Episode 21425 words1 views

দ্বিতীয় অধ্যায়: মণির অভিশাপ

পিয়ার সেই অদ্ভুত, অচেনা স্বরের কথাটা শোনার পর অয়ন আর নীলা কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল। সকালের ঠান্ডা বাতাসটা হঠাৎ করেই যেন আরও কয়েক ডিগ্রি শীতল হয়ে গেল। নীলাই প্রথম সম্বিত ফিরে পেল। সে পিয়ার সেই ফ্যাসফ্যাসে স্বরের পুনরাবৃত্তি করতে চাইল না। সে এক ঝটকায় পিয়াকে পাঁজা করে কোলে তুলে নিল, সাথে সেই কাদা-মাখা, বীভৎস পুতুলটাও উঠে এল। "অয়ন, চলো! এক্ষুনি ভেতরে চলো! ওর গা বরফের মতো ঠান্ডা!" অয়ন যন্ত্রচালিতের মতো তাদের পেছন পেছন ঘরে ঢুকল। বসার ঘরের সোফায় নীলা পিয়াকে বসাল। পিয়া কোনো বাধা দিল না। সে শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মণিকে কোলের ওপর রেখেই। পুতুলটার সেই একটা মাত্র বোতামের চোখ যেন সারা ঘরের ওপর নজর রাখছে। "পিয়া... মা... তুই ঠিক আছিস?" নীলা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল। পিয়া কোনো উত্তর দিল না। সে তার ছোট ছোট আঙুল দিয়ে মণির ছেঁড়া হাতটা সেলাই করার চেষ্টা করতে লাগল, যদিও সেখানে কোনো সুচ-সুতো ছিল না। অয়ন এইবার প্রথম কথা বলল। তার গলাটা অস্বাভাবিক রকম শান্ত শোনাচ্ছিল। "নীলা, বাথরুমে যাও। গরম জল করো। ওকে পরিষ্কার করতে হবে।" নীলা উঠে দাঁড়াতেই পিয়া আবার সেই গলায় কথা বলে উঠল। "মা'কে যেতে দিও না। মা মণি'কে আবার ফেলে দেবে।" নীলা থমকে দাঁড়াল। "না সোনা, আমি কোথাও ফেলব না। আমি... আমি ওটাকে পরিষ্কার করে দেব।" "মিথ্যে কথা!" পিয়ার গলার স্বরটা এবার তীক্ষ্ণ শোনাল। "মণি জানে তুমি মিথ্যে কথা বলো। মণি তোমার ওপর খুব রেগে আছে।" অয়ন দেখল, এটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। সে নীলার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বাথরুমে যেতে বলল, আর নিজে পিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। "পিয়া, বাবা," সে নরম গলায় ডাকার চেষ্টা করল। "কী হয়েছে আমাদের বলো। তুমি ওই কুয়োর কাছে গেলে কেন? কত উঁচুতে তালা দেওয়া গেট... তুমি ওটা টপকালে কী করে?" পিয়া বাবার দিকে তাকাল। তার চোখ দুটো ঘোলাটে। "আমি যাইনি। মণি ডেকেছে।" "মণি ডেকেছে? একটা পুতুল কী করে ডাকবে?" "মণি সব পারে," পিয়া খুব সহজভাবে বলল। "মণি বলেছে, ও আমার বন্ধু। আর তোমরা আমার শত্রু। তোমরা মণি'কে কষ্ট দিয়েছ।" এই কথা শোনার পর অয়নের আর কোনো সন্দেহ রইল না। তাদের মেয়ে কোনো একটা ভয়ঙ্কর কিছুর পাল্লায় পড়েছে। সে জোর করে পিয়ার কোল থেকে পুতুলটা নিতে গেল না। সে জানে, তাতে হিতে বিপরীত হবে। নীলা গরম জল আর তোয়ালে নিয়ে ফিরে এল। দুজনে মিলে খুব সাবধানে পিয়ার গায়ের কাদা পরিষ্কার করল। পিয়া কোনো আপত্তি করল না, যেন সে একটা জড়বস্তু। কিন্তু পুতুলটাকে সে এক মুহূর্তের জন্যও কোলছাড়া করল না। নীলা যখনই পুতুলটা ধুতে চেয়েছে, পিয়া বাঘিনীর মতো গর্জে উঠেছে। "মণি কে ছোঁবে না! মণি'র গায়ে জল লাগবে!" অগত্যা, সেই কাদা-মাখা পুতুল কোলেই পিয়াকে জামাকাপড় পাল্টে দিল নীলা। সারাটা দিন একটা অদ্ভুত থমথমে পরিবেশে কাটল। পিয়া তার ঘর থেকে বেরোল না। সে বিছানায় বসে শুধু মণির সাথে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। অয়ন আর নীলা বসার ঘরে একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসে রইল। "কী করবে ভাবছ?" নীলা প্রথম নীরবতা ভাঙল। তার স্বর কান্নায় বুজে আসছিল। "আমি জানি না," অয়ন কপালে হাত দিয়ে বলল। "আমি কী করে জানব? এটা কোনো... কোনো মানসিক সমস্যা? পিয়ার কি ডাক্তার দরকার?" "এটা মানসিক সমস্যা নয়, অয়ন!" নীলা প্রায় চিৎকার করে উঠল। "তুমি দেখোনি ওর চোখ? তুমি শোনোনি ওর গলা? আর ওই আংটি আর পেনড্রাইভের ঘটনা? ওগুলো কী?" "তাহলে কী? ব্ল্যাক ম্যাজিক? তন্ত্র? এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলছ?" অয়ন হতাশভাবে বলল। "আমি কিছু জানি না," নীলা দু'হাতে মুখ ঢাকল। "আমি শুধু জানি, আমার মেয়ে আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। ওই পুতুলটা ওকে কেড়ে নিচ্ছে।" অয়ন উঠে দাঁড়াল। সে একজন লেখক। তার যুক্তিবাদী মন এখনো হার মানতে চাইছে না। "এই বাড়ির কোনো ইতিহাস আছে। বাড়িওয়ালাকে ফোন করতে হবে। এই পুতুলটা কোত্থেকে এল, আমাদের জানতেই হবে।" সে ফোনটা তুলে নিল। কিন্তু কোনো নেটওয়ার্ক নেই। শহরের বাইরে এই বাড়িটায় প্রায়ই নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়। "ধুত্তেরি!" অয়ন ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিল সোফায়। ঠিক সেই মুহূর্তে রান্নাঘর থেকে একটা বিকট শব্দ হলো। 'ঝনঝনঝন!' নীলা চমকে উঠে সেদিকে দৌড়াল। অয়নও পিছু নিল। তারা দেখল, নীলার খুব শখের কাচের জগ আর গ্লাসের সেটটা, যেটা সে সেলফে সাজিয়ে রেখেছিল, সেটা মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। "কী করে হলো?" নীলা ফ্যাকাশে মুখে বলল। "ওটা তো অনেক ভেতরে রাখা ছিল!" "ইঁদুর হবে হয়তো," অয়ন বললেও তার নিজের কথাতেই তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তারা যখন ভাঙা কাচ সরাচ্ছিল, তখন পিয়া তার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তার কোলে মণি। সে দরজায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। তার মুখে কোনো ভাবাবেগ নেই। "মণি বলছিল," পিয়া শান্ত গলায় বলল, "ভাঙা কাচে পা দিলে খুব লাগে। রক্ত বেরোয়।" নীলার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে আর এক মুহূর্তও রান্নাঘরে দাঁড়াল না। সেদিন দুপুরের পর ঘটল আসল দুর্ঘটনা। নীলা একটু কফি বানানোর জন্য রান্নাঘরে গিয়েছিল। অয়ন তখনো ফোন নিয়ে বাড়ির এদিক-ওদিক নেটওয়ার্কের জন্য পায়চারি করছে। নীলা গ্যাস জ্বালিয়ে কেটলিতে জল বসাল। সকালের মানসিক ধকলে সে ক্লান্ত, অন্যমনস্ক। জলটা যখন ফুটতে শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় সে শুনতে পেল পিয়া তার ঘরের ভেতর থেকে ছড়া কাটার মতো করে কিছু একটা বলছে। "আগুন... আগুন... জল গরম...। মায়ের হাত... নরম নরম...।" নীলা ভুরু কুঁচকে ভাবল, এটা আবার কী ধরনের ছড়া? সে কেটলিটা নামাতে যাবে, এমন সময় পিয়া দৌড়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। তার এক হাতে মণি। "মা!" সে চিৎকার করে ডাকল। নীলা চমকে তার দিকে ফিরল। "কী হয়েছে? অমন করে চেঁচাচ্ছিস কেন?" পিয়া কিছু বলল না। সে শুধু তার পুতুলটাকে উঁচু করে ধরল। মণির সেই একটা মাত্র বোতামের চোখ যেন নীলার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর পুতুলটার সেই সেলাই করা হাসি... নীলার হঠাৎ করেই মাথাটা ঘুরে গেল। তার মনে হলো, রান্নাঘরটা দুলছে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। সে ভারসাম্য রাখতে না পেরে গরম কেটলিটা ধরা হাত দিয়েই স্ল্যাবে একটা ধাক্কা দিল। ফুটন্ত গরম জলসুদ্ধ কেটলিটা উল্টে গেল। "আআআআআআ!" নীলার যন্ত্রণাকাতর চিৎকারে অয়ন ছুটে এল। সে দেখল, নীলা মেঝেতে বসে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার পুরো ডান হাতটা কনুই পর্যন্ত টকটকে লাল হয়ে গেছে। ফোসকা পড়তে শুরু করেছে। আর দরজায় পিয়া নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে ভয়ের বদলে এক অদ্ভুত নিরাসক্ত ভাব। "কী করে হলো এটা?" অয়ন নীলাকে তুলতে তুলতে চিৎকার করে উঠল। "আমি... আমি জানি না... মাথাটা ঘুরে গেল...।" নীলা যন্ত্রণার মধ্যেও পিয়ার দিকে তাকাল। পিয়া ধীর পায়ে তার পুতুলটাকে দেখাল। তারপর সেই অদ্ভুত গলায় বলল, "মণি'কে কষ্ট দিলে মণিও কষ্ট দেয়। মণি বলেছে, এটা শুধু শুরু।" অয়নের বুকের ভেতরটা জমে গেল। সে নীলাকে ধরে ধরে ঘরের বাইরে আনতে আনতে দেখল, পিয়া ঘুরে তার ঘরে চলে যাচ্ছে। তার হাঁটার ভঙ্গিতে একটা অদ্ভুত দোলুনি, যা তার ছয় বছরের মেয়ের মতো নয়। সেদিন রাতেই অয়ন ঠিক করল, এই বাড়ি আর এক মুহূর্তও নয়। কাল সকালেই তারা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। যে কোনো মূল্যে। সে নীলার হাতে বার্নল লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। নীলা ব্যথার ওষুধ খেয়ে আধো-ঘুমে আচ্ছন্ন। অয়ন তার ল্যাপটপটা খুলল। নেটওয়ার্ক নেই, কিন্তু সে তার পুরনো একটা রিসার্চ ফোল্ডার খুলল। এই এলাকাটা নিয়ে সে একসময় একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখবে ভেবেছিল। কিছু নোটস কি সে রেখেছিল? হ্যাঁ, ছিল। একটা পুরনো লোককথা। "শোনা যায়," অয়ন বিড়বিড় করে পড়তে লাগল, "ওই পুরনো জমিদার বাড়িতে এক মেয়ে ছিল... নাম মণিকুন্তলা। বড়ই খামখেয়ালি। তার একটা প্রিয় পুতুল ছিল। শোনা যায়, তার বাবা কোনো এক জাদুকরের থেকে ওটা আনিয়েছিলেন মেয়ের আবদারে। পুতুলটা নাকি মেয়ের সাথে কথাও বলত। কিন্তু একদিন...।" অয়ন পড়া থামিয়ে দিল। তার টাইপ করা নোটস অসম্পূর্ণ। "কিন্তু একদিন... কী?" সে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। সে ঠিক করল, পিয়ার ঘরটা একবার দেখে আসবে। পিয়ার ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল। অয়ন দরজায় কান পাতল। ভেতর থেকে ফিসফিসানির শব্দ আসছে। পিয়ার গলা। "হ্যাঁ মণি। আমি শুনেছি। বাবা সব পড়ে ফেলছিল।" অয়ন চমকে গেল। ও কী করে জানল? তারপর সে আরও একটা শব্দ শুনল। পিয়ার গলা নয়। একটা শুকনো, খসখসে শব্দ। যেন কেউ পুরনো কাগজে লিখছে। বা... বা শুকনো পাতা মাড়িয়ে যাচ্ছে। একটা ফ্যাসফ্যাসে স্বর, যা ঠিক কথা নয়, কিন্তু কথার মতোই শোনায়। অয়ন বুঝতে পারল, মণি পিয়াকে কিছু বলছে। তারপর পিয়ার গলাটা আবার স্পষ্ট হলো। "না, মণি। বাবাকে না। বাবা মণি'কে কিছু করেনি। মা করেছে। মা'কে শাস্তি দিয়েছ।" কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর পিয়া আবার বলল। তার গলাটা এবার খুব খুশি শোনাচ্ছিল। "ও আচ্ছা! তাই বুঝি? হ্যাঁ, আমি পারব। আমি সব পারব। তুমি যা বলবে, আমি তাই করব। আমি তোমার জন্য সব করব, মণি।" অয়ন আর সহ্য করতে পারল না। সে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকল। "পিয়া!" পিয়া বিছানায় বসে ছিল। ঘর অন্ধকার। জানালার পর্দাটা সরে গেছে, চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঠিক বিছানার ওপর। পিয়া তার দিকে মুখ ফেরাল। তার কোলে মণি। "বাবা, তুমি এখনো জেগে আছ?" পিয়ার গলার স্বর একদম স্বাভাবিক, মিষ্টি। "কার সাথে কথা বলছিলি?" অয়ন ঘরের আলোটা জ্বালল। "মণির সাথে," পিয়া হাসল। "মণি আমাকে একটা নতুন খেলা শিখিয়েছে।" "কী খেলা?" অয়নের গলা শুকিয়ে আসছিল। "লুকোচুরি," পিয়া পুতুলটাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। "মণি বলেছে, কাল সকালে আমরা সবাই লুকোচুরি খেলব। মা'কে খুঁজে বের করতে হবে। মা যদি ভালো করে না লুকোয়, তাহলে মা হেরে যাবে।" পিয়া খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই হাসিতে কোনো সারল্য ছিল না। সেই হাসিটা শুনে অয়নের মনে হলো, তার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। সে দেখল, পুতুলটার যে চোখটা পড়ে গিয়েছিল, সেই খালি জায়গায় এখন একটা কালো গহ্বর। আর সেই গহ্বরের ভেতর থেকে যেন দুটো লাল আগুনের বিন্দু তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion