ধুলোমাখা জগৎ
কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি কেবল একটি গ্রন্থাগার নয়, এটি সময়ের এক বিশাল স্রোত যা কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ কাহিনিকে নিজের মধ্যে ধরে রেখেছে। অরুণ চৌধুরীর কাছে এই গ্রন্থাগার ছিল তার আশ্রয়, তার দুর্গ। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে পাশ করার পর এই চাকরিটা পাওয়া তার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। বইয়ের গন্ধ, পুরনো কাগজের স্পর্শ আর নীরবতার মধ্যে ডুবে থাকতে তার ভালো লাগত। তার কাজ ছিল মূলত পুরনো এবং প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া নথি, বই এবং পাণ্ডুলিপিগুলোকে ক্যাটালগ করা এবং সেগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
অরুণের ডেস্কটা ছিল রিডিং রুমের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, আর্কাইভের এক গভীর, শান্ত অংশে, যাকে সহকর্মীরা ঠাট্টা করে বলত ‘পাতালঘর’। জায়গাটা আক্ষরিক অর্থেই মাটির নিচে ছিল না, কিন্তু এর পরিবেশ ছিল তেমনই। উঁচু সিলিং থেকে ঝুলে থাকা কয়েকটি হলদেটে বাল্বের আলো কোনোভাবেই যেন এখানকার জমাট বাঁধা অন্ধকারকে পুরোপুরি দূর করতে পারত না। তার চারপাশে ছিল উঁচু উঁচু লোহার শেলফ, যেগুলো মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এই শেলফগুলোতে ঘুমিয়ে ছিল বাংলার ইতিহাস—নবাবদের ফরমান, কোম্পানির দলিল, পুরনো পত্রিকার পাতা আর বিস্মৃত কবিদের কবিতার খাতা। এই ধুলোমাখা, শান্ত জগৎটাই ছিল অরুণের নিজের। তার ব্যক্তিগত জীবনে মানুষের ভিড় বিশেষ ছিল না; বইয়েরাই ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সে ছিল একাকী, কিন্তু নিঃসঙ্গ নয়। তার জগৎ ছিল শব্দ আর অক্ষরে বোনা।
ছোটবেলায় এক বর্ষার রাতে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় বাবা-মাকে হারানোর পর অরুণ মাসির বাড়িতে মানুষ হয়েছিল। দুর্ঘটনার স্মৃতি তার মনে আবছা, দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে আসত—ভেজা রাস্তা, গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো, একটা বিকট শব্দ আর তারপর জমাট বাঁধা অন্ধকার। মাঝে মাঝে স্বপ্নের মধ্যে সে আরও কিছু দেখত—রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এক দীর্ঘ, ছায়ামূর্তি, যার মুখ দেখা যায় না। ডাক্তাররা বলেছিলেন এটা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস, কিন্তু অরুণের মনে হতো, ওই ছায়ামূর্তিটা শুধু তার কল্পনার অংশ নয়। এই একাকীত্বই হয়তো তাকে বইয়ের জগতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, যেখানে চরিত্রদের জীবন তার নিজের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হতো। সে বাস্তব থেকে পালিয়ে এই অক্ষরের জগতে আশ্রয় নিয়েছিল।
সেদিন ছিল একঘেয়ে আগস্ট মাসের এক বিকেল। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল, আর আর্কাইভের ভেতরটা ছিল আবছা আলো আর ছায়ার এক মায়াবী জগৎ। হলদেটে বাল্বের আলোয় ধুলোকণাগুলোকে নাচতে দেখা যাচ্ছিল। অরুণ কাজ করছিল একগাদা পুরনো দলিলের ওপর, যেগুলো উনিশ শতকের শেষভাগের জমিজমার হিসাব। কাজটা বিরক্তিকর, কিন্তু জরুরি। প্রতিটি কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ে, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কালি পড়ার চেষ্টা করতে করতে তার চোখ ধরে আসছিল। একঘেয়েমি কাটাতে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং শেলফের সারিগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
হঠাৎ করেই তার চোখ পড়ল একটা বড়, মরচে ধরা লোহার ট্রাঙ্কের ওপর, যেটা সবচেয়ে নিচের শেলফের এক কোণে অযত্নে পড়ে ছিল। ট্রাঙ্কটার ওপর ধুলোর আস্তরণ এত পুরু ছিল যে দেখে মনে হচ্ছিল বহু দশক ধরে ওটাকে কেউ স্পর্শ করেনি। লাইব্রেরির প্রতিটি জিনিসের একটি নির্দিষ্ট জায়গা এবং নম্বর ছিল, কিন্তু এই ট্রাঙ্কটি ছিল যেন এক বহিরাগত, হিসাবের বাইরে।
কৌতূহলবশত অরুণ সেটার দিকে এগিয়ে গেল। সে ধুলো ঝেড়ে দেখল, ট্রাঙ্কের ওপর পিতলের একটা প্লেটে অস্পষ্টভাবে কিছু লেখা— ‘Cpt. Arthur Davies, 13th Bengal Native Infantry’।
একজন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের ব্যক্তিগত ট্রাঙ্ক! এখানে? অরুণ ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করল। এই ধরনের অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারই তার কাজকে রোমাঞ্চকর করে তোলে। বহু কষ্টে মরচে ধরা তালাটা ভাঙার পর যখন সে ডালাটা খুলল, একটা স্যাঁতসেঁতে, পুরনো কাগজের গন্ধ তার নাকে এসে লাগল। ভেতরে থরে থরে সাজানো ছিল চামড়ায় বাঁধানো কয়েকটি ডায়েরি, কিছু হলদে হয়ে যাওয়া চিঠিপত্র আর একটা অয়েল-স্কিন পাউচে মোড়া একগাদা আলগা কাগজ।
অরুণ সাবধানে প্রথম ডায়েরিটা তুলে নিল। মলাটের ওপর সোনালি হরফে লেখা— ‘The Calcutta Journal, 1888’। চামড়ার স্পর্শটা ছিল শীতল এবং মসৃণ। কাঁপা কাঁপা হাতে সে প্রথম পাতাটা খুলল। সুন্দর, পেঁচানো ইংরেজিতে লেখা:
“October 12, 1888. The rains have finally subsided, leaving behind a city shimmering in the autumn sun. Calcutta is a city of dreadful contrasts—of magnificent colonial mansions standing beside squalid native gullies. As a soldier, I have seen much of this country, but this city… this city breathes a different kind of life. A life steeped in commerce, politics, and a darkness that the gas lamps on Chowringhee cannot seem to pierce.”
অরুণ তন্ময় হয়ে পড়ছিল। ক্যাপ্টেন ডেভিসের এই কথাগুলো তার নিজের মনের গভীরে কোথাও যেন একটা প্রতিধ্বনি খুঁজে পেল। কলকাতা, তার নিজের শহর, তার কাছেও মাঝে মাঝে এমনই এক विरोधाभास (contradiction) বলে মনে হতো। দিনের বেলার কোলাহল আর রাতের বেলার রহস্যময় নীরবতা। এই শহরের আলোর নিচে যে অন্ধকার লুকিয়ে থাকে, সেটা সে নিজেও অনুভব করত।
সে জানত, সে এমন কিছুর সন্ধান পেয়েছে যা সাধারণ নয়। এটা শুধু একজন ব্রিটিশ সৈন্যের ব্যক্তিগত ডায়েরি নয়, এটা ইতিহাসের এক হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়ের চাবিকাঠি। কিন্তু সে তখনো জানত না যে, এই চাবিকাঠি দিয়ে সে যে দরজাটা খুলতে চলেছে, সেটা তাকে এক ভয়ঙ্কর, অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দেবে, যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। সে শুধু দেখেছিল পুরনো কাগজ, কিন্তু শুনতে পায়নি সেই কাগজগুলোর ভেতর থেকে উঠে আসা বহু পুরনো ফিসফিসানি, যা একজন নতুন শ্রোতার জন্য এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছিল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion