ছয় মাস পর।
শহরের এক কোণে একটা ছোট, দু'কামরার ফ্ল্যাট। জানালার কাচ দিয়ে বিকেলের উজ্জ্বল রোদ এসে পড়েছে ঘরের সাদা দেয়ালে। এখানে কোনো চিলেকোঠা নেই, কোনো ভ্যাপসা গন্ধ নেই, কোনো পুরনো আসবাব নেই। সবকিছুই নতুন, ভাড়া করা, আর সাধারণ।
নীলা কফি বানাচ্ছিল। তার ডান হাতে, কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত, একটা লম্বা, গোলাপি রঙের পোড়া দাগ। ডাক্তার বলেছেন, দাগটা পুরোপুরি কখনো যাবে না। এটা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া দুঃস্বপ্নের একটা স্থায়ী চিহ্ন হয়ে থাকবে।
পিয়া মেঝেতে বসে আঁকার খাতা নিয়ে ব্যস্ত। সে একটা ছবি আঁকছে—একটা পার্ক, অনেক ফুল, আর তার মধ্যে সে তার বাবা-মা'র হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে এখন আবার আগের মতো হাসিখুশি, চঞ্চল। সেই অভিশপ্ত বাড়ির কোনো স্মৃতি... মণির কোনো স্মৃতি... তার আর মনে নেই। ডাক্তাররা একে 'পোস্ট-ট্রমাটিক অ্যামনেসিয়া' বলেছেন। অয়ন আর নীলার জন্য এটাই ছিল আশীর্বাদ।
অয়ন বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে তার সদ্য প্রকাশিত বইটা। 'চিলেকোঠার পুতুল'। সে শেষ পর্যন্ত তাদের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথাই লিখেছে, কিছুটা কল্পনার রঙ চড়িয়ে। বইটা অদ্ভুতভাবে পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। এই বইয়ের আয় দিয়েই তারা এই নতুন জীবনটা শুরু করতে পেরেছে।
"বাবা, দেখো!" পিয়া খাতাটা নিয়ে তার কাছে দৌড়ে এল।
অয়ন ঝুঁকে পড়ে ছবিটা দেখল। খুব সুন্দর এঁকেছে সে। হাসিখুশি তিনটে মানুষ। কিন্তু অয়নের চোখটা পড়ল ছবির এক কোণে।
পিয়া পার্কের পাশে একটা বাড়ির ছবি এঁকেছে। একটা পুরনো, দোতলা বাড়ি। আর সেই বাড়ির জানালার কাছে একটা ছোট্ট কালো বিন্দুর মতো কিছু একটা এঁকে, পরক্ষণেই সেটা হিজিবিজি করে কেটে দিয়েছে।
"এটা কী, মা?" অয়ন সেই কাটা জায়গাটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল।
পিয়া ভুরু কুঁচকে তাকাল। "জানি না তো। একটা পোকা হবে হয়তো। ওটা খুব পচা ছিল, তাই কেটে দিলাম।" সে খাতাটা নিয়ে আবার খেলতে চলে গেল।
অয়নের বুকটা এক মুহূর্তের জন্য ধড়াস করে উঠল। পিয়ার কিছু মনে নেই, কিন্তু তার অবচেতন মন... সেই অন্ধকারকে ভোলেনি।
নীলা কফির মগ হাতে তার পাশে এসে দাঁড়াল। "কী ভাবছ?"
"ভাবছি, আমরা কতটা ভাগ্যবান," অয়ন নীলার কাঁধে হাত রাখল। সে নীলার হাতের পোড়া দাগটার ওপর আলতো করে হাত বোলাল।
"আমরা বেঁচে আছি, অয়ন," নীলা তার বুকে মাথা রাখল। "সেটাই অনেক।"
সেই বাড়িটা তারা আর ফিরেও তাকায়নি। অয়ন শুধু খবরের কাগজে পড়েছিল, এক প্রবল ঝড়ে বাড়িটার একটা বড় অংশ, বিশেষ করে চিলেকোঠাটা, সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। সেই অভিশপ্ত কুয়োটাও মাটির তলায় ধসে গেছে।
মণিকুন্তলার গল্পটা মাটির সাথেই মিশে গেছে।
সেদিন রাতে, অয়ন আর নীলা যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন পিয়া ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
নীলা ধড়মড় করে উঠে বসল। "কী হয়েছে, সোনা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?"
পিয়া ঘুমের ঘোরেই তার মা'কে জড়িয়ে ধরল। "একটা পচা পুতুল... ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল...।"
নীলা পিয়াকে বুকের মধ্যে জোরে চেপে ধরল। "কিছু নেই, মা। কিচ্ছু নেই। ওটা শুধু স্বপ্ন। মা তো আছে তোর কাছে।"
অয়ন দরজায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল। সে জানে, সেই শয়তানটা মরে গেছে। পুতুলটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু তার ছায়া... সেই ছায়াটা হয়তো তাদের মন থেকে কোনোদিনই পুরোপুরি যাবে না।
তারা সেই অভিশপ্ত বাড়ি থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু সেই বাড়ির একটা অংশ হয়তো সারা জীবন তাদের স্মৃতির মধ্যে বন্দী হয়ে থাকবে।
অয়ন গিয়ে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল। অন্ধকারটা কেটে যেতেই পিয়া আবার শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
অয়ন, নীলা আর পিয়া—তিনজন আহত, ক্ষতবিক্ষত, কিন্তু একসাথে। তারা জানে, এই ক্ষত নিয়েই তাদের বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। কারণ কিছু কিছু ফিসফিসানি একবার শুরু হলে, তা আর কখনো পুরোপুরি শেষ হয় না।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion