রিয়ার সাথে সেই রাতের আশ্বাসপূর্ণ কথোপকথনের পর অরুণের মনটা অনেকটাই শান্ত হয়েছিল। কিন্তু অতীতের ছায়া এত সহজে পিছু ছাড়ে না। সেই রাতে, রিয়ার শান্তির নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে, অরুণের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল তার কলকাতার ফ্লাইটে ওঠার ঠিক আগের একটি দিনের সম্পূর্ণ ছবি। সেই দিনটা ছিল তার দশ বছরের নির্বাসনের এক নিখুঁত সারসংক্ষেপ।
ফ্ল্যাশব্যাকটা শুরু হয়েছিল এক ধূসর, মেঘলা লন্ডন সকালে। সাউথ কেনসিংটনের অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্টের স্মার্ট অ্যালার্মটা তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল জাপানের নিক্কেই ইনডেক্সের ভোরের খবরের সাথে, কোনো পাখির ডাকে বা মায়ের বকাবকিতে নয়। তার শোবার ঘরের ফ্লোর-টু-সিলিং জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল এক বর্ণহীন আকাশ। ঘরটা ছিল নিখুঁত, ordenada এবং প্রাণহীন। ধূসর, সাদা আর ক্রোম—এই ছিল তার জীবনের তিনটি প্রধান রঙ। ঘরের কোথাও কোনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস ছিল না, কোনো পুরোনো চিঠি বা ছবির ফ্রেম ছিল না, যা তার অতীতকে মনে করিয়ে দিতে পারে।
ঘুম থেকে উঠে তার প্রথম কাজ ছিল ফোনটা হাতে নেওয়া। একশোটার ওপর ইমেল, যার বেশিরভাগই নিউ ইয়র্ক আর টোকিওর অফিস থেকে। সে বিছানায় বসেই কয়েকটার উত্তর দিল। তারপর শুরু হলো তার যান্ত্রিক সকালের রুটিন। স্মার্ট কফি মেশিনটা ঠিক সাতটা বেজে পাঁচ মিনিটে একটা পারফেক্ট, কিন্তু স্বাদহীন এসপ্রেসো তৈরি করে দিল। সে জিমে গেল—তার অ্যাপার্টমেন্টেরই একটা ঘরে রাখা Peloton বাইকে সে এক ঘণ্টা ধরে ঘাম ঝরাল, তার সামনে রাখা স্ক্রিনে একজন আমেরিকান প্রশিক্ষকের চিৎকারের সাথে সাথে। সে দৌড়াচ্ছিল, কিন্তু কোথাও পৌঁছাচ্ছিল না—ঠিক তার জীবনের মতোই।
স্নান করে সে একটা দামী, নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা স্যুট পরল। তার পোশাক ছিল তার বর্ম। এই বর্মটা পরেই সে রোজ তার যুদ্ধক্ষেত্রে যেত।
ক্যানারি হোয়ার্ফের জন্য জুবিলি লাইনের টিউবটা ছিল এক অদ্ভুত জায়গা। হাজারো মানুষের ভিড়, কিন্তু সবাই একা। প্রত্যেকেই নিজের ফোন বা ট্যাবলেটের স্ক্রিনে নিমগ্ন। বাতাসে ভেজা কোট আর রিসাইকেল করা বাতাসের এক মিশ্র গন্ধ। অরুণ দেখছিল তার সহযাত্রীদের। তাদের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, চোখে কোনো স্বপ্ন নেই, আছে শুধু ক্লান্তি আর তাড়াহুড়ো। এই ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে অনুভব করছিল এক প্রচণ্ড একাকীত্ব। সে ছিল এই বিশাল যন্ত্রের একটা ছোট্ট, কিন্তু দামী স্ক্রু মাত্র।
তার অফিসটা ছিল এক বিশাল কাঁচের টাওয়ারে। সেখান থেকে গোটা লন্ডন শহরটা দেখা যেত। কিন্তু অরুণ কোনোদিনও সেই দৃশ্য উপভোগ করার সময় পায়নি। তার জগৎটা ছিল তার সামনে রাখা ছটা মনিটরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ট্রেডিং ফ্লোরে কোনো কোলাহল ছিল না, ছিল এক চাপা উত্তেজনা আর হাজারো কি-বোর্ডের একটানা খটখট শব্দ।
সেদিন সকালের মিটিংটা ছিল ক্যাথরিনের সাথে। তারা একটা কাঁচের দেওয়ালওয়ালা কনফারেন্স রুমে বসেছিল টোকিওর একটা বড় ডিল নিয়ে আলোচনা করার জন্য। তাদের কথোপকথনে কোনো ব্যক্তিগত স্পর্শ ছিল না, ছিল শুধু ডেটা, স্ট্র্যাটেজি আর পাওয়ার প্লে।
"The projections from Q2 are not aligning with our initial forecast, Arun," ক্যাথরিন বলেছিল তার নিখুঁত ব্রিটিশ উচ্চারণে।
"I've recalibrated the model. We need to be more aggressive with our leveraging strategy," অরুণ উত্তর দিয়েছিল।
তাদের কথাগুলো ছিল রোবটের মতো। অরুণ একবার চেষ্টা করেছিল এই যান্ত্রিকতা ভাঙার। "How was your weekend, Cath?"
ক্যাথরিন তার ল্যাপটপ থেকে চোখ না তুলেই বলেছিল, "Productive. I finalized the report for the Zurich meeting. Did you see the revised P&L projections?"
এই একটা বাক্যেই অরুণ বুঝে গিয়েছিল, তাদের সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু।
দুপুরে লাঞ্চের সময় সবাই নিজের নিজের ডেস্ক থেকে একটা প্লাস্টিকের বাক্সে আনা স্বাস্থ্যকর কিন্তু স্বাদহীন স্যালাড বা স্যান্ডউইচ খেত। একসাথে বসে গল্প করতে করতে খাওয়ার কোনো ধারণা সেখানে ছিল না। সময় বাঁচানোই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। অরুণ তার কুইনোয়া স্যালাডটা খেতে খেতে ভাবছিল, তিন বছর আগের পুজোর অষ্টমীর দুপুরের কথা। কলাপাতায় গরম খিচুড়ি, লাবড়া আর সেই সম্মিলিত আড্ডার স্বাদ—এই কুইনোয়া স্যালাডের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও নেই।
বিকেলে ঘটল এক নাটকীয় ঘটনা। এশিয়ান মার্কেটে হঠাৎ ধস নামল। ট্রেডিং ফ্লোরে একটা চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। সবাই যখন দিশেহারা, তখন অরুণের শান্ত মাথাটা কাজ করে উঠল। সে তার মনিটরের দিকে তাকিয়ে, হাজারো সংখ্যার মধ্যে থেকে ভুলটা খুঁজে বের করল। একটা অ্যালগরিদমের সামান্য ত্রুটির জন্য এই অবস্থা। সে দ্রুত কয়েকটা ফোন করল, কয়েকটা নির্দেশ দিল, আর মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে সে তার সংস্থার কয়েক মিলিয়ন পাউন্ডের ক্ষতি হওয়া থেকে বাঁচাল।
তার বস, মিস্টার জেনকিন্স, তার ডেস্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুধু কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন, "Good spot, Mitra."
এইটুকুই ছিল তার পুরস্কার। একটা অ্যাড্রেনালিনের ঢেউ তার সারা শরীরে বয়ে গেল। জয়ের অনুভূতি। কিন্তু সেই অনুভূতিটা ছিল क्षणস্থায়ী। কয়েক মিনিট পরেই তার মনে হলো, 'So what?' সে কয়েক মিলিয়ন পাউন্ড বাঁচিয়েছে, কিন্তু তাতে তার জীবনের কী পরিবর্তন হলো? এই জয়ের আনন্দটা ভাগ করে নেওয়ার মতো তো কেউ নেই। সাফল্যটা তার কাছে একটা ফাঁপা শব্দের মতো মনে হলো।
অনেক রাতে যখন সে অফিস থেকে বেরোল, তখন শহরটা আলোয় ঝলমল করছে। টেমসের ধারে এই কাঁচের টাওয়ারগুলো দেখতে অসাধারণ লাগছিল। কিন্তু এই সৌন্দর্যের সাথে অরুণের কোনো আত্মিক যোগ ছিল না। সে ছিল এই শহরের একজন সফল ভাড়াটে, মালিক নয়।
ফ্ল্যাটে ফিরে সে তার স্যুটটা খুলল। বর্মটা খুলে ফেলার পর নিজেকে খুব দুর্বল আর একা মনে হলো। রান্নাঘরে গিয়ে সে মাইক্রোওয়েভে একটা gourmet pre-packaged meal গরম করল। নিখুঁতভাবে রান্না করা, পরিমাণ মতো প্রোটিন আর কার্বোহাইড্রেট—কিন্তু তাতে কোনো ভালোবাসা ছিল না, ছিল না কোনো স্বাদ। সে রান্নাঘরের কাউন্টারে দাঁড়িয়েই খাওয়াটা সারল, জানালার বাইরে শহরের আলোর দিকে তাকিয়ে।
খাওয়া শেষে সে সোফায় এসে বসল। তার ইচ্ছে করছিল কারো সাথে কথা বলতে। তার আজকের সাফল্যের কথা, তার এই অদ্ভুত শূন্যতার কথা। সে তার ফোনের কন্টাক্ট লিস্টটা খুলল। ক্যাথরিন? না। অফিসের সহকর্মীরা? অসম্ভব। বন্ধু? তার কোনো বন্ধু ছিল না, ছিল শুধু নেটওয়ার্ক। সে বুঝতে পারল, এই বিশাল পৃথিবীতে সে আসলে একা।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল 'মা'। এই শব্দটা যেন অন্য এক জগৎ থেকে ভেসে আসা এক সুর। সে ফোনটা ধরল।
"অরু? কেমন আছিস বাবা?" মায়ের গলাটা কেমন যেন ধরা ধরা।
"ভালো আছি, মা। তুমি কেমন আছো?"
"আমি আর ভালো থাকা," মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। "তোর বাবা সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। পায়ে খুব লেগেছে। ডাক্তার বলেছে প্লাস্টার করতে হবে।"
অরুণ চুপ করে রইল।
মা বলে চললেন, "সারাদিন কেমন চুপ করে থাকে। কথাও বলে না। আমার খুব ভয় করে রে, অরু। এই একা একা বাড়িটা যেন গিলতে আসে।"
মায়ের এই কান্নাভেজা, অসহায় গলাটা অরুণের বুকের গভীরে গিয়ে বিঁধল। সে তার এই নিখুঁত, শান্ত, কিন্তু আত্মাহীন ফ্ল্যাটটার দিকে তাকাল। তার দামি আসবাব, তার অত্যাধুনিক গ্যাজেট—সবকিছুই তার কাছে অর্থহীন বলে মনে হলো। অদিতির কথাগুলো তার কানে বাজছিল—'I want to build empires'। কীসের সাম্রাজ্য? এই শূন্যতার, এই একাকীত্বের? সে বুঝতে পারল, সে কোনো সাম্রাজ্য গড়েনি, সে নিজের জন্য এক সোনার খাঁচা তৈরি করেছে।
ফোনটা রাখার পর ফ্ল্যাটের নীরবতাটা তার কাছে অসহ্য বলে মনে হলো। এটা শান্তির নীরবতা নয়, এটা মৃত্যুর নীরবতা। সে উঠে দাঁড়াল। তার হাঁটাচলায় আজ এক নতুন দৃঢ়তা ছিল। সে তার ল্যাপটপটা খুলল, অফিসের ইমেলগুলো উপেক্ষা করে একটা নতুন ব্রাউজার উইন্ডো খুলল। তারপর সার্চ বারে টাইপ করল: "Flights from London Heathrow to Kolkata"।
স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ফ্লাইটের তালিকাগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, সে শুধু একটা প্লেনের টিকিট খুঁজছে না, সে খুঁজছে তার ঘরে ফেরার रास्ता। সেই রাতে, লন্ডনের সেই ঠান্ডা, নীরব ফ্ল্যাটে বসে অরুণ মিত্র তার জীবনের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion