কলেজ স্ট্রিট। এই নামটা উচ্চারণ করলেই আরিকের নাকে এসে লাগে এক মিশ্র গন্ধ—নতুন বইয়ের কাগজের তাজা গন্ধের সাথে পুরাতন বইয়ের ধুলোমাখা, হলদেটে পাতার এক অম্লমধুর সুবাস। এর সাথে মেশে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সামনের ফুটপাতের চায়ের দোকানের গরম দুধের গন্ধ, কফি হাউসের সিগারেটের ধোঁয়া আর লক্ষ লক্ষ শব্দের গুঞ্জন, যা বাতাসে ভেসে বেড়ায় কিন্তু কান দিয়ে শোনা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। আরিকের কাছে এই জায়গাটা ছিল এক টাইমমেশিন, যা তাকে অনায়াসে এক শতাব্দী থেকে অন্য শতাব্দীতে নিয়ে যেতে পারত।
‘ঘোস্টোইন’—তাদের ইউটিউব চ্যানেলটা শুধু একটা প্রজেক্ট ছিল না, ছিল চার বন্ধুর অস্তিত্বের প্রমাণ। আরিক, দলের মস্তিষ্ক, যার চোখে ঘুম ছিল না, ছিল শুধু স্বপ্ন আর জেদ। শ্রেয়া, চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া, যে কোনো গল্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ছাড়া বিশ্বাস করত না। জয়, যার ক্যামেরার লেন্স ছিল তাদের পঞ্চম চোখ, যা বাস্তবতার আড়ালের সত্যকে ধরতে পারত। আর রিয়া, চ্যানেলের মুখ, যার সাবলীল উপস্থাপনা আর ক্যামেরার সাথে সহজ সম্পর্কই ছিল তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি।
কিন্তু সাফল্য এখন অতীত। গত কয়েক মাস ধরে তাদের চ্যানেলটা যেন এক চোরাবালিতে আটকে গেছে। সাবস্ক্রাইবার বাড়ছে না, ভিউজ স্থিতিশীল। অন্যদিকে, ‘বেঙ্গল ভূতূড়ে’ নামের এক প্রতিদ্বন্দ্বী চ্যানেল, যারা চটকদার এডিটিং আর নাটকীয় আবহসঙ্গীত দিয়ে সস্তা ভূতের গল্পকে ভাইরাল করছিল, তারা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদের শেষ ভিডিও, “আমগাছির শাঁকচুন্নির অভিশাপ”, দশ লক্ষ ভিউজ পার করে গেছে। সেই সাফল্য আরিকের বুকে ঈর্ষার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
কফি হাউসের সেই ঐতিহাসিক বড় হলঘরে, যেখানে সময় যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে আটকে গেছে, সেখানে বসে আরিক টেবিলে একটা চাপড় মেরে বলল, “আর নয়! ওই ‘বেঙ্গল ভূতূড়ে’-র মতো সস্তা নাটক আমি করব না। আমরা যা করব, তা হবে অথেনটিক, রিয়েল। এবার এমন কিছু করতে হবে যা বাংলার ইউটিউব ইতিহাসে একটা মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।”
শ্রেয়া একটা জীর্ণ বইয়ের পাতা থেকে মুখ না তুলেই বলল, “ইতিহাস ঘাঁটতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ইতিহাস তৈরি করার জন্য যে উপাদান লাগে, তা ফুরিয়ে আসছে। বাংলার প্রায় সব রহস্যময় জায়গার অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ আমাদের মুখস্থ। নতুন কী পাবি?” তার বলার ভঙ্গিতে ছিল স্নেহের তিরস্কার। সে-ই একমাত্র যে আরিকের লাগামছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ভয় পেত, কারণ সে জানত, আরিক ‘এক্সক্লুসিভ’-এর জন্য যেকোনো ঝুঁকি নিতে পারে।
রিয়া, তাদের চ্যানেলের অ্যানালিটিক্স দেখতে দেখতে বলল, “ফ্যাক্ট হলো, আমাদের অডিয়েন্স এনগেজমেন্ট কমছে। লাস্ট ভিডিওর অ্যাভারেজ ওয়াচ টাইম মাত্র তিন মিনিট। আমাদের একটা হুক দরকার, আরিক। এমন কিছু যা দর্শককে প্রথম দশ সেকেন্ডেই আটকে ফেলবে।” রিয়া শুধু চ্যানেলের মুখ ছিল না, সে ছিল তাদের বিজনেস ম্যানেজারও। চ্যানেলের আয় দিয়েই তাদের চারজনের শহরের খরচ চলত।
জয়, তার ক্যামেরাটা পরম যত্নে লেন্স ক্লিনিং ক্লথ দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, “শ্রেয়াদি ঠিকই বলছে, আরিকদা। লোকে এখন আর শুধু ‘এখানে ভূত আছে’ শুনতে চায় না। তারা চায় ‘কেন’ আছে, ‘কীভাবে’ আছে। আমাদের গল্পের গভীরতা বাড়াতে হবে।”
আরিক রহস্যময়ভাবে হাসল। “সেই গভীরতার খোঁজেই তো আজ এখানে আসা।” সে তার ঝোলা থেকে একটা ছোট, চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি বের করল। ডায়েরিটার অবস্থা শোচনীয়। চামড়াটা আর্দ্রতায় আর অবহেলায় জায়গায় জায়গায় ফেটে গিয়ে ভেতরের বোর্ড বেরিয়ে পড়েছে। পাতাগুলো হলদেটে হয়ে এতটাই ভঙ্গুর যে জোরে নিঃশ্বাস ফেললেও ছিঁড়ে যেতে পারে। এর বাঁধন খুলে যাওয়া সুতোগুলো যেন এক জীর্ণ কঙ্কালের পাঁজর।
“এটা কী?” শ্রেয়া বই থেকে চোখ সরিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠল।
“গত সপ্তাহে আজিজুল চাচার দোকান থেকে পেয়েছি। একগাদা বাতিল কাগজের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে ছিল। চাচা নিজেও জানতেন না এর ভেতরে কী আছে। আমার কাছ থেকে মাত্র পঞ্চাশ টাকা নিয়েছিলেন।”
ডায়েরিটা খুলতেই একটা অদ্ভুত মিশ্র গন্ধ বেরিয়ে এল—পুরনো কাগজ, শুকনো কালি, কর্পূরের মতো একটা মিষ্টি গন্ধ আর তার সাথে ভেজা মাটির মতো এক স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। পাতাগুলোয় প্রাচীন বাংলা হরফে কিছু লেখা, যা পড়তে গিয়ে শ্রেয়ার মতো অভিজ্ঞ ছাত্রীরও চোখ কুঁচকে যাচ্ছিল। সে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে খুব সাবধানে পাতা ওল্টাতে শুরু করল।
বেশিরভাগ লেখাই অস্পষ্ট, কিন্তু শেষের কয়েকটি পাতা তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট ছিল, যেন লেখক খুব তাড়াহুড়ো আর আতঙ্কের মধ্যে কথাগুলো লিখে গেছেন। শ্রেয়া ঝুঁকে পড়ে পড়তে শুরু করল। “এ তো কোনও এক জমিদারের সেরেস্তার হিসাবরক্ষকের ডায়েরি বলে মনে হচ্ছে… সালটা সম্ভবত ১৭৮০ থেকে ১৭৯০-এর মধ্যে।” সে আরও কিছু টুকরো টুকরো লাইন পড়ল, “এখানকার আকাশ অন্য রঙের… এখানকার জল বহিতে ভুলিয়া গিয়াছে…।”
পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা জায়গায় এসে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। সেখানে তুলির মোটা কালিতে লেখা একটাই শব্দ—‘শ্যামলগড়’।
“শ্যামলগড়?” জয় বলল। “প্রথমবার শুনছি নামটা।”
“শুনবি কী করে,” আরিকের গলার স্বর উত্তেজনায় কাঁপছিল। “এই নামের কোনো গ্রামের অস্তিত্ব কোনো সরকারি বা বেসরকারি রেকর্ডে নেই। আমি গুগল আর্থ, ব্রিটিশ লাইব্রেরির আর্কাইভ, সব ঘেঁটে দেখেছি। নাথিং! জিরো! যেন কেউ খুব যত্ন করে এর অস্তিত্ব মুছে দিয়েছে।”
ডায়েরির সেই পাতায় শ্যামলগড় সম্পর্কে যা লেখা ছিল, তা কফি হাউসের কোলাহলের মধ্যেও তাদের চারজনের শরীরে শীতল স্রোত বইয়ে দিল:
‘ভগবানের অভিশাপ নামিয়া আসিয়াছে এই গ্রামে। মহামারী নহে, এ অন্য কিছু… মানুষগুলি একে একে কেমন নিষ্প্রাণ হইয়া যাইতেছে। তাহাদের চোখ কোটরে বসিয়া যাইতেছে, আর তাহাদের ছায়াগুলি… ছায়াগুলি যেন তাহাদের কথা শুনিতেছে না। রাত্রি নামিলেই গ্রাম হইতে এক অদ্ভুত কান্নার শব্দ ভাসিয়া আসে… না, কান্না নয়, এ এক সুর… অতলান্ত বিষাদের সুর। গ্রামটি যেন জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে এবং তাহার বাসিন্দাদের গ্রাস করিতেছে। আমরা পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু গ্রামের সীমানা পার হইবার শক্তি কাহারও নাই। এ এক গোলকধাঁধা। শ্যামলগড় তাহার সন্তানদের ফিরাইয়া দিবে না।’
লেখার শেষে একটি হাতে আঁকা মানচিত্র। কয়েকটি নদী, একটি বড় বটগাছ যার নিচে পাঁচটি ঝুরি মাটিতে নেমে কাণ্ডের আকার নিয়েছে, আর কিছু সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে গ্রামের অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
রিয়া শিউরে উঠে বলল, “হতে পারে পুরোটাই লেখকের কল্পনা। হয়তো আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে লিখেছেন।”
“হতেও পারে,” আরিক ডায়েরিটা বন্ধ করে বলল। “কিন্তু যদি না হয়? ভেবে দেখ, একটা আস্ত গ্রাম, যা মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গেছে। আ লস্ট ভিলেজ হিডেন ইন বেঙ্গল। যদি আমরা এটাকে খুঁজে বের করতে পারি, ‘বেঙ্গল ভূতূড়ে’ কেন, বিশ্বের সেরা প্যারানরমাল চ্যানেলগুলো আমাদের নিয়ে কথা বলবে।”
শ্রেয়া সন্দিহান গলায় বলল, “কিন্তু ম্যাপটা দেখ। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থির নেই। শুধু লেখা আছে, সুবর্ণরেখা নদীর পুরনো খাত ধরে পুব দিকে তিন দিনের পথ, তারপর ‘পঞ্চবটী’… এই পঞ্চবটী কী, তা কে জানে! আমি ব্রিটিশ সার্ভে ম্যাপগুলো দেখেছি, আরিক। ওই অঞ্চলে এমন কোনো জায়গার উল্লেখ নেই। It’s a geographical anomaly.”
“আমরা খুঁজে বের করব,” আরিকের চোয়াল শক্ত। “আমি কিছু পুরনো সার্ভে ম্যাপ জোগাড় করেছি। ব্রিটিশদের আঁকা। হয়তো তাতে কিছু সূত্র মিলবে। বল, তোরা আছিস আমার সাথে?”
আরিকের চোখে ছিল স্বপ্নের আগুন। জয় আর রিয়া সেই আগুনে ঝাঁপ দিতে রাজি ছিল। একমাত্র শ্রেয়ার মুখেই ছিল গভীর চিন্তার ছাপ। সে জানত, আরিকের এই আগুন অনেক সময় দাবানলে পরিণত হয়। কিন্তু সে এটাও জানত, সে তার বন্ধুদের একা ছাড়তে পারবে না।
গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রেয়া বলল, “যেতে হলে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে। ফার্স্ট এইড কিট, শুকনো খাবার, ওয়াটার পিউরিফায়ার ট্যাবলেট, অতিরিক্ত ব্যাটারি, পাওয়ার ব্যাংক, আর একটা স্যাটেলাইট ফোন। কারণ আমার মন বলছে, যেখানে আমরা যাচ্ছি, সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিলাসিতা হতে পারে।”
আরিকের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “ডান! তাহলে ‘অপারেশন শ্যামলগড়’ oficially on!”
তারা জানত না, কফি হাউসের ধোঁয়াশা আর সভ্যতার নিরাপদ বলয় থেকে বেরিয়ে তারা যে পথে হাঁটতে চলেছে, সেই পথ তাদের জীবনের মানচিত্র থেকেই চিরতরে মুছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion