Episode 251265 words4 views

অধ্যায় ২৫: চুক্তির শর্ত

গুহার ভেতরে তখন নরক নেমে এসেছে। চারটি ভাঙা, ক্লান্ত শরীর একজোট হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক মহাজাগতিক ক্রোধের সামনে। কুয়োর ভেতর থেকে সত্তাটির গর্জন আর শুধু মানসিক ছিল না, তা এক শারীরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। গুহার দেওয়ালগুলো কাঁপছিল, ছাদ থেকে অনবরত পাথর আর ধুলো খসে পড়ছিল। কুয়োর জমাট অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছিল কালো, ধোঁয়ার মতো অসংখ্য টেনট্যাকল। সেগুলো জীবন্ত সাপের মতো হিসহিস শব্দ করে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। আর গ্রামের সেই শত শত ছায়া-আত্মা, তারা আর আলাদা ছিল না। তারা সবাই মিলেমিশে এক হয়ে, এক বিশাল, আবর্তিত, কালো মেঘে পরিণত হয়েছিল, যা সেই টেনট্যাকলগুলোর অস্ত্র হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু জয় আর রিয়ার উপস্থিতি একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এনেছিল। তাদের শরীর, যা এখন তাদের ছায়ার সাথে পুনর্মিলিত, তা থেকে যেন এক অদৃশ্য শক্তি বিকিরিত হচ্ছিল। সত্তাটির কালো টেনট্যাকলগুলো যখনই তাদের দিকে এগিয়ে আসছিল, তখনই কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে প্রতিহত হয়ে ফিরে যাচ্ছিল, যেন এক অদৃশ্য কাঁচের দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। "এটা কাজ করছে!" জয় উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল। "আমাদের সম্পূর্ণ অস্তিত্বটা ওর কাছে একটা anomaly! ও আমাদের সরাসরি আক্রমণ করতে পারছে না!" তাদের এই পুনর্মিলিত অবস্থাটা ছিল ভাঙা চুক্তির এক জীবন্ত প্রমাণ। সত্তাটি তাদের শরীরকে চেয়েছিল, কিন্তু তাদের ছায়ারা সেই চুক্তিতে রাজি ছিল না। এই অসম্পূর্ণতাই ছিল তাদের বর্ম। কিন্তু এই বর্ম চিরস্থায়ী ছিল না। ছায়া-আত্মাদের সম্মিলিত শক্তি আর সত্তাটির ক্রোধের চাপে তাদের অদৃশ্য দেওয়ালটা কাঁপছিল। তারা বেশিক্ষণ এই প্রতিরোধ ধরে রাখতে পারত না। এই চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে, আরিকের সুরক্ষিত থাকা শ্রেয়ার মস্তিষ্ক কাজ করছিল ঝড়ের গতিতে। সে এখন ভয় পাচ্ছিল না। তার মনে ছিল শুধু এক শীতল, বিশ্লেষণাত্মক একাগ্রতা। 'চুক্তিটা অসম্পূর্ণ,' সে ভাবছিল। 'কিন্তু ও এখনো শক্তিশালী। কারণ, তান্ত্রিকের চুক্তিটা সম্পূর্ণ হয়েছিল। তান্ত্রিক নিজেই এখন এই জায়গার নোঙর, এই পোর্টালের দরজা। আমরা যদি ওকে ধ্বংস করতে না পারি, তাহলে এই দরজা কখনো বন্ধ হবে না।' কিন্তু কীভাবে তারা সেই তান্ত্রিককে ধ্বংস করবে, যে এখন আর কোনো মানুষ নয়, বরং এই সত্তাটিরই এক অংশ? শ্রেয়ার মনে পড়ল কুয়োর প্রতিবিম্বের সেই দৃশ্য—তান্ত্রিক তার ছায়া উৎসর্গ করছে। "উৎসর্গ,"—শব্দটা তার মাথায় গেঁথে গেল। "প্রতিটি চুক্তির শর্ত থাকে। প্রতিটি যজ্ঞে বলিদানের প্রয়োজন হয়।" 'তান্ত্রিক তার ছায়া বলি দিয়েছিল,' শ্রেয়া ভাবল। 'এই পোর্টালটা খোলার জন্য একটা ছায়ার প্রয়োজন হয়েছিল। তাহলে... তাহলে কি এটা বন্ধ করার জন্যও একটা বলিদানের প্রয়োজন?' কিন্তু কীসের বলিদান? এই প্রশ্নটা তার মাথায় আসার সাথে সাথেই, এক ভয়ঙ্কর, শীতল সত্য তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। ছায়াহীন বলিদান "আরিক!" শ্রেয়া দুর্বল গলায় চিৎকার করে উঠল। "আমাদের একটা বলিদান দিতে হবে!" আরিক তার দিকে তাকাল। তার চোখে ছিল প্রশ্ন। "তান্ত্রিক তার ছায়া উৎসর্গ করেছিল," শ্রেয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। "এই সত্তাটা শক্তি আহরণ করে বিচ্ছেদের মাধ্যমে—শরীর আর ছায়ার বিচ্ছেদ। আমরা যদি এই বিচ্ছেদকে উল্টো করে দিতে পারি... যদি ওকে এমন কিছু দিতে পারি যা ওর নিয়মের বাইরে..." আরিক শ্রেয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে কোনো কথা বলছিল না, কিন্তু শ্রেয়া বুঝতে পারল, আরিকও সেই একই ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। তাদের মধ্যে ছায়াহীন কে? শুধু তারা চারজন, যারা এই অভিশপ্ত দালানে প্রবেশ করার মুহূর্তে তাদের ছায়া হারিয়েছে। জয় আর রিয়া তাদের ছায়া ফিরে পেয়েছে। তারা এখন আবার এই জগতের নিয়মের অংশ। কিন্তু আরিক আর শ্রেয়া? তারা তখনো ছায়াহীন। তারা তখনো এই দুই জগতের মাঝখানে ভাসমান এক অস্বাভাবিক সত্তা। সত্তাটি তাদের চেয়েছিল নতুন প্রহরী হিসেবে, নতুন পোর্টাল হিসেবে। কারণ, তাদের ছায়াহীন শরীরই ছিল এই রূপান্তরের জন্য আদর্শ কাঁচামাল। আরিক ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার মুখ থেকে সমস্ত ভয়, সমস্ত যন্ত্রণা মুছে গিয়েছিল। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। তার জীবনের সমস্ত ভুল, সমস্ত অহংকার, যা তাদের এই নরকে নিয়ে এসেছিল, তার প্রায়শ্চিত্ত করার একটাই পথ সে খুঁজে পেয়েছিল। "শ্রেয়া," সে মৃদু গলায় বলল। "তোমরা বাকিদের নিয়ে বেরিয়ে যাও।" "না, আরিক! না!" শ্রেয়া কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে বুঝতে পেরেছিল আরিক কী করতে চলেছে। "এটাই একমাত্র পথ," আরিক বলল। সে জয়ের দিকে তাকাল। "ক্যামেরাটা চালু রাখিস। পৃথিবীকে জানতে হবে, শ্যামলগড়ে কী হয়েছিল।" সে রিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। "আর ভয় পাস না।" তারপর সে তার বন্ধুদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে কুয়োর দিকে মুখ করে দাঁড়াল। "এই যে, শয়তান!" আরিক তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল। "তুই একটা বলিদান চেয়েছিলি! তান্ত্রিক তোকে দিয়েছিল তার ছায়া, তার অন্ধকার অংশটা। আমি তোকে দিচ্ছি এক ছায়াহীন আত্মা! এক সম্পূর্ণ সত্তা! দেখ তুই এটা হজম করতে পারিস কিনা!" এই কথা বলে, আরিক এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে, দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিল সেই জমাট বাঁধা অন্ধকারের কুয়োর গভীরে। এক মুহূর্তের জন্য, সবকিছু থেমে গেল। গুহার কম্পন, ছায়া-আত্মাদের গর্জন, সত্তাটির মানসিক চাপ—সবকিছু একযোগে স্তব্ধ হয়ে গেল। আর তারপর, কুয়োর ভেতর থেকে কোনো অন্ধকার নয়, বেরিয়ে এল এক তীব্র, শ্বেতশুভ্র আলোর বিস্ফোরণ। আলোটা এতটাই তীব্র ছিল যে জয়, রিয়া আর শ্রেয়া চোখ বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য হলো। সেই আলোয় কোনো উত্তাপ ছিল না, ছিল এক পবিত্র, শুদ্ধ করার শক্তি। গুহার ভেতরের সমস্ত অন্ধকার, সমস্ত অভিশাপ সেই আলোয় মুছে যাচ্ছিল। ছায়া-আত্মাগুলো সেই আলোতে পড়তেই তাদের বিকৃত, যন্ত্রণাকাতর রূপ মিলিয়ে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠল তাদের আসল, মানবীয় চেহারা। তাদের মুখে আর যন্ত্রণা ছিল না, ছিল মুক্তি। তারপর তারা সবাই সোনালী ধূলিকণায় পরিণত হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। কুয়োর ভেতর থেকে আরিকের কোনো চিৎকার ভেসে এল না। তার জায়গায় ভেসে এল সত্তাটির এক অন্তিম, যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ। এক ছায়াহীন, সম্পূর্ণ আত্মাকে গ্রহণ করা তার নিয়মের বাইরে ছিল। এই বলিদানটা ছিল তার জন্য বিষ। গুহাটা এবার সত্যি সত্যিই ভাঙতে শুরু করল। বিশাল বিশাল পাথর ছাদ থেকে খসে পড়তে লাগল। "আমাদের বেরোতে হবে! এখনি!" জয় চিৎকার করে উঠল। সে শ্রেয়াকে একদিকে আর রিয়াকে অন্যদিকে ধরে সিঁড়ির দিকে দৌড় লাগাল। তারা যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে, তখন তাদের পায়ের নিচের ধাপগুলোও ভেঙে পড়ছিল। তারা পেছনে ফিরে দেখল, কুয়োটা আর নেই। তার জায়গায় আছে শুধু এক ক্রমবর্ধমান, উজ্জ্বল আলোর বৃত্ত, যা গোটা গুহাটাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। তারা জানত, আরিক শুধু তাদের বাঁচায়নি। সে এই নরকের দরজাটা চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে গেছে। তারা যখন তান্ত্রিকের দালান থেকে বাইরে ছিটকে পড়ল, তখন গোটা বাড়িটা তাদের পেছনে এক বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ল। ধুলো আর পাথরের মেঘে চারপাশ ঢেকে গেল। শ্যামলগড়ের মাটির গভীরে সেই অভিশপ্ত গুহাটা চিরতরে সমাধিস্থ হলো। তারা তিনজন—জয়, রিয়া আর শ্রেয়া—ধুলোর মধ্যে বসে হাঁপাচ্ছিল, কাশছিল। তাদের শরীর ছিল ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। কিন্তু তাদের মন ছিল আরও বেশি শূন্য। ধুলো সরে যেতেই তারা দেখল, পুব আকাশে ভোরের প্রথম আলো ফুটছে। আর সেই আলোর সাথে সাথে, একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। গ্রামের শত বছরের পুরনো নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে, বহু দূর থেকে একটা পাখির ডাক ভেসে এল। গ্রামের বাতাস, যা এতক্ষণ ছিল ভারী আর শীতল, তা এখন হালকা, নির্মল। গাছের পাতাগুলো, যা ছিল ফ্যাকাসে আর নিষ্প্রাণ, ভোরের আলোয় তাদের সবুজ রঙ ফিরে পাচ্ছিল। অভিশাপটা কেটে গেছে। জয়, রিয়া আর শ্রেয়া ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তাদের জামাকাপড় ছেঁড়া, শরীরে ধুলো-কাদা মাখা। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখে ছিল ক্লান্তি, দুঃখ, কিন্তু তার সাথে ছিল বেঁচে থাকার এক অবিশ্বাস্য অনুভূতি। তারা গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। সেই ভাঙা বাড়িগুলো এখন আর ভয়ঙ্কর ছিল না, ছিল শুধু করুণ। এক বিস্মৃত ইতিহাসের সাক্ষী। তারা এসে পৌঁছল সেই পঞ্চবটীর নিচে। যেখান থেকে তাদের এই ভয়ঙ্কর যাত্রা শুরু হয়েছিল। ভোরের প্রথম সূর্যরশ্মি যখন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মাটিতে এসে পড়ল, তখন তারা দেখল সেই আশ্চর্য দৃশ্যটা। তাদের পায়ের কাছে, মাটিতে, ফুটে উঠেছে তিনটি স্পষ্ট, দীর্ঘ ছায়া। অভিশাপটা কেটে যাওয়ার সাথে সাথে, প্রকৃতির নিয়ম আবার ফিরে এসেছে। তারা আবার সম্পূর্ণ হয়েছে। তাদের ছায়ারা ফিরে এসেছে। তারা তিনজন। তিনটি শরীর, তিনটি ছায়া। কিন্তু তাদের দলের একজন ছিল না। আরিক। তার আত্মত্যাগের বিনিময়ে তারা ফিরে পেয়েছে তাদের জীবন, তাদের ছায়া, তাদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই জয়ের আনন্দ তাদের ছিল না। ছিল শুধু এক গভীর, অন্তহীন শূন্যতা। তারা পঞ্চবটীর নিচে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর, কোনো কথা না বলে, তারা পেছনের সেই জঙ্গলের দিকে পিঠ ফিরিয়ে, সামনের খোলা প্রান্তরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। তারা ফিরে যাচ্ছিল সেই জগতে, যেখানে আলো আছে, ছায়া আছে। কিন্তু তাদের জন্য সেই জগৎটা আর কোনোদিনও আগের মতো থাকবে না। তারা শ্যামলগড়ের গল্পটা গোটা পৃথিবীকে শোনাবে। কিন্তু তারা জানত, এই গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটা, এক বন্ধুর আত্মত্যাগের কাহিনী, সেটা চিরকাল তাদের হৃদয়ের গভীরে এক না-বলা ক্ষত হয়ে থেকে যাবে। তারা হাঁটছিল। এক নতুন ভোরের দিকে, এক নতুন জীবনের দিকে, এক বন্ধুর ছায়াহীন স্মৃতি বুকে নিয়ে। (সমাপ্ত)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion