"শয়তানটা চলে গেছে, কিন্তু তারা এখনো এই অভিশপ্ত বাড়ির ভেতরে বন্দী।"
অয়নের কানের মধ্যে শেষ কথাটাই যেন বাজছিল। সে নীলাকে ধরে, পিয়ার হাত ধরে, টলতে টলতে দরজার কাছে গেল।
সে দরজার হাতলে চাপ দিল। খুলল না।
সে সজোরে ধাক্কা মারল। দরজাটা একচুলও নড়ল না।
"না... না... এটা হতে পারে না..." অয়ন পাগলের মতো দরজায় কিল মারতে শুরু করল। তার পাঁজরের ব্যথাটা তীব্র হয়ে উঠল। "ও তো মরে গেছে! পুতুলটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! তাহলে কেন?"
নীলা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। তার পোড়া হাতের যন্ত্রণা, এতক্ষণের আতঙ্ক, আর এখন এই নতুন হতাশা—সব মিলিয়ে তার সব শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল। "অয়ন, আমরা কি এখানেই... এখানেই শেষ হয়ে যাব?"
পিয়া, যে এতক্ষণ তার বাবা-মা'কে জড়িয়ে ধরে কাঁপছিল, সে এবার মুখ তুলল। তার চোখ দুটো ফোলা, কিন্তু সেই ঘোলাটে, পৈশাচিক ভাবটা আর নেই। সে তার নিজের গলায়, একটা ছোট্ট বাচ্চার গলায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। "বাবা, আমার ভয় করছে। বাড়ি চলো।"
এই প্রথমবার, এতগুলো দিনের মধ্যে এই প্রথমবার পিয়া 'বাড়ি চলো' বলল।
অয়নের মনটা এই একটা কথাতেই যেন নতুন করে শক্তি পেল। সে তার মেয়েকে এই নরকে আর এক মুহূর্তও থাকতে দেবে না।
"আমরা যাব মা। এখুনি যাব," অয়ন বলল।
সে আবার দরজাটা পরীক্ষা করল। শয়তান আত্মাটা যখন তার শক্তি প্রয়োগ করেছিল, তখন দরজাটা একটা অশুভ শক্তি দিয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন...
অয়ন দরজায় কান পাতল। কোনো ফিসফিসানি নেই। কোনো ঠান্ডা বাতাস নেই। চিলেকোঠাটা এখন শুধু একটা পুরনো, ধুলোমাখা ঘর। সেই পৈশাচিক উপস্থিতিটা সম্পূর্ণ চলে গেছে।
"তাহলে?"
অয়ন আবার হাতলটা ঘোরাল। সে সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল।
'ক্যাঁ... ক্যাঁচ... মড়... মড়...'
দরজাটা নড়ল!
"অয়ন!" নীলা আশা নিয়ে তাকাল।
অয়ন বুঝতে পারল। শয়তানটা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই সেই অশুভ বাঁধনটাও কেটে গেছে। দরজাটা এখন আর কোনো জাদুবলে বন্ধ নেই। ওটা শুধু একটা খুব পুরনো, জ্যাম হয়ে যাওয়া কাঠের দরজা।
"নীলা, আমাকে সাহায্য করতে হবে!" অয়ন চিৎকার করল।
সে কাঁধ দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। নীলা তার সুস্থ বাঁ হাতটা দিয়ে অয়নের পিঠে চাপ দিল। পিয়াও তার ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে দরজায় ধাক্কা মারতে লাগল।
"এক... দুই... তিন...!"
'দড়াম!'
পুরনো ছিটকিনিটা সজোরে ভেঙে ছিটকে পড়ল। দরজাটা এক ঝটকায় খুলে গেল।
বাইরে... সিঁড়ির অন্ধকার। কিন্তু সে অন্ধকার এখন আর জীবন্ত নয়। ওটা শুধু আলো-হীনতার অন্ধকার।
অয়ন এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। সে এক হাতে পিয়াকে কোলে তুলে নিল, অন্য হাত দিয়ে নীলাকে জড়িয়ে ধরল। "চলো! দৌড়াও! পেছনে তাকাবে না!"
তারা তিনজন প্রায় আছড়ে পড়তে পড়তে সেই সরু, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল। বসার ঘরটা পার হলো। সেই রান্নাঘর, যেখানে নীলার হাত পুড়েছিল—সেটা এখন শান্ত। বারান্দা...।
পুরো বাড়িটা যেন একটা দীর্ঘ, ভয়ঙ্কর ঘুমের পর জেগে উঠেছে। অথবা... মরে গেছে। সেই অশুভ 'বেঁচে' থাকা ভাবটা আর নেই।
অয়ন সদর দরজাটা খুলল।
ভোরের ঠান্ডা, পরিষ্কার বাতাস তাদের মুখে এসে লাগল। অয়ন জীবনের প্রথমবার এত নির্মলভাবে শ্বাস নিল।
"গাড়িতে! এখুনি!"
সে নীলাকে কোনোমতে প্যাসেঞ্জার সিটে বসাল। পিয়াকে পেছনের সিটে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসল। তার হাত কাঁপছিল। সে চাবিটা ইগনিশনে ঢুকিয়ে ঘোরাল।
'খট... খট... ঘড়ঘড়...'
গাড়ি স্টার্ট নিল না।
"না... এখন না... প্লিজ..." অয়ন আবার চেষ্টা করল।
'ঘড়ঘড়... ঘড়... ভ্রুম!'
ইঞ্জিনটা গর্জে উঠল।
অয়ন আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। সে অ্যাক্সিলারেটরে সজোরে চাপ দিল। পুরনো গাড়িটা চাকার তীব্র আর্তনাদ করে ধুলো উড়িয়ে সেই অভিশপ্ত বাড়ির গেট পার হয়ে গেল।
অয়ন রিয়ার-ভিউ মিররে একবার তাকাল। বাড়িটা ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে। একটা ভাঙা, মৃত খোলসের মতো।
হঠাৎ তার মনে হলো, সে যেন চিলেকোঠার সেই ভাঙা ভেন্টিলেটরের গর্তে এক ঝলকের জন্য একটা সাদা অবয়ব দেখতে পেল। একটা সাদা শাড়ি পরা নারী... মণিকুন্তলা? সে কি তাদের বিদায় জানাচ্ছে? নাকি এটা শুধুই তার ক্লান্ত, আতঙ্কিত মনের কল্পনা?
অয়ন আর ওদিকে তাকাল না। সে শহরের হাইওয়ের দিকে গাড়ি ছোটাল।
পেছনে পিয়া তার কোলের ওপর রাখা অয়নের জ্যাকেটটা আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলা তার পোড়া হাতটা চেপে ধরে অয়নের কাঁধে মাথা রেখেছে। সেও ক্লান্তিতে চোখ বুজেছে।
গাড়িটা ভোরের আলো চিরে এগিয়ে চলল। ভেতরে তিনজন আহত, আতঙ্কিত, কিন্তু জীবিত মানুষ। তারা স্বাধীনতা পেয়েছে।
তারা মুক্তি পেয়েছে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion