ছাপাখানার গোলকধাঁধা ও ত্রিমুখী লড়াই
পরের দিনটা অরুণ কাটাল উত্তর কলকাতার পুরনো অলিগলিতে ঘুরে। ক্যাপ্টেন ডেভিসের ডায়েরিতে ছাপাখানাটার কোনো সঠিক ঠিকানা ছিল না, শুধু একটা বর্ণনা ছিল—‘চিৎপুর রোডের কাছে, যেখানে তামার বাসন তৈরির কারিগররা কাজ করে, সেই অঞ্চলের এক অন্ধকার গলিতে।’
বিকেলের দিকে, এক সরু, স্যাঁতসেঁতে গলির মধ্যে অরুণ একটা পুরনো, প্রায় ভেঙে পড়া বাড়ি দেখতে পেল। তার একতলায় একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের সামনে একটা বিবর্ণ সাইনবোর্ড ঝুলছিল, তাতে লেখা—‘ঘোষ অ্যান্ড সন্স প্রিন্টিং প্রেস, স্থাপিত ১৮৭০’।
অরুণের বুকটা ধক করে উঠল। এটাই সেই জায়গা।
দরজাটা বহু বছর ধরে বন্ধ। অরুণ অনেক কষ্টে একটা ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। ঘরটা অন্ধকার আর ধুলোয় ভরা। বাতাসে পুরনো কালি আর মেশিনের তেলের গন্ধ। বড় বড়, প্রাচীন ছাপার যন্ত্রগুলো দৈত্যের কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
ডেভিসের বর্ণনা অনুযায়ী, গোপন কুঠুরির প্রবেশপথটা ছিল সবচেয়ে বড় প্রেসটার নিচে। অরুণ অনেক খোঁজাখুঁজির পর প্রেসটার পেছনে একটা মেঝের মধ্যে একটা লোহার রিং খুঁজে পেল। সেটা ধরে টানতেই, একটা ভারী পাথরের স্ল্যাব ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে সরে গেল। নিচে নেমে গেছে একটা অন্ধকার, পাথরের সিঁড়ি।
মোবাইলের টর্চ জ্বেলে অরুণ সাবধানে নিচে নামতে লাগল। বাতাস ক্রমশ ঠান্ডা আর ভারী হয়ে আসছিল। সিঁড়িটা শেষ হয়েছে একটা ছোট, গম্বুজের মতো ঘরে। ঘরের দেওয়াল জুড়ে আঁকা সেই অদ্ভুত প্রতীকগুলো, যা সে ডেভিসের ডায়েরিতে দেখেছিল। আর ঘরের ঠিক মাঝখানে, একটা পাথরের বেদীর ওপর রাখা ছিল সেই বইটা।
চামড়ায় বাঁধানো পুঁথি।
অরুণ এগিয়ে গেল। বইটার দিকে তাকাতেই তার মাথাটা ঘুরে উঠল। তার মনে হলো, বইয়ের পাতা থেকে ফিসফিসানির শব্দ ভেসে আসছে, তাকে ভেতরে ডাকছে। সে বুঝতে পারছিল, এই বইটা ছোঁয়ার অর্থ হলো নিজেকে পুরোপুরি অঘোরনাথের শক্তির কাছে সঁপে দেওয়া।
হঠাৎ তার মনে পড়ল ডেভিসের শেষ কথাগুলো। ‘I will give him the name of the one who comes after me.’ ডেভিস নিজের নাম না দিয়ে অরুণের নাম দিয়েছিলেন। কেন?
অরুণ বুঝতে পারল। এটা ছিল একটা চাল। অঘোরনাথের বন্ধন সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য শিকারের নামটা জানতে হয়। অঘোরনাথ ভেবেছিল তার শিকারের নাম আর্থার ডেভিস। কিন্তু ডেভিস সেই নামটা উচ্চারণ করেননি। তিনি অরুণকে পরবর্তী শিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, কিন্তু বন্ধনটা সম্পূর্ণ করেননি। তিনি অরুণকে সময় দিয়েছিলেন প্রস্তুত হওয়ার জন্য।
অরুণ যখন বইটার দিকে হাত বাড়াতে যাবে, ঠিক তখনই তার পেছনে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
“ওটাকে ছুঁস না, অরুণ।”
অরুণ চমকে ঘুরে দাঁড়াল। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ধীরেনবাবু। তার হাতে একটা পুরনো লণ্ঠন।
“আপনি এখানে কী করছেন?” অরুণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“তোকে আটকাতে এসেছি,” ধীরেনবাবু এগিয়ে আসতে আসতে বললেন। “আমি চল্লিশ বছর আগে এই একই ভুল করতে গিয়েছিলাম। এই বইটা হলো একটা দরজা। এটা খুললে অঘোরনাথের শক্তি পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যাবে।”
ঠিক তখনই, সিঁড়ির অন্য পাশ থেকে আরও একজন নেমে এল। মিস্টার জ্যাকব। তার হাতে তার সেই রুপোর হাতলওয়ালা ছড়ি।
“ধীরেনবাবু যেমনটা ভাবছেন, ব্যাপারটা ততটা সহজ নয়,” জ্যাকব শান্ত গলায় বললেন। “এই শক্তিকে শুধু ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় না। একে হয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নয়তো এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।”
“আপনি কে?” অরুণ চেঁচিয়ে উঠল। “আপনি কী চান?”
“আমি একজন সংগ্রাহক, অরুণ,” জ্যাকব বললেন। “আমি এমন জ্ঞান সংগ্রহ করি যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অঘোরনাথ একজন পথভ্রষ্ট প্রতিভা ছিল। তার জ্ঞানকে ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”
“এটা অসম্ভব,” ধীরেনবাবু বললেন। “এই শক্তিকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।”
“আপনি পারেননি, কারণ আপনি ভীতু,” জ্যাকব তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন। “কিন্তু এই যুবক পারবে। ওর মধ্যে সেই সম্ভাবনা আছে।”
অরুণ বুঝতে পারছিল না সে কী করবে। একদিকে ধীরেনবাবুর ভয়, অন্যদিকে জ্যাকবের লোভ। আর মাঝখানে সে, যার কাঁধে একশো বছরের পুরনো এক অভিশাপের বোঝা।
ঠিক সেই মুহূর্তে, ঘরের ভেতরের প্রতীকগুলো দপ করে জ্বলে উঠল। দেওয়াল থেকে চুঁইয়ে পড়তে লাগল ঘন, কালো কালির মতো এক পদার্থ। ঘরের তাপমাত্রা দ্রুত কমতে শুরু করল। সেই কালো কালি মেঝেতে জমাট বেঁধে জীবন্ত হয়ে উঠল—তৈরি হলো কয়েকটি অস্থির, কাঁপতে থাকা ছায়ামূর্তি। তাদের কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তারা অরুণকে বইটার থেকে দূরে রাখতে চায়।
একটা ছায়ামূর্তি সাপের মতো হিসহিস শব্দ করে অরুণের দিকে এগিয়ে এল। ধীরেনবাবু ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “অরুণ, পালা! ওগুলো তোকে শেষ করে দেবে!”
কিন্তু জ্যাকব ছিলেন অবিচল। তিনি তার ছড়িটা দিয়ে একটা ছায়াকে আঘাত করলেন, কিন্তু সেটা কোনো বাধা ছাড়াই ছড়ির মধ্যে দিয়ে চলে গেল। “শারীরিক শক্তি এখানে কাজ করবে না, যুবক,” জ্যাকব বললেন। “মনকে ব্যবহার করো। তোমার ইচ্ছাশক্তিই তোমার অস্ত্র।”
ছায়ামূর্তিগুলো এবার তিনজনকে ঘিরে ধরল। তাদের স্পর্শে ঘরের পাথর হিমশীতল হয়ে যাচ্ছিল। একটা ছায়া ধীরেনবাবুর পা জড়িয়ে ধরল, এবং তিনি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন। আরেকটা ছায়া জ্যাকবের দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু জ্যাকব তার ছড়ি দিয়ে মাটিতে একটা বৃত্ত আঁকলেন, যা মুহূর্তের জন্য ছায়াটাকে আটকে দিল।
অঘোরনাথের অট্টহাসি যেন ঘরের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সে অরুণকে নিয়ে খেলছিল, তার ভয় এবং দ্বিধাকে উপভোগ করছিল।
“সময় নেই, অরুণ!” ধীরেনবাবু চিৎকার করলেন। “তোকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে!”
“ভয় পেয়ো না, অরুণ,” জ্যাকব বললেন। “শক্তিকে গ্রহণ করো। তুমি এর মালিক হতে পারো।”
অরুণের চোখের সামনে ভেসে উঠল লাইব্রেরির সেই উঁচু উঁচু শেলফ, বইয়ের সারি, তার ধুলোমাখা শান্ত জগৎ। তার মনে হলো, লক্ষ লক্ষ শব্দ, লক্ষ লক্ষ কাহিনি যেন তাকে শক্তি জোগাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করল। তার মনের ভেতর থেকে, তার ভয়, তার আশা, তার জ্ঞান, তার কল্পনা—সবকিছুকে এক করে সে একটা শব্দ তৈরি করার চেষ্টা করল।
সে যখন চোখ খুলল, তার দৃষ্টি ছিল স্থির। সে চামড়ায় বাঁধানো বইটার ওপর হাত রাখল। ঘরের ভেতর অশুভ শক্তিটা গর্জন করে উঠল। ছায়ামূর্তিগুলো একসাথে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
অরুণ গভীর শ্বাস নিল, এবং তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই নতুন শব্দটি উচ্চারণ করল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion