ডায়েরির পাতা ও একজোড়া চোখ
পরের কয়েকটা দিন অরুণের কাটল ক্যাপ্টেন আর্থার ডেভিসের ডায়েরিগুলোর মধ্যে ডুবে থেকে। সে তার নিয়মিত কাজ একপাশে সরিয়ে রেখেছিল। তার সুপারভাইজার, ধীরেনবাবু, একজন রাশভারী কিন্তু ভালো মানুষ। অরুণের কাজে তিনি কখনো বেশি হস্তক্ষেপ করতেন না। তাই অরুণ নিজের মতো করে সময় দিতে পারছিল এই নতুন আবিষ্কারে।
ডায়েরির প্রথম দিকের লেখাগুলো ছিল বেশ সাধারণ। ক্যাপ্টেন ডেভিস তার দৈনন্দিন জীবন, কলকাতার সামাজিক অনুষ্ঠান, তার রেজিমেন্টের কার্যকলাপ এবং দেশের বাড়ির জন্য তার মন খারাপের কথা লিখতেন। তিনি ছিলেন একজন সংবেদনশীল এবং বুদ্ধিমান মানুষ। তার লেখার মধ্যে দিয়ে উনিশ শতকের কলকাতা যেন অরুণের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছিল।
কিন্তু ১৮৮৮ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডায়েরির সুরটা বদলাতে শুরু করল। ক্যাপ্টেন ডেভিস তার এক সহকর্মী, লেফটেন্যান্ট রবার্টসনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। রবার্টসনকে তার নিজের বাংলোতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, এবং তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল সাপের কামড়। কিন্তু ডেভিসের সন্দেহ ছিল।
“November 20, 1888. I visited Robertson’s bungalow today. The official report says it was a krait, but there is something unsettling about the whole affair. The servants whisper of things I cannot comprehend. They speak of the ‘Tantrik of Kalighat’ and a curse. They say Robertson had meddled in affairs best left untouched. These are superstitious folk, of course, but their fear… their fear felt genuine.”
এই প্রথম ‘তান্ত্রিক’ শব্দটার উল্লেখ পেল অরুণ। তার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। ডেভিস তার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তার ডায়েরির পাতায় পাতায় সেই তান্ত্রিকের ছায়া আরও গভীর হচ্ছিল। তান্ত্রিকের কোনো নাম ছিল না, লোকেরা তাকে কেবল ‘অঘোরনাথ’ বলে ডাকত। শোনা যেত, সে শ্মশানে বাস করত এবং তার ক্ষমতা ছিল অসীম।
“December 5, 1888. I have learned more about this Aghornath. He is not a mere charlatan. People, even those of high standing, seek him out in the dead of night. They say he can grant wishes, cure diseases, and also inflict death with a single chant. He demands strange offerings—a lock of hair, a piece of clothing worn by an enemy, sometimes things far more sinister. I found a small, crudely made doll in Robertson’s study. It had a pin stuck through its heart.”
অরুণ পড়তে পড়তে শিউরে উঠল। এটা কালো জাদু ছাড়া আর কিছুই নয়। ডেভিস, একজন যুক্তিবাদী ব্রিটিশ অফিসার, ধীরে ধীরে এক কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছিলেন। তার লেখার মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক ফুটে উঠছিল।
এই ডায়েরিগুলোতে ডুবে থাকার সময়েই অরুণ প্রথমবার লোকটিকে লক্ষ্য করে। রিডিং রুমের এক কোণে, যেখানে পুরনো এবং দুর্লভ বইয়ের বিভাগ, সেখানে প্রায়ই এক ভদ্রলোককে দেখা যেত। বয়স্ক, কিন্তু তার চালচলনে বয়সের ছাপ নেই। পরনে থাকত নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা পুরনো ধাঁচের স্যুট, যা এই সময়ের সাথে ঠিক খাপ খায় না। হাতে একটা রুপোর হাতলওয়ালা বেতের ছড়ি, যদিও হাঁটার জন্য তার সেটার প্রয়োজন আছে বলে মনে হতো না। কিন্তু তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং অস্বস্তিকর বৈশিষ্ট্য ছিল তার চোখ—তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত এবং unsettlingly perceptive। মনে হতো, তিনি শুধু বইয়ের পাতাই পড়েন না, মানুষের মনের ভেতরটাও পড়ে ফেলেন।
অরুণ যখনই ডেভিসের ডায়েরি নিয়ে বসত, তার মনে হতো, সেই ভদ্রলোক যেন দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করছেন। প্রথমে সে ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু দিনের পর দিন একই ঘটনা ঘটতে থাকায় তার মনে একটা খটকা লাগল। লোকটি কি তাকে দেখছে, নাকি তার হাতে থাকা চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরিগুলোকে?
একদিন বিকেলে অরুণ যখন আর্কাইভের সেই নিস্তব্ধ ঘরে একা বসে ডায়েরিটা পড়ছিল, হঠাৎ তার মনে হলো যেন কেউ তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ঠান্ডা স্রোত তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। সে চমকে পেছনে ফিরল, কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। শুধু উঁচু উঁচু শেলফের সারি আর তার মাঝে জমে থাকা অন্ধকার।
সে ভাবল, হয়তো এটা তার মনের ভুল। বেশ কয়েকদিন ধরে সে ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে না, সারাক্ষণ এই ডায়েরি নিয়েই পড়ে আছে। কিন্তু সেই অনুভূতিটা যাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল, এই ঘরটা আর আগের মতো নিরাপদ নয়। বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে, আর সেই বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অশরীরী ফিসফিসানি।
সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার পথে তার মনে হলো, রাস্তার মোড়ের আবছা আলোয় একটা ছায়ামূর্তি যেন তাকে অনুসরণ করছে। সে গতি বাড়িয়ে দিল, কিন্তু ছায়াটাও যেন তার সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে আসছিল। প্রায় দৌড়ে সে যখন নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে পৌঁছাল, তখন তার বুক ধড়ফড় করছে। পেছনে ফিরে সে আর কিছুই দেখতে পেল না।
অরুণ নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে সে অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে আছে। কিন্তু তার যুক্তিবাদী মন আর বিশ্বাসের দেওয়ালে ফাটল ধরতে শুরু করেছিল। ক্যাপ্টেন ডেভিসের আতঙ্ক যেন ডায়েরির পাতা থেকে বেরিয়ে এসে তার নিজের জীবনেও থাবা বসাচ্ছিল। আর তার সাথে যোগ হয়েছিল একজোড়া অচেনা, তীক্ষ্ণ চোখের অস্বস্তিকর উপস্থিতি।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion