শহর থেকে অনেক দূরে, প্রায় এক পোড়ো শহরের প্রান্তে, বাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। দোতলা, পুরনো দিনের স্থাপত্য, আর তার গায়ে লেপ্টে থাকা বুনো লতার ঝাড়—সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা। অয়ন আর নীলা যখন প্রথম বাড়িটা দেখতে আসে, তখন নীলার বুকটা একটু ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। বাড়িটা বড্ড বেশি নির্জন, বড্ড বেশি চুপচাপ।
"জায়গাটা একটু বেশিই শান্ত, না?" নীলা তার স্বামী অয়নের হাতটা চেপে ধরে বলেছিল।
অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। "এই বাজেটে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব ছিল না, নীলা। তুমি তো জানো...।"
নীলা জানত। অয়নের ব্যবসায়িক ক্ষতি, শহরের ফ্ল্যাটের ই.এম.আই. (EMI) আর পিয়ার স্কুলের খরচ—সব মিলিয়ে তারা খাদের কিনারায় চলে এসেছিল। এই পুরনো, সস্তায় পাওয়া বাড়িটা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।
তাদের ছয় বছরের মেয়ে পিয়া অবশ্য বেশ খুশি। শহরের সেই দুটো ঘরের দমবন্ধ ফ্ল্যাট থেকে এখানে এসে সে যেন মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। বাড়ির পেছনে একটা ছোট জঙ্গল মতো আছে, সামনে মরচে পড়া দোলনা—পিয়ার জগতটা হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে গেছে।
নতুন বাড়িতে আসার এক সপ্তাহ পরের এক মেঘলা দুপুর। অয়ন ল্যাপটপ নিয়ে তার নতুন উপন্যাসের প্লট সাজাতে ব্যস্ত, আর নীলা গোছগাছ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একটু জিরোচ্ছিল। পিয়া সারা বাড়ি টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
"মা, ওপরে ওই সিঁড়িটা দিয়ে কোথায় যায়?" পিয়ার গলা শোনা গেল।
নীলা চমকে তাকাল। সে খেয়ালই করেনি বসার ঘরের এক কোণে একটা সরু, কাঠের সিঁড়ি পাকিয়ে ওপরে উঠে গেছে। বাড়িওয়ালা বলেছিল, "চিলেকোঠাটা বন্ধই থাকে, ওতে পুরনো জিনিসপত্র ছাড়া কিছু নেই।"
"ওটা চিলেকোঠা, সোনা। ওখানে ধুলোবালি ছাড়া কিছু নেই। তুমি নিচে খেলো," নীলা বলল।
"একবার যাব? প্লিজ?" পিয়ার গলায় আবদার।
অয়ন লেখার থেকে মুখ না তুলেই বলল, "যেতে দাও না, নীলা। বাচ্চা মেয়ে, কৌতূহল তো হবেই। সাবধানে যাস মা, দেখে পা ফেলিস।"
পিয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠল। সরু সিঁড়ি বেয়ে সে একাই ওপরে উঠতে শুরু করল। কাঠের সিঁড়িতে তার ছোট ছোট পায়ের চাপে 'ক্যাঁচ ক্যাঁচ' শব্দ হতে লাগল।
চিলেকোঠার দরজাটা ঠেলতেই একটা ভ্যাপসা, পুরনো গন্ধ পিয়ার নাকে এসে ঝাপটা মারল। ঘরটা অন্ধকার। ছাদের এক কোণের ভাঙা ভেন্টিলেটর দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে, সেই আলোয় ধুলোর কণাগুলো হীরের মতো ভাসছে। বড় বড় সাদা কাপড়ে ঢাকা আসবাবপত্রগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন একদল ভূত একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পিয়ার একটুও ভয় করল না। সে তার ফ্রকের পকেট থেকে বাবার দেওয়া ছোট টর্চটা বের করল। আলো ফেলতেই সে দেখল, এক কোণে একটা পুরনো কাঠের সিন্দুক। সিন্দুকটার ডালাটা অল্প খোলা।
কৌতূহলে পিয়া সেটার দিকে এগিয়ে গেল। ডালাটা সরাতেই সে দেখল, ভেতরে অনেক পুরনো সিল্কের শাড়ি, আর তার মধ্যে সযত্নে শোয়ানো একটা কাপড়ের পুতুল।
পুতুলটা খুব যে সুন্দর তা নয়। পুরনো, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কাপড়ে তৈরি। গায়ের রঙটা ময়লাটে সাদা। দুটো কালো বোতাম দিয়ে চোখ বানানো। লাল সুতো দিয়ে সেলাই করা একটা অদ্ভুত হাসি। পরনে একটা মখমলের জামা, যার রঙ একসময় शायद গাঢ় নীল ছিল, এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
পিয়া হাত বাড়াল। পুতুলটা হাতে নিতেই তার মনে হলো, ওটা বড্ড নরম আর ভারী। সে পুতুলটাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। "কী সুন্দর তুমি! তোমার কোনো নাম নেই? আমি তোমার নাম দিলাম 'মণি'।"
পিয়া যখন মণি কে নিয়ে নিচে নেমে এলো, তখন নীলা রান্নাঘরে।
"মা, দেখো আমি কী পেয়েছি!"
নীলা ঘুরে তাকাতেই তার কপালে ভাঁজ পড়ল। "ইশ! কী নোংরা পুতুল এটা! কোথা থেকে আনলি? ফেলে দে, ওতে জীবাণু আছে।"
"না!" পিয়া মণি কে বুকের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল। "এটা আমার বন্ধু। আমি এটা চিলেকোঠা থেকে পেয়েছি।"
অয়নও বসার ঘরে চলে এসেছিল। সে পুতুলটা দেখে হাসল। "আরে, থাক না। পুরনো দিনের জিনিস, বেশ অ্যান্টিক। পরিষ্কার করে দিলেই হবে। পিয়ার যখন এত পছন্দ।"
নীলার মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। পুতুলটার বোতামের চোখ দুটো যেন বড্ড বেশি জীবন্ত। আর ওই সেলাই করা হাসিটা... কেমন যেন সবজান্তা!
"ঠিক আছে," নীলা অনিচ্ছাকৃতভাবে বলল। "দাঁড়া, আমি এটা ডেটল দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছি।"
সেদিন রাত থেকে মণি পিয়ার বিছানার দখল নিল। পিয়া তাকে ছাড়া ঘুমায় না। নীলা মাঝরাতে প্রায়ই জেগে উঠে দেখত, পিয়া পুতুলটাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে কথা বলছে। ছোট বাচ্চার খেলা ভেবে সে আর বিশেষ পাত্তা দেয়নি।
কিন্তু দিন সাতেক পর প্রথম অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল।
নীলা কিছুতেই তার সোনার আংটিটা খুঁজে পাচ্ছিল না। ওটা তার শাশুড়ির দেওয়া শেষ স্মৃতি। প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা তার। সারা বাড়ি তোলপাড় করে খুঁজছে সে।
পিয়া ধীর পায়ে তার কাছে এল। তার কোলে মণি।
"কী খুঁজছ, মা?"
"আমার আংটিটা, সোনা। দেখেছিস তুই?" নীলা প্রায় মরিয়া হয়ে বলল।
পিয়া কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। সে পুতুলটার দিকে তাকাল, যেন কিছু শুনছে। তারপর অদ্ভুত শান্ত গলায় বলল, "আংটি তো বাবার ওই কালো ডায়েরিটার নিচে। তুমি যখন জলখাবার দিতে গেলে, বাবা তখন ডায়েরিটা আংটির ওপর রেখে দিয়েছিল।"
নীলার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। কথাটা সত্যি। অয়ন সকালে কিছু একটা লেখার জন্য তার পুরনো একটা ডায়েরি বের করেছিল বটে। নীলা দৌড়ে বসার ঘরে গেল। অয়নের ডায়েরিটা সরাতেই... হ্যাঁ, ওখানেই আছে আংটিটা।
সে পিয়ার কাছে ফিরে এল। "তুই কী করে জানলি, মা?"
পিয়া মণি কে বুকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল। "আমি জানি না। মণি বলল।"
নীলা পুতুলটার দিকে তাকাল। তার সেলাই করা হাসিটা যেন আরও চওড়া হয়েছে বলে মনে হলো।
এর ঠিক দুদিন পর। অয়ন ল্যাপটপে কাজ করছিল। হঠাৎ করেই সে খেপে উঠল। "নীলা! আমার পেনড্রাইভটা দেখেছ? কালকের লেখাটা ওতে সেভ করা আছে। সর্বনাশ হয়ে যাবে যদি না পাই!"
নীলা কিছু বলার আগেই পিয়ার গলা শোনা গেল। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মণি কে দোল খাওয়াচ্ছিল।
"বড় রাস্তার মোড়ের ওই ফটোকপির দোকানে ফেলে এসেছ, বাবা। ওই যে লাল জামা পরা কাকুটা, ওনার টেবিলের ড্রয়ারে আছে।"
অয়ন চমকে উঠল। "তোর মা তোকে বলেছে?"
"না। মণি বলল।"
অয়ন আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। সে প্রায় দৌড়ে দোকানে গেল। এবং আধ ঘণ্টা পর যখন ফিরে এল, তার মুখটা ফ্যাকাশে। পেনড্রাইভটা ঠিক ওখানেই ছিল। দোকানদার খেয়ালই করেনি।
"কীভাবে সম্ভব?" অয়ন ফিসফিস করে নীলাকে জিজ্ঞেস করল। "পিয়া তো আমার সাথে কাল দোকানে যায়নি!"
নীলা আর অয়ন, দুজনেই তাদের মেয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। পিয়া তখন বিছানায় বসে মণি কে গল্প শোনাচ্ছিল।
"...আর তারপর দাদুভাইটা আকাশের তারা হয়ে গেল। মা খুব কাঁদল। কিন্তু বাবা কাঁদল না। বাবা শুধু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেল। অনেক সিগারেট।"
নীলা তার মুখে হাত চাপা দিল। এটা তার বাবার মৃত্যুর দিনের ঘটনা। পিয়ার তখন বয়স মাত্র তিন বছর। এত স্পষ্ট করে সব কথা মনে থাকার কথা নয়। বিশেষ করে অয়নের ওই সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা... ওটা তো সেও খেয়াল করেনি!
"পিয়া," অয়ন একটু শক্ত গলায় ডাকল।
পিয়া ঘুরে তাকাল। তার চোখ দুটো অদ্ভুত সরল।
"এই পুতুলটা তোকে এসব কথা বলছে?"
পিয়া মাথা নাড়ল। "হ্যাঁ। মণি সব জানে। মণি বলে, ও অনেক দিন ধরে এই বাড়িতে আছে। ও সব দেখেছে।"
নীলা আর সহ্য করতে পারল না। সে ঘরে ঢুকে একরকম ছোঁ মেরে পুতুলটাকে পিয়ার কোল থেকে কেড়ে নিল। "অনেক হয়েছে! এই অলক্ষুণে পুতুল আর এ বাড়িতে থাকবে না!"
"না! আমার মণি কে দাও!" পিয়া চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
"নীলা, কী করছ?" অয়নও হতভম্ব।
"তুমি বুঝতে পারছ না?" নীলার গলা কাঁপছিল। "এটা সাধারণ পুতুল নয়! এটা পিয়ার মাথা খাচ্ছে! আমি এটাকে এখুনি ফেলে দেব!"
নীলা পুতুলটাকে নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ির পেছনের জঙ্গলের দিকে গেল। সেখানে একটা পুরনো, শুকনো কুয়ো ছিল। নীলা এক মুহূর্তও না ভেবে পুতুলটাকে কুয়োর অন্ধকারের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। একটা হালকা 'ধুপ' করে শব্দ হলো।
পিয়া তখনো ঘরের ভেতর থেকে চিৎকার করে কাঁদছে।
সেদিন রাতে পিয়ার খুব জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে সে একটাই নাম বিড়বিড় করতে লাগল, "মণি... আমার মণি... ওকে ফিরিয়ে আনো... ও একা ভয় পাচ্ছে...।"
নীলা সারা রাত মেয়ের মাথায় জলপটি দিল। তার মনটা অনুশোচনায় ভরে গেল। হয়তো সে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। ওটা হয়তো শুধুই 'কনসিডেন্স' (coincidence) ছিল।
ভোরের দিকে পিয়ার জ্বরটা একটু কমল। ক্লান্ত নীলা মেয়ের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে অয়নের চিৎকারে তার ঘুম ভাঙল। "নীলা! নীলা! সর্বনাশ হয়েছে!"
নীলা ধড়মড় করে উঠে বসল। "কী হয়েছে? পিয়া ঠিক আছে তো?"
সে দেখল পিয়া বিছানায় নেই।
তারা সারা বাড়ি খুঁজল। কোথাও পিয়া নেই।
"কোথায় গেল মেয়েটা?" নীলার গলা শুকিয়ে আসছিল।
অয়ন দৌড়ে পেছনের বাগানে গেল। আর তারপরই সে দৃশ্যটা দেখল।
শুকনো কুয়োটার পাশে পিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার সারা গায়ে কাদা মাখামাখি। সে শীতে কাঁপছে। আর তার কোলে... সেই পুতুলটা। মণি।
পুতুলটাও কাদায় মাখা। তার একটা বোতামের চোখ খুলে পড়ে গেছে, একটা হাত ছিঁড়ে ঝুলছে। কিন্তু তার সেলাই করা হাসিটা এখনো একই রকম আছে।
"পিয়া! কী করে এলি এখানে?" নীলা দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল।
পিয়া তার মায়ের দিকে তাকাল না। সে একদৃষ্টে পুতুলটার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর একটা অদ্ভুত, ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, যা তার নিজের গলার স্বর নয়—
"মণি কে খুব লেগেছে। মণি খুব রেগে গেছে।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion