কলকাতা থেকে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে। কিন্তু শহর ছাড়িয়ে, হাইওয়ে পেরিয়ে গাড়ি যখন লাল মাটির রাস্তায় নামল, তখন থেকেই চারপাশের চেনা জগৎটা বদলাতে শুরু করল। শেষ যে জনপদ তারা পেছনে ফেলে এল, সেখানকার একটা চায়ের দোকানে তারা থেমেছিল জল ভরার জন্য। দোকানের এক বৃদ্ধা, যার চামড়া কুঁচকে গিয়ে মানচিত্রের মতো হয়ে গিয়েছিল, তাদের অদ্ভুত পোশাক আর শহুরে হাবভাব দেখে এগিয়ে এসেছিলেন। যখন তিনি শুনেছিলেন যে তারা জঙ্গলের গভীরে যাচ্ছে, তখন তার চোখ ভয়ে বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভাঙা গলায় বলেছিলেন, “ওদিকে যেও না, খোকারা। ওদিকে শিমুল গাছের পরে আর মানুষের রাজত্বি নাই। ওখানে যারা যায়, তারা আর ফেরে না।”
তারা বৃদ্ধার কথাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু তার ভয় পাওয়া চোখগুলো তাদের স্মৃতিতে গেঁথে গিয়েছিল।
প্রায় দু’দিন ধরে ব্রিটিশ আমলের পুরনো মানচিত্র আর ডায়েরির সেই হাতে আঁকা নকশা মিলিয়ে গাড়ি চালানোর পর তারা এমন এক জায়গায় পৌঁছাল, যেখানে রাস্তার শেষ চিহ্নটুকুও মিলিয়ে গেছে। সামনে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ঢেউ খেলানো প্রান্তর, কাঁটা ঝোপ আর প্রাচীন শাল গাছের জঙ্গল।
“এন্ড অফ দ্য রোড,” জয় স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে বলল।
আরিক জিপিএস দেখল। স্ক্রিনে তাদের অবস্থানটা একটা বিশাল সবুজ অংশের মধ্যে একটা অসহায় লাল বিন্দুর মতো কাঁপছিল। ‘No roads found.’
গাড়ি লক করে, পিঠে প্রায় দশ কেজি ওজনের ব্যাকপ্যাক নিয়ে তাদের অভিযান শুরু হলো। প্রকৃতি এখানে শান্ত, আদিম, কিন্তু সেই শান্তভাবের মধ্যেও একটা অস্বস্তিকর, ভারী নিস্তব্ধতা ছিল। পাখির ডাক নেই, পোকামাকড়ের গুঞ্জন নেই। শুধু শুকনো পাতার উপর তাদের জুতোর মচমচ শব্দ আর নিজেদের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ। প্রায় ঘণ্টা তিনেক হাঁটার পর তারা একটা নিচু, প্রশস্ত, শুকনো নদীর বিছানার মতো জায়গায় এসে পৌঁছাল।
“এটাই,” আরিক প্রায় ফিসফিস করে বলল। “এবার এই খাত ধরে পুব দিকে।”
সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। তারা ঠিক করল, রাতটা এখানেই কাটাবে। তাঁবু খাটিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে তারা যখন বসলো, তখন চারপাশের ছায়ারা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে শুরু করেছে। রাতে তাঁবুর ভেতর স্লিপিং ব্যাগে শুয়েও শ্রেয়ার ঘুম আসছিল না। তার বারবার মনে হচ্ছিল, অন্ধকারের ওপার থেকে কেউ বা ‘কিছু’ তাদের উপর নজর রাখছে। মাঝরাতে হঠাৎই জঙ্গল থেকে একটা অদ্ভুত কান্নার মতো শব্দ ভেসে এসে আবার মিলিয়ে গিয়েছিল। সেটা কোনো পশুর ডাক ছিল না, ছিল তার চেয়েও বেশি কিছু… যন্ত্রণার মতো।
পরদিন সকালে যাত্রা আবার শুরু হলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটার পর দূর থেকে তারা দেখতে পেল সেটাকে—পঞ্চবটী। একটা বিশাল, প্রাচীন বটগাছ। কিন্তু সাধারণ বটগাছ নয়। এর পাঁচটা প্রকান্ড কাণ্ড সাপের মতো একে অপরকে পেঁচিয়ে ধরে একটা একক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। যেন প্রকৃতির এক খেয়ালে গড়া এক জীবন্ত মন্দির।
গাছটার কাছাকাছি পৌঁছাতেই একটা হিমেল স্রোত তাদের শরীর ছুঁয়ে গেল, যদিও বাতাসে গরমের হলকা ছিল। গাছটার তলার মাটিটা নরম, ভেজা আর শ্যাওলায় ঢাকা, যা তাদের পায়ের শব্দকে প্রায় গিলে নিচ্ছিল। বাতাসের শব্দও এখানে অন্যরকম। পাতার সাধারণ মর্মরধ্বনি নয়, বরং একটা গভীর, গুমগুম কান্নার মতো শব্দ।
ডায়েরির ম্যাপ অনুযায়ী, এই পঞ্চবটীর পেছন দিকে একটা সরু পথ থাকার কথা। কিন্তু গাছের পেছনে ছিল কাঁটা ঝোপ আর আগাছার দুর্ভেদ্য দেওয়াল।
“রাস্তা কই?” জয় হতাশ হয়ে বলল।
আরিক হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে একটা মোটা ডাল দিয়ে আগাছা সরাতে শুরু করল। প্রায় আধঘণ্টা নিষ্ফল চেষ্টার পর হঠাৎই তার ডালটা একটা ফাঁকা জায়গায় পড়ে গেল। আগাছার ঘন আস্তরণের নিচে সত্যিই একটা পথ ঢাকা পড়ে আছে—মানুষের পায়ের চাপে তৈরি হওয়া এক চিলতে মাটির রাস্তা, যা বহু ব্যবহারে মসৃণ হয়ে গেছে। পথটা এতটাই সরু আর অন্ধকারাচ্ছন্ন যে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো গুহার প্রবেশদ্বার।
শ্রেয়া আরিককে শেষবারের মতো সাবধান করল, “ভেতরে ঢোকার আগে একবার ভেবে দেখ, আরিক। আমার মন বলছে, এই পথটা একমুখী হতে পারে। Once we are in, there might be no way out.”
“Adventure-এর এটাই তো মজা, শ্রেয়া,” আরিক হাসল। “ক্যামেরা রেডি কর, জয়। The real story begins now.”
ব্যাগপ্যাক কাঁধে নিয়ে, টর্চ জ্বেলে আরিক সবার আগে সেই অন্ধকার পথে পা রাখল। তারা কেউ খেয়াল করেনি, তাদের পেছনে, পঞ্চবটীর গোড়ায় যেখান থেকে পথটা শুরু হয়েছিল, সেখানকার আগাছাগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের শূন্যস্থান পূরণ করে নিচ্ছিল। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের প্রবেশের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিচ্ছিল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion