"শ্রেয়া!"
এই চিৎকারটা আরিকের পরাজিত, হতাশ আর্তনাদ ছিল না। এটা ছিল এক নতুন, অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর, যা গুহার প্রবেশপথ থেকে, সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে, এক আলোর ঝলকানির মতো এসে আছড়ে পড়ল। এই শব্দের মধ্যে ছিল ভয়, ছিল ক্লান্তি, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল এক তীব্র, মরিয়া আশা।
আরিকের বিধ্বস্ত চেতনার মধ্যে এই শব্দটা পৌঁছাতে এক মুহূর্ত সময় লাগল। সে চমকে তাকাল। জয় আর রিয়া সেখানে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তারা আর সেই ভীত, পলায়নরত জয় বা রিয়া ছিল না, যারা একটু আগেই এই গুহা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তাদের জামাকাপড় ছেঁড়া, মুখে ধুলো আর রক্তের দাগ, কিন্তু তাদের শিরদাঁড়া ছিল সোজা, তাদের চোখের দৃষ্টি ছিল স্থির। তাদের চোখেমুখে ছিল ভয়, কিন্তু সেই ভয়কে ছাপিয়ে উঠেছিল এক নতুন, inexplicable শক্তি। তাদের শরীরগুলো, যা এখন তাদের ছায়ার সাথে পুনর্মিলিত, সেগুলো থেকে যেন এক অদৃশ্য, স্থির শক্তি বিকিরিত হচ্ছিল, যা গুহার বিশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যে এক শৃঙ্খলার দ্বীপ তৈরি করেছিল।
তাদের এই সম্পূর্ণ, পুনর্মিলিত অস্তিত্বের উপস্থিতি গুহার অস্বাভাবিক পরিবেশে এক নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করল। সত্তাটি, যা এতক্ষণ শ্রেয়ার ওপর তার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিল, তা এক মুহূর্তের জন্য হলেও বিভ্রান্ত হলো। সে এমন কিছুর মুখোমুখি হয়েছিল, যা তার অভিজ্ঞতার বাইরে—এক ভাঙা চুক্তি, যা আবার জোড়া লেগেছে।
এই এক মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল।
জয়, তার জীবনের সমস্ত ভয়কে এক বিন্দুতে এনে, এক আদিম চিৎকারের সাথে এগিয়ে এল। সে তার টর্চটা তুলে ধরল। কিন্তু এবার সেই আলোটা আর সাধারণ টর্চে আলো ছিল না। তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বের শক্তি যেন সেই আলোর সাথে মিশে গিয়েছিল। আলোটা হয়ে উঠেছিল তীব্র, বিশুদ্ধ, আর তার মধ্যে ছিল এক defiant স্পন্দন।
রিয়া চিৎকার করে শ্রেয়ার নাম ধরে ডাকল। তার কণ্ঠে ছিল তার নিজের, তার ছায়ার এবং তার বন্ধুদের জন্য সমস্ত ভালোবাসা আর আকুতি। তার সেই আবেগঘন ডাক, শ্রেয়ার প্রায়-হারিয়ে যাওয়া চেতনার গভীরে, এক শেষ স্ফুলিঙ্গের মতো প্রবেশ করল।
সত্তাটির মানসিক চাপ শ্রেয়ার ওপর থেকে এক মুহূর্তের জন্য শিথিল হয়ে গেল।
শ্রেয়া এক তীব্র কাশির সাথে চোখ খুলল। তার দৃষ্টি ছিল ঘোলাটে, কিন্তু সে দেখল জয়ের হাতের আলো, সে শুনল রিয়ার ডাক। সে দেখল আরিকের চিন্তিত মুখ।
সে ফিরে এসেছে।
আরিক এই সুযোগটা নষ্ট করল না। সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে শ্রেয়াকে টেনে তুলে ধরল এবং কুয়ো থেকে কয়েক পা পিছিয়ে এল। জয় আর রিয়া দৌড়ে এসে তাদের পাশে দাঁড়াল।
তারা চারজনে আবার একসাথে।
তারা কুয়োর দিকে মুখ করে এক ভাঙা, কিন্তু দৃঢ় ব্যূহ তৈরি করল। জয় আর রিয়া সামনে, তাদের নতুন করে পাওয়া শক্তি যেন এক অদৃশ্য বর্ম তৈরি করেছে। তাদের পেছনে আরিক, যে তার দুর্বল শরীর দিয়েও শ্রেয়াকে আগলে রেখেছে।
গুহাটা আবার কাঁপতে শুরু করেছে। কুয়োর ভেতর থেকে সত্তাটির ক্রোধ এবার আর শুধু মানসিক গর্জন নয়, তা এক শারীরিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। ছায়া-আত্মাদের ঘূর্ণিঝড়টা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
তারা শ্রেয়াকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু তার ফলে, তারা নিজেদেরকে এক কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে এসেছে। পালানোর আর কোনো পথ নেই।
তাদের সামনে ছিল এক ক্রুদ্ধ, প্রাচীন সত্তা। তাদের চারপাশে ছিল শত শত ক্ষুধার্ত আত্মার দল।
তাদের হাতে ছিল শুধু একে অপরের সঙ্গ, আর এক ভাঙা চুক্তির অসম্পূর্ণ জ্ঞান।
শেষ যুদ্ধটা এখন অবশ্যম্ভাবী।
এই পুনর্মিলনের মুহূর্তটা ছিল এক কথায় অবর্ণনীয়। জয় আর রিয়া যখন গুহার মেঝেতে পা রাখল, তখন তাদের শরীর থেকে বিচ্ছুরিত অদৃশ্য শক্তিটা সত্তাটির মানসিক আক্রমণের সাথে ধাক্কা খেল। গুহার বাতাসে যেন একটা তরঙ্গ সৃষ্টি হলো। সত্তাটির ক্রোধের তীব্রতা এক মুহূর্তের জন্য কমে গেল, যেন সে এক অপরিচিত, অপ্রত্যাশিত বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
"শ্রেয়া!"—রিয়ার এই চিৎকারটা শুধু শব্দ ছিল না। এটা ছিল এক জীবন্ত অনুভূতি। তার পুনর্মিলিত সত্তার সমস্ত শক্তি, তার ছায়ার ভয় এবং তার নিজের ভালোবাসা—সবকিছু মিলে এই ডাকটা শ্রেয়ার চেতনার সেই শেষ বিন্দুতে গিয়ে আঘাত করল, যেখানে সে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল।
শ্রেয়ার বন্ধ চোখের পাতা কেঁপে উঠল। তার কানের ভেতরে বাজতে থাকা সত্তাটির ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে সে শুনল তার বন্ধুর ডাক। এই মানবিক শব্দটা ছিল এক নোঙরের মতো, যা তাকে শূন্যতার অতল থেকে টেনে তুলল।
জয় তখন এগিয়ে এসেছে। তার টর্চের আলোটা এখন আর শুধু পথ দেখাচ্ছিল না, তা হয়ে উঠেছিল এক অস্ত্র। সেই আলোর সংস্পর্শে এসে ছায়া-আত্মাগুলো যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল, তাদের আকার বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল।
আরিক এই সুযোগটা কাজে লাগাল। সে শ্রেয়াকে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে পিছিয়ে এল। জয় আর রিয়া তাদের সামনে দাঁড়িয়ে এক মানব দেওয়াল তৈরি করল।
"তোমরা... তোমরা ফিরে এসেছ," আরিকের গলায় ছিল স্বস্তি আর অবিশ্বাস।
"আমরা তোমাদের ফেলে যেতে পারিনি," জয় বলল, তার চোখ দুটো ছিল কুয়োর দিকে স্থির।
তারা চারজনে মিলে এক নতুন ব্যূহ তৈরি করল। সামনে জয় আর রিয়া—তাদের শরীর দৃঢ়, তাদের ছায়াগুলো তাদের পেছনে মাটিতে স্থির, যেন দুটো extra নোঙর। তাদের পেছনে আরিক, যার এক হাতে শ্রেয়া, অন্য হাতে একটা আলগা পাথর—তার শেষ অস্ত্র। আর তাদের মাঝখানে শ্রেয়া, দুর্বল, কিন্তু তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। তার শরীরটা বিধ্বস্ত, কিন্তু তার মস্তিষ্কটা আবার সচল হয়েছে।
"ও... ও রেগে গেছে," শ্রেয়া ফিসফিস করে বলল।
সে ঠিকই বলেছিল। সত্তাটি তার বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠেছিল। তার ক্রোধ এখন সহস্রগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কুয়োর ভেতর থেকে গর্জনটা বাড়ছিল। কালো ধোঁয়ার টেনট্যাকলগুলো আরও হিংস্রভাবে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। আর ছায়া-আত্মাদের ঘূর্ণিঝড়টা তাদের চারপাশে আরও দ্রুতবেগে ঘুরতে শুরু করেছিল।
তারা জানত, তারা একটা ছোট যুদ্ধ জিতেছে মাত্র। কিন্তু আসল সংগ্রামটা সবে শুরু হতে চলেছে। তাদের হাতে কোনো দৈব অস্ত্র ছিল না। ছিল শুধু বন্ধুত্ব, সাহস, আর এক ভাঙা চুক্তির বিপজ্জনক জ্ঞান।
তারা দাঁড়িয়ে রইল, এক অটুট কিন্তু ভঙ্গুর প্রাচীরের মতো, এক মহাজাগাগতিক ঝড়ের মুখে। শেষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion