Episode 7560 words0 views

ফিসফিসানির আর্কাইভ : সপ্তম অধ্যায়

নীরবতার আর্কাইভ ও নতুন পাহারাদার অরুণ যখন শব্দটি উচ্চারণ করল, গোটা ঘরটা এক তীব্র, সাদা আলোয় ভরে গেল। তার কানে তালা লেগে গিয়েছিল, চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। আলোটা শুধু ঘরকে আলোকিত করল না, বরং একটা প্রচণ্ড শক্তি হিসেবে ছায়ামূর্তিগুলোকে আঘাত করল। তারা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল—এমন এক শব্দ যা শোনা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। ছায়ামূর্তিগুলো বাষ্পের মতো মিলিয়ে গিয়ে আবার দেওয়ালের প্রতীকগুলোর মধ্যে ঢুকে গেল। ঘরের দেওয়ালে পোড়া দাগের মতো চিহ্ন রয়ে গেল। যখন সব শান্ত হলো, অরুণ দেখল সে সেই অন্ধকার কুঠুরিতে একা দাঁড়িয়ে আছে। ধীরেনবাবু বা মিস্টার জ্যাকব, কেউই সেখানে নেই। তীব্র আলোর ঝলকানিতে তারা যেন মিলিয়ে গেছেন। পাথরের বেদীর ওপর চামড়ায় বাঁধানো বইটা আগের মতোই রাখা আছে, কিন্তু এখন ওটাকে আর জীবন্ত মনে হচ্ছে না। ওটা এখন শুধুই একটা পুরনো, নষ্ট হয়ে যাওয়া পুঁথি। ফিসফিসানি থেমে গেছে। অরুণ টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। ছাপাখানার ধুলোমাখা ঘরটা আগের মতোই শান্ত। সে যখন বাইরে বেরিয়ে এল, তখন ভোরের আলো ফুটছে। কলকাতা শহরটা ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। অরুণের মনে হলো, সে যেন এক নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। পরদিন লাইব্রেরিতে গিয়ে সে ধীরেনবাবুকে খুঁজে পেল না। কেউ বলতে পারল না তিনি কোথায় গেছেন। তার কেবিনটা ছিল খালি। টেবিলের ওপর শুধু একটা কাগজ পড়ে ছিল, তাতে লেখা— ‘তোমার কাজ শেষ, অরুণ। এবার আমার মুক্তির সময়।’ অরুণ বুঝতে পারল, ধীরেনবাবুর আত্মা এতদিন ধরে এই লাইব্রেরিতেই বন্দী ছিল, অঘোরনাথের অভিশাপের পাহারাদার হিসেবে। অরুণ চক্রটা ভেঙে দেওয়ায় তিনিও মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু মিস্টার জ্যাকবের কী হলো? তিনি কি মিলিয়ে গেছেন? নাকি তিনি এখনো কোথাও লুকিয়ে আছেন, সঠিক সময়ের অপেক্ষায়? এই প্রশ্নটা অরুণের মনে একটা কাঁটার মতো বিঁধে রইল। ক্যাপ্টেন ডেভিসের ট্রাঙ্কটা অরুণ লাইব্রেরির সবচেয়ে সুরক্ষিত ভল্টে রেখে দিল। সে জানে, ওই ডায়েরিগুলো আর কখনো কাউকে বিপদে ফেলবে না। অঘোরনাথের শক্তি শেষ হয়ে যায়নি, কিন্তু সেটা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়তো আরও একশো বছর পর, অন্য কোনো কৌতূহলী মন আবার তাকে জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু আপাতত, আর্কাইভটা নীরব। অরুণ তার পুরনো কাজে ফিরে গেল। কিন্তু সে আর আগের মতো নেই। সে এখন জানে, প্রতিটি বই, প্রতিটি লেখার পেছনে একটা আত্মা থাকে। সে জানে, জ্ঞানের আলো যেমন আছে, তেমনই আছে তার অন্ধকার দিক। কয়েক মাস পর, এক শীতের সন্ধ্যায়, লাইব্রেরি থেকে বেরোনোর সময় গেটের কাছে মিস্টার জ্যাকবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল অরুণ। তিনি আগের মতোই নিখুঁত পোশাকে সজ্জিত। “আমি জানতাম তুমি পারবে,” জ্যাকব মৃদু হেসে বললেন। “তোমার মধ্যে ভয় এবং সাহস, দুটোই আছে। এটাই শক্তির ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন।” “আপনি কী চান?” অরুণ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল। “কিছুই না,” জ্যাকব বললেন। “আমি শুধু দেখতে এসেছিলাম যে পাহারাদার তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে কিনা। অঘোরনাথ ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু তার মতো আরও অনেকেই আছে। এই শহরটা অনেক রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, অরুণ। অনেক বই আছে যা পড়া হয়নি, অনেক শব্দ আছে যা বলা হয়নি।” তিনি অরুণের হাতে একটা পুরনো, নকশা করা চাবি ধরিয়ে দিলেন। “এটা রাখো। কোনোদিন যদি মনে হয়, একা সামলাতে পারছ না, তাহলে কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের বাজারের শেষে ‘অক্ষর’ নামের দোকানে চলে এসো। এই চাবিটা দরজা খুলে দেবে।” এই বলে মিস্টার জ্যাকব রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। অরুণ চাবিটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারল, তার লড়াই শেষ হয়নি। বরং, একটা বড় জগতের দরজা তার জন্য খুলে গেছে। সে এখন আর শুধু একজন আর্কাইভিস্ট নয়। সে এই নীরবতার পাহারাদার। এবং সে একা নয়। মাঝে মাঝে, আর্কাইভের গভীর নীরবতায় কাজ করতে করতে তার মনে হয়, কেউ যেন তার কানের কাছে ফিসফিস করে একটা অর্থহীন, অচেনা শব্দ উচ্চারণ করল। সেই শব্দটা, যা সে সেদিন সেই কুঠুরিতে তৈরি করেছিল। আর তখন সে মুচকি হাসে। কারণ সে জানে, তার journey সবে শুরু হয়েছে। (সমাপ্ত)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion