পরের বাহাত্তর ঘন্টা ছিল একরাশ হতাশা এবং ক্লান্তিকর ছোটাছুটির যোগফল। অনির্বাণ এবং তার দল অভিনব চ্যাটার্জীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় নিয়ে কার্যত পোস্টমর্টেম করল। তার ব্যবসার অংশীদারদের সাথে মিটিং, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নজরদারি, তার ফোন কল রেকর্ডস, ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া—সবকিছু ঘেঁটে ফেলা হলো। কিন্তু ফলাফল শূন্য। অভিনব চ্যাটার্জী একজন সতর্ক এবং ধূর্ত ব্যবসায়ী ছিলেন। তার শত্রু ছিল, কিন্তু তারা কেউই এমন শৈল্পিক এবং নিখুঁতভাবে খুন করার মতো বুদ্ধি বা সাহস রাখে বলে মনে হলো না।
অনির্বাণ তার অফিসের কাঁচের দেওয়াল জোড়া হোয়াইট বোর্ডে একটা জটিল মাইন্ড ম্যাপ তৈরি করেছিল। অভিনব চ্যাটার্জীর ছবির চারপাশে লাল এবং নীল কালিতে লেখা হচ্ছিল বিভিন্ন নাম, তত্ত্ব এবং প্রশ্নচিহ্ন। বোর্ডটা দেখতে অনেকটা মাকড়সার জালের মতো লাগছিল, যার কেন্দ্রে শিকার আটকে আছে, কিন্তু শিকারি কে, তা অজানা।
বিক্রম রাঠোর দিনে তিনবার করে ফোন করে তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইছিলেন এবং প্রতিবারই অনির্বাণের উত্তরে তার গলার স্বর আরও কর্কশ হচ্ছিল।
“কী হলো তোমার ডেটা অ্যানালিসিসের? এখনও কিছু বের করতে পারলে না? আমার সময় হলে আমি কবে চ্যাটার্জীর সবচেয়ে বড় রাইভালকে তুলে এনে ‘ট্রিটমেন্ট’ দিতাম। দেখবে গড়গড় করে সব বলে দিত।”
রাঠোরের কথাগুলো অনির্বাণকে বিরক্ত করলেও, সে জানত এটাই তার পরীক্ষা। এই কেসটা তাকে সমাধান করতেই হবে, নিজের পদ্ধতিতে।
চতুর্থ দিনের দুপুরে ফোনটা এল ফরেনসিক ল্যাব থেকে। ডক্টর প্রসূন সেনগুপ্তের গলা ছিল অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর এবং উত্তেজিত।
“অন, এখুনি একবার ল্যাবে আসতে পারবে? যা পেয়েছি, তা তুমি বিশ্বাস করবে না। আর ফোনে এক বর্ণও কথা বলা যাবে না।”
অনির্বাণ যখন ল্যাবে পৌঁছাল, তখন প্রসূন সেনগুপ্ত একটা কাঁচের ঘরের ভেতরে বসে ছিলেন, তার সামনে কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটা জটিল রাসায়নিক গঠনের ছবি। তার মুখে ছিল একজন বিজ্ঞানীর বিস্ময় এবং একজন মানুষের আতঙ্ক।
“এসো,” তিনি অনির্বাণকে বসতে বললেন। “আমরা টক্সিকোলজি রিপোর্টটা পেয়েছি। এবং এটা আমাদের ধারণার থেকেও অনেক বেশি অদ্ভুত।”
তিনি স্ক্রিনের দিকে দেখিয়ে বললেন, “এটা অভিনব চ্যাটার্জীর রক্তে পাওয়া বিষের মলিকিউলার স্ট্রাকচার। আমরা এটাকে আমাদের সমস্ত ডেটাবেসের সাথে মিলিয়ে দেখেছি। সায়ানাইড, আর্সেনিক, রিসিন, পোলোনিয়াম—কিচ্ছু নয়। এটা আধুনিক বিজ্ঞানের পরিচিত কোনো বিষ নয়।”
অনির্বাণ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “তাহলে এটা কী?”
“এটাই তো আসল প্রশ্ন। আমরা এর রাসায়নিক গঠনটা দেখে কিছু পুরনো আয়ুর্বেদিক এবং মধ্যযুগীয় রসায়নের বই ঘাঁটতে শুরু করি। ইন্টারনেটেও সার্চ করি। তারপর যা পেলাম…”
প্রসূন সেনগুপ্ত একটা পুরনো, হলদে হয়ে যাওয়া চামড়ায় বাঁধানো বইয়ের একটা পাতা খুলে অনির্বাণের দিকে এগিয়ে দিলেন। বইটার নাম ‘বঙ্গদেশের বিষবৃক্ষ ও তন্ত্রশাস্ত্র’।
“এই বই অনুযায়ী, এই বিষের নাম ‘নাগপুষ্প কালকূট’। গোখরার নিউরোটক্সিন বিষের সাথে হিমালয়ের তিনটি দুষ্প্রাপ্য লতা এবং পারদ মিশিয়ে এক বিশেষ তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অমাবস্যার রাতে এটা তৈরি করা হতো। এর প্রয়োগে মানুষ কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যায়। দেখে মনে হয় হার্ট অ্যাটাক, কিন্তু আসলে তার স্নায়ুতন্ত্রটা ভেতর থেকে গলে যায়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, আধুনিক টক্সিকোলজি স্ক্রিনে এটা প্রায় ধরাই পড়ে না। আমরাও প্রায় মিস করে গিয়েছিলাম।”
অনির্বাণের বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। “শেষবার এর ব্যবহার কবে হয়েছিল?”
“বই অনুযায়ী, শেষবার এর ব্যাপক ব্যবহারের কথা জানা যায় অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। বাংলার ঠগী, দস্যু এবং গুপ্তঘাতকরা এটা ব্যবহার করত তাদের শিকারকে নিঃশব্দে সরিয়ে দেওয়ার জন্য।”
অষ্টাদশ শতক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রা। আর এখন এই কালকূট বিষ। দুটো বিচ্ছিন্ন সূত্র এখন একটা ভয়ঙ্কর নকশার রূপ নিচ্ছিল। খুনি শুধু একজন সাধারণ অপরাধী নয়, সে ইতিহাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
“প্রসূন দা, এই বিষ এখনকার দিনে তৈরি করা কি সম্ভব?”
“তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। যে এটা বানিয়েছে, তার ভেষজবিদ্যা এবং রসায়ন—দুটোতেই ডক্টরেট থাকার মতো জ্ঞান থাকতে হবে। সে শুধু একজন খুনি নয়, সে একজন বিকৃতমনস্ক শিল্পী… যে তার শিল্পকর্মের স্বাক্ষর হিসেবে রেখে যাচ্ছে ইতিহাসের এক একটা টুকরো।”
ল্যাব থেকে বেরিয়ে অনির্বাণ সোজা নিজের অফিসে ফিরে এল। তার মাথা ঝিমঝিম করছিল। কে এই খুনি? কেন সে ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা পদ্ধতিতে খুন করছে? অভিনব চ্যাটার্জীর সাথে অষ্টাদশ শতকের কোনো নীলকর বা অত্যাচারী জমিদারের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?
সে তার টিমের সবচেয়ে দক্ষ সদস্য, সাব-ইন্সপেক্টর রানাকে ডেকে পাঠাল। “রানা, কাজটা কঠিন আমি জানি। কিন্তু আমাকে অভিনব চ্যাটার্জীর বংশলতিকা খুঁজে বের করে দিতে হবে। যতদূর সম্ভব… ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত।”
সন্ধ্যায় টিভিতে রিয়া চৌধুরীর প্রাইম-টাইম শো চলছিল। সে তার অনুষ্ঠানে দুজন ইতিহাসবিদ এবং একজন প্রাক্তন পুলিশ কর্তাকে নিয়ে বসেছিল। আলোচনার বিষয় ছিল অভিনব চ্যাটার্জীর রহস্যময় মৃত্যু। রিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে মুদ্রা এবং বিষের সম্ভাব্য ঐতিহাসিক যোগসূত্রের কথা বলছিল, যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে কিছুই সরকারিভাবে জানানো হয়নি।
“রিয়া খবরগুলো পায় কোথা থেকে?” অনির্বাণ বিড়বিড় করল। সে জানত, ডিপার্টমেন্টের ভেতর থেকেই কেউ তাকে খবর পাচার করছে।
অনুষ্ঠানে একজন তরুণ ইতিহাসবিদ বলছিলেন, “যদি এটা সত্যি হয় যে খুনি ঐতিহাসিক পদ্ধতি ব্যবহার করছে, তাহলে এর পেছনে কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতার চেয়েও বড় কোনো আদর্শগত কারণ থাকতে পারে। হয়তো কোনো ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিশোধ। এক ধরনের ঐতিহাসিক শুদ্ধিকরণ।”
প্রতিশোধ। শুদ্ধিকরণ। শব্দগুলো অনির্বাণের মাথায় হাতুড়ির মতো ঘা মারছিল।
রাত তখন প্রায় দুটো। শহরটা ঘুমিয়ে পড়েছে। অনির্বাণ তার অফিসের হোয়াইট বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল। বোর্ডের মাঝখানে অভিনব চ্যাটার্জীর ছবির পাশে এখন যোগ হয়েছে একটা মুদ্রার ছবি আর ‘কালকূট’ শব্দটা। ঠিক তখনই তার ব্যক্তিগত ফোনটা তীব্রস্বরে বেজে উঠল। সাব-ইন্সপেক্টর রানা।
“স্যার, একটা ভয়ংকর খবর আছে!” রানার গলা উত্তেজনায় এবং আতঙ্কে কাঁপছিল। “শহরের দক্ষিণে, টালিগঞ্জের এক বাগানবাড়িতে আর একটা হাই-প্রোফাইল মার্ডার হয়েছে!”
অনির্বাণের হৃৎপিণ্ডটা এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। “কে?”
“প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, বিমল মিত্র।”
অনির্বাণ দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে বুঝতে পারছিল, এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা একটা সিরিজের শুরু। খুনি তার দ্বিতীয় চালটা দিয়ে দিয়েছে, এবং সে বুঝিয়ে দিয়েছে যে তার তালিকাটা এখনও শেষ হয়নি। কলকাতা এক অদৃশ্য, বুদ্ধিমান এবং নির্মম শিকারির শিকারক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion