ফেলতে পেরেছে? নাকি তার মনের কোনো এক কোণে এখনও সেই গ্ল্যামার, সেই ক্ষমতার জন্য একটা সূক্ষ্ম আকর্ষণ রয়ে গেছে? ভোরবেলায়, যখন গঙ্গার ওপর প্রথম আলো এসে পড়েছে, তখন রিয়া তার দিকে ফিরল। "ঘুম আসছে না?" অরুণ বলল, "না।" রিয়া তার হাতটা ধরল। "কী ভাবছ এত?" অরুণ বলল, "ভাবছি, আমি কি সত্যিই বদলেছি, রিয়া? নাকি আমি শুধু পালানোর চেষ্টা করছি?" রিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর শান্ত গলায় বলল, "পালানো আর বেছে নেওয়ার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে, অরুণ। তুমি পালিয়ে আসোনি, তুমি এই জীবনটাকে জেনে-বুঝে বেছে নিয়েছো। লন্ডনের জীবনটা ছিল তোমার জেদ, আর কলকাতার জীবনটা হলো তোমার ভালোবাসা। আজ লাঞ্চে গিয়ে শুধু এটা মনে রেখো যে কোনটা তোমাকে শান্তি দেয়।" রিয়ার এই সহজ কথাগুলো অরুণের মনের ভেতরের সমস্ত ঝড় থামিয়ে দিল। সে বুঝতে পারল, তার শক্তি রিয়াই। সকালে সে যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন তার বাবা, অনিরুদ্ধবাবু, তার ঘরে এলেন। "অদিতির সাথে দেখা করতে যাচ্ছিস শুনলাম।" অরুণ অবাক হলো। "মা বলেছে বুঝি?" "হ্যাঁ। আমি জানি, আমি তোকে সারাজীবন সাফল্যের জন্য চাপ দিয়েছি। কিন্তু এখন বুঝি, সাফল্যের চেয়ে শান্তি বড়। যা করবি, ভেবে করিস। তোর মুখের হাসিটা যেন হারিয়ে না যায়।" বাবার মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার জন্য অরুণ হয়তো সারাজীবন অপেক্ষা করেছিল। সে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। অনিরুদ্ধবাবু তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। অরুণ অনুভব করল, তার কাঁধ থেকে কয়েক দশকের একটা ভারী বোঝা নেমে গেল। পার্ক স্ট্রিটের সেই অভিজাত রেস্তোরাঁটা ছিল কর্পোরেট জগতের এক প্রতিচ্ছবি। শীতল, পরিশীলিত এবং আবেগহীন। অদিতি আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। তাকে আগের দিনের চেয়েও বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল। কিছুক্ষণ সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর অদিতি সরাসরি প্রসঙ্গে এলো। "অরুণ, আমি কলকাতায় আমাদের কোম্পানির এশিয়া হেডকোয়ার্টার তৈরি করছি। I need a country head. Someone I can trust. Someone with a global vision. Someone like you." সে একটা ফাইল অরুণের দিকে এগিয়ে দিল। "This is the offer. The pay will be triple what you get now. You'll have complete autonomy. We'll be working together, building something huge. Just like we once dreamed." অরুণ ফাইলটা খুলল না। সে শান্তভাবে বলল, "আমার উত্তরের জন্য তোমার এই ফাইলটার দরকার নেই, অদিতি। আমার উত্তর হলো 'না'।" অদিতি হাসল। "Don't be so hasty, Arun. I know you. I know that brilliant mind of yours. তুমি কি সত্যিই এই ছোট পুকুরে সাঁতার কেটে সুখী? Don't you miss the ocean? The challenge, the fight?" অদিতি এবার একটু ঝুঁকে এসে বলল, "Happy? Or comfortable? You're a lion, Arun, living in a sheep's pen. This city, this life... it's too small for you. Don't you see you're wasting your talent?" তার গলার স্বরে ছিল এক সূক্ষ্ম খোঁচা। "A simple life with an academic wife is lovely, I'm sure. But it doesn't challenge you. It doesn't make you grow." অদিতির এই কথাগুলো অরুণকে আর আঘাত করল না। সে শান্তভাবে হাসল। "তুমি ঠিকই বলেছো, অদিতি। আমি কমফোর্টেবল। আমি সুখী। আর এই কমফোর্ট অর্জন করতে আমাকে দশ বছর ধরে একাকীত্বের সাথে লড়াই করতে হয়েছে।" সে একটু থামল, তারপর বলতে শুরু করল। তার গলাটা ছিল শান্ত, কিন্তু প্রত্যেকটা শব্দ ছিল ইস্পাতের মতো দৃঢ়। "তুমি আর আমি দুজনেই সাম্রাজ্য গড়তে চেয়েছিলাম। তুমি তোমারটা গড়েছো। কিন্তু আমি লন্ডনে গিয়ে বুঝেছি, আমি ভুল সাম্রাজ্যের পেছনে ছুটছিলাম। তুমি যা গড়ো, তা হলো কাঁচ আর স্টিলের স্কাইস্ক্রেপার—বাইরে থেকে দেখতে খুব সুন্দর, কিন্তু ভেতরটা ঠান্ডা আর ফাঁকা। আর আমি এখন একটা বাড়ি গড়তে শিখেছি, রিয়াকে সাথে নিয়ে। সেই বাড়ির দেওয়ালগুলো বিশ্বাসের, আর জানালাগুলো দিয়ে গঙ্গার হাওয়া আসে। সেটা হয়তো তোমার স্কাইস্ক্রেপারের মতো উঁচু নয়, কিন্তু তার ভেতরে আলো আছে, উষ্ণতা আছে।" অরুণ অদিতির চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। "তুমি যেটাকে 'waste of talent' বলছ, সেটাকে আমি বলি 'investment in happiness'। তুমি যেটাকে 'small pond' বলছ, সেটা আমার কাছে 'ocean of peace'। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কোনো প্রমোশন বা বোনাস নয়, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো কাজ শেষে বাড়ি ফিরে রিয়ার মুখের হাসিটা দেখা। আর আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমার মেয়েকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে বড় করে তোলা।" সে শেষবারের মতো বলল, "আমার জীবনে আর কোনো 'vacancy' নেই, অদিতি। না আমার কোম্পানিতে, না আমার মনে।" অদিতির আত্মবিশ্বাসী মুখটা প্রথমবার বিবর্ণ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, সে হেরে গেছে। এমন এক যুক্তির কাছে হেরে গেছে, যা তার হিসেবের খাতায় লেখা নেই। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে অরুণের নিজেকে খুব হালকা লাগছিল। সে ট্যাক্সি না নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তার মনে হলো, সে যেন আজ সত্যিই তার অতীতের ভূতটাকে বিসর্জন দিয়ে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে সে মধ্য কলকাতার এক ব্যস্ত এলাকায় এসে পড়ল। একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখল, কিছু শ্রমিক ট্রাক থেকে মাল নামাচ্ছে, আর তাদের নির্দেশ দিচ্ছে এক পরিচিত মুখ—সৌরভ। সৌরভও তাকে দেখতে পেয়েছিল। সে প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও, পরে এগিয়ে এল। তার চেহারায় সেই পুরোনো দাদাগিরির ভাবটা আর নেই, আছে এক ধরনের কঠোর পরিশ্রমের ছাপ। "অরুণদা? আপনি এখানে?" অরুণ হাসল। "হ্যাঁ, একটা কাজে এসেছিলাম। তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?" সৌরভ একটু লজ্জিত হয়ে বলল, "চলে যাচ্ছে, অরুণদা। বাবার মৃত্যুর পর সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। এখন বুঝি, জীবনটা কত কঠিন।" সে একটু থেমে বলল, "অরুণদা, আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। সেদিন পুজোর সময় আপনার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। আসলে, আমি রিয়াকে ভালোবাসতাম, আর আপনাকে দেখে হিংসে হয়েছিল। আমি হেরে যাওয়ার ভয় পেতাম।" অরুণ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, "যা হয়ে গেছে, তা ভুলে যাও। তুমি এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছ, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। জীবন সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়।" তারা দুজনে একসাথে রাস্তার ধারের দোকানে দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খেল। সেই চায়ের মধ্যে কোনো আভিজাত্য ছিল না, কিন্তু ছিল এক আন্তরিকতার স্বাদ। অরুণ দেখল, সৌরভ এখন এক অন্য মানুষ—অনেক বেশি পরিণত, অনেক বেশি দায়িত্বশীল। তাদের পুরোনো তিক্ততাটা ধুয়ে গিয়ে এক নতুন, অপ্রত্যাশিত বন্ধুত্বের সূচনা হলো। অনেক রাতে যখন অরুণ বাড়ি ফিরল, তখন গোটা বাড়িটা ঘুমে আচ্ছন্ন। সে দেখল, রিয়া তাদের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার জন্য অপেক্ষা করছিল। রিয়ার মুখে কোনো প্রশ্ন ছিল না, ছিল শুধু অপেক্ষা। অরুণ তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল এবং তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। "দেখা করেছিলাম," সে রিয়ার কানে কানে বলল। রিয়া তার হাতের ওপর নিজের হাত রাখল। "আমি জানি।" "আমি ওকে বলেছি," অরুণ বলে চলল, "যে তুমি আমার আশ্রয়, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।" সে পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করল। "রাস্তায় আসতে আসতে এটা কিনলাম।" রিয়া বাক্সটা খুলে দেখল, ভেতরে একজোড়া রুপোর মল। খুব সাধারণ, কিন্তু অপূর্ব সুন্দর। অরুণ রিয়ার পায়ের কাছে বসে, নিজের হাতে তাকে মল দুটো পরিয়ে দিল। তারপর তার পায়ে আলতো করে চুমু খেল। রিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে অরুণকে টেনে তুলে তার বুকে মাথা রাখল। "এত ভালোবাসো কেন আমায়?" অরুণ তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, "কারণ তুমি ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব নেই, রিয়া।" সেই রাতে, গঙ্গার ওপর চাঁদের আলোয়, তারা দুজনে অনেকক্ষণ ধরে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা হলো না, শুধু দুটি হৃদয়ের নিঃশব্দ কথোপকথন চলল। অতীতের সমস্ত ঝড় থেমে গিয়ে তাদের ভালোবাসার নৌকা আবার শান্ত নদীতে এসে ভিড়েছিল, যেখান থেকে শুরু হবে এক নতুন, আরও সুন্দর যাত্রা। সময়: শনিবার, ১২ই অক্টোবর, ২০৩০। পাঁচ বছর পর। সেই একই উত্তরপাড়া চ্যাটার্জী বাড়ির মণ্ডপ। অষ্টমীর সকাল। অরুণ আর রিয়া তাদের চার বছরের মেয়ে শারদীয়াকে নিয়ে অঞ্জলি দিতে এসেছে। তার পরনে একটা ছোট্ট লাল রঙের শাড়ি, আর তার কচি হাতে ধরা পূজার ফুল। অঞ্জলি শেষে অরুণ দেখল, রিয়ার চোখে জল। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?" রিয়া হেসে বলল, "কিছু না। পুরোনো কথা মনে পড়ছে। ঠিক এই জায়গায়, এই অষ্টমীর সকালেই তো আমাদের গল্পের শুরু হয়েছিল। আজ আমাদের মেয়েকে নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে, বৃত্তটা যেন সম্পূর্ণ হলো।" অরুণ শারদীয়াকে কোলে তুলে নিল। তারপর রিয়ার দিকে তাকিয়ে, তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, "বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয়েছে, কারণ তুমি আমার কেন্দ্রবিন্দু ছিলে, রিয়া। আর সারাজীবন থাকবে।" রিয়ার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অরুণ আলতো করে তার কপালে একটা চুমু খেল, ঠিক মণ্ডপের মাঝখানে, দেবী প্রতিমার সামনে। অরুণ চোখ খুলল। বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে, সে টেরও পায়নি। গঙ্গার ওপর ভোরের প্রথম আলো এসে পড়েছে। সে উঠে ভেতরে গেল। রিয়া আর শারদীয়া তখনও ঘুমাচ্ছে। সে আলতো করে রিয়ার কপালে একটা চুমু খেল। তারপর শারদীয়ার মাথায় হাত রাখল। এই তো তার জগৎ। এই তো তার সাম্রাজ্য। কোনো কাঁচের দুর্গ নয়, ভালোবাসার এক ছোট্ট নীড়। সে মনে মনে বলল, "ধন্যবাদ, মা দুর্গা। আমাকে আমার শিকড়ে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।" ~সমাপ্ত ~

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion