Episode 1976 words0 views

প্রথম অধ্যায় : মুদ্রা এবং মৌনতা

কলকাতার সেই সন্ধ্যাটা ছিল এক দমবন্ধ করা অস্বস্তির চাদরে মোড়া। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন ফুসফুসের ওপর একটা ভারী বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছিল। শ্রাবণের আকাশটা ছিল অসুস্থ রোগীর মতো বিবর্ণ, সীসার পাতের মতো ধূসর। বৃষ্টির গর্জন ছিল, কিন্তু বর্ষণ ছিল না। এই গুমোট পরিবেশের সঙ্গেই যেন পাল্লা দিচ্ছিল আলিপুরের পাম অ্যাভিনিউ-এর তেরো নম্বর বাংলোর বাইরের থমথমে আবহ। পুলিশের জিপের লাল-নীল বাতি নিস্তব্ধভাবে ঘুরছিল, সংবাদমাধ্যমের ওবি ভ্যানের জেনারেটরের একটানা শব্দ আর কাঁপা কাঁপা আলোয় উৎসুক জনতার ছায়াগুলো দেওয়ালে ভূতের মতো नाचছিল। সব মিলিয়ে পরিবেশটা ছিল কোনও পরাবাস্তব সিনেমার সেটের মতো। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অনির্বাণ বক্সী তার কালো SUV থেকে নামতেই এক ঝলক ক্যামেরার তীব্র আলো তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। সে হাত দিয়ে আলোটা আড়াল করল। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি ফুটে উঠল না। ছত্রিশ বছরের অনির্বাণ বক্সীর চালচলনে একটা পেশাগত শীতলতা ছিল, যা অনেক অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারের মধ্যেও দেখা যায় না। তার তদন্তের পদ্ধতি ছিল কলকাতা পুলিশের পুরনো ঘরানার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে বিশ্বাস করত ডেটায়, অ্যালগরিদমে এবং মানুষের চোখের আড়ালে থেকে যাওয়া ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টে। হলুদ ‘ক্রাইম সিন’ টেপ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই অনির্বাণের নাকে তিনটি ভিন্ন গন্ধ একসাথে ধাক্কা দিল—দামি কাঠের আসবাবের পুরোনো গন্ধ, চামড়ায় বাঁধানো বইয়ের শুকনো গন্ধ, আর সেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে মৃত্যুর এক অদ্ভুত হিমশীতল, মিষ্টি গন্ধ। বাংলোর মালিক, দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পপতি অভিনব চ্যাটার্জী, তার নিজের দুর্গ, তার প্রিয় লাইব্রেরি ঘরেই খুন হয়েছেন। লাইব্রেরি ঘরটা ছিল অভিনব চ্যাটার্জীর রুচি এবং ক্ষমতার এক নিখুঁত প্রদর্শনী। একদিকে দেওয়াল জোড়া মেহগনি কাঠের তাক, যেখানে ক্লাসিক সাহিত্য থেকে শুরু করে আধুনিক ব্যবসার বই পর্যন্ত থরে থরে সাজানো। অন্যদিকে দেওয়ালে টাঙানো ছিল জামিনী রায় এবং গণেশ পাইনের আসল ছবি। ঘরের মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড ওক কাঠের টেবিল, যার ওপর একটা ম্যাকবুক আর কয়েকটা ফাইল পরিপাটি করে রাখা। সেই টেবিলের পাশেই একটা গাঢ় সবুজ রঙের চামড়ার আরামকেদারায় এলিয়ে ছিল অভিনব চ্যাটার্জীর নিথর দেহ। দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন বই পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু এই ঘুমের শেষ নেই। অনির্বাণ গ্লাভস পরা হাতে ঘরের দেওয়ালের ডিজিটাল থার্মোস্ট্যাট দেখল। তাপমাত্রা বাইশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সেট করা। এসি-র ঠান্ডা হাওয়ায় ঘরের ভেতরটা কনকন করছিল। সে এগিয়ে গেল দেহের দিকে। ফরেনসিক প্রধান ডক্টর প্রসূন সেনগুপ্ত, একজন অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং স্বল্পভাষী মানুষ, তার দল নিয়ে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর প্রমাণ সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। “কী বুঝলে, প্রসূন দা?” অনির্বাণের গলা ছিল শান্ত, কিন্তু তার চোখ ঘরের প্রতিটি কোণ স্ক্যান করে নিচ্ছিল। প্রসূন সেনগুপ্ত তার মোটা ফ্রেমের চশমাটা কপালে তুলে বললেন, “অন, এটা আমার দেখা অন্যতম পরিচ্ছন্ন ক্রাইম সিন। বাইরে থেকে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, জোর করে ঘরে ঢোকার কোনো প্রমাণ নেই, ধস্তাধস্তির লেশমাত্র নেই। টেবিলের ওপর হুইস্কির গ্লাসটা দেখো, তাতে শুধু ওনারই আঙুলের ছাপ। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা শান্তিতেই মারা গেছে। কিন্তু…” “কিন্তু?” অনির্বাণ ঝুঁকে অভিনব চ্যাটার্জীর মুখের দিকে তাকাল। “কিন্তু এই নীলচে আভাটা দেখো,” প্রসূন সেনগুপ্ত অভিনব চ্যাটার্জীর ঠোঁটের এক কোণে একটা ছোট টর্চের আলো ফেলে দেখালেন। “আর চোখের মণি দুটো দেখো, পিনপয়েন্টের মতো ছোট হয়ে গেছে। এটা সাধারণ হার্ট অ্যাটাক নয়। আমার প্রাথমিক অনুমান, এটা কোনো শক্তিশালী নিউরোটক্সিন হতে পারে, যা সরাসরি সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে অকেজো করে দিয়েছে। খুনি জানত সে কী করছে।” অনির্বাণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের চারদিকে আবার চোখ বোলালো। তার মনে হচ্ছিল সে একটা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রতিটি জিনিস খুব যত্ন করে সাজানো হয়েছে। খুনি শুধু খুন করেই চলে যায়নি, সে একটা বার্তা রেখে গেছে। কিন্তু কী সেই বার্তা? হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল আরামকেদারার ঠিক পাশে, দামি পার্সিয়ান কার্পেটের ঘন রোয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটা ছোট, চকচকে জিনিসের ওপর। অন্য কারও চোখে হয়তো পড়ত না, কিন্তু অনির্বাণের প্রশিক্ষিত চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন। সে নিচু হয়ে একটা চিমটের সাহায্যে সাবধানে জিনিসটা তুলল। একটা পুরনো রুপোর মুদ্রা। মুদ্রাটার এক পিঠে কুইন ভিক্টোরিয়ার মুখ ক্ষয়ে প্রায় अस्पष्ट, আর অন্য পিঠে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচিত ছাপ। “এটা কি ওনার?” অনির্বাণ পাশে দাঁড়ানো সাব-ইন্সপেক্টর রানাকে জিজ্ঞেস করল। রানা মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার। আমি ম্যাডামকে, মানে অভিনব চ্যাটার্জীর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি কান্নাকাটি করতে করতেই জানালেন, দাদা পুরনো মুদ্রা সংগ্রহ করতেন, কিন্তু এই মুদ্রাটা তার সংগ্রহের অংশ নয়। আর এটা এখানে কীভাবে এল, তা তিনি কিছুই বলতে পারছেন না।” অনির্বাণ মুদ্রাটা একটা এভিডেন্স ব্যাগে ভরতে নির্দেশ দিল। একটা খুন, যার কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোনো ফরেনসিক প্রমাণ নেই, শুধু পড়ে আছে একটা অদ্ভুত ক্লু—একটা ব্রিটিশ আমলের মুদ্রা, যা নিহতের নিজের নয়। ঠিক তখনই ঘরের দরজায় প্রায় বিনা অনুমতিতে এসে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর বিক্রম রাঠোর। মধ্য পঞ্চাশের দশাসই চেহারা, পান খাওয়া লাল ঠোঁট আর চোখে একটা চিরস্থায়ী বিরক্তির দৃষ্টি। তিনি অনির্বাণের প্রযুক্তি-নির্ভর পদ্ধতিকে “বাবু গোয়েন্দাগিরি” বলে আড়ালে উপহাস করতেন। “কী বুঝলে, বক্সী?” রাঠোরের গলায় তীব্র শ্লেষ। “তোমার ট্যাবলেট কি বলে দিল খুনি কোন টাওয়ারের আন্ডারে আছে?” “তদন্ত সবে শুরু হয়েছে, স্যার,” অনির্বাণ শান্তভাবে জবাব দিল। “তবে এটা স্পষ্ট যে খুনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং নিহতের পরিচিত।” “সে তো আমি ঢোকার সময়েই বুঝেছি!” রাঠোর বিড়বিড় করতে করতে ঘরের চারদিকে তাকালেন। “শোনো, এসব মুদ্রা-ফুদ্রা নিয়ে রূপকথা লেখার দরকার নেই। অভিনব চ্যাটার্জীর শেষ দশটা বড় ডিল খতিয়ে দেখো। ওর নতুন প্রজেক্টের জন্য কাদের জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছিল, সেই ফাইলটা দেখো। আসল কারণ টাকা আর ক্ষমতা, ইতিহাস বই নয়।” অনির্বাণ কোনো উত্তর দিল না। সে জানত, রাঠোরের সাথে তর্ক করা মানে দেওয়ালে মাথা ঠোকা। তার নিজের পদ্ধতিতেই এগোতে হবে। সে নিঃশব্দে নিজের কাজ করতে লাগল। রাত প্রায় এগারোটা। অনির্বাণ যখন বাংলো থেকে বেরোচ্ছে, তখন তাকে জেনেশুনেই এড়িয়ে যাওয়া সাংবাদিকদের ভিড়টা আবার ছেঁকে ধরল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সামনে ছিল ‘চব্বিশ ঘন্টা লাইভ’ চ্যানেলের তারকা ক্রাইম রিপোর্টার রিয়া চৌধুরী। “মিস্টার বক্সী, একটা হাই-প্রোফাইল খুন, অথচ কলকাতা পুলিশ নীরব। আপনারা কি কিছু লুকাতে চাইছেন? ভেতরে কি এমন কিছু পাওয়া গেছে যা আপনারা প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন?” রিয়ার চোখেমুখে ছিল একটা শিকারি বাজের মতো তীক্ষ্ণতা। সে শুধু খবর খুঁজছিল না, সে খবরের পেছনের খবরটা খুঁজছিল। অনির্বাণ তাকে শান্ত চোখে একবার দেখে গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়ির কাঁচ তুলে দেওয়ার আগে আয়নায় সে দেখল, রিয়া তখনও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখেমুখে একটা অদ্ভুত জেদ। গাড়িতে বসে অনির্বাণ এভিডেন্স ব্যাগ থেকে মুদ্রাটা বের করল। একটা ঠান্ডা, ভারী ধাতব স্পর্শ। মুদ্রাটা যেন কোনো এক বিস্মৃত, রক্তাক্ত সময়ের সাক্ষী। অনির্বাণের মনে হচ্ছিল, এই পরিপাটি, নিখুঁত ক্রাইম সিনটা আসলে একটা মুখোশ। আর সেই মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল সত্যিটা এই মুদ্রার মতোই পুরনো, অন্ধকার এবং জটিল। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion