মায়াজালের প্রথম স্পর্শ
অর্ক’র দিনগুলো কাটছিল একঘেয়েমির চাদরে মোড়া। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একই রুটিন – কলেজ, টিউশন, আর তারপর ঘুম। এই একঘেয়েমি ভাঙতে তার একমাত্র সঙ্গী ছিল অনলাইন গেমিং। যখন ‘মায়াজাল’ নামের গেমটির বিজ্ঞাপন তার চোখে পড়ল, অর্ক যেন নতুন এক জগতের সন্ধান পেল। গেমটির গ্রাফিক্স ছিল অবিশ্বাস্য, এতটাই বাস্তবসম্মত যে স্ক্রিন আর বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। গেমের প্রতিটি পাতা, প্রতিটি পাথরের খাঁজ, প্রতিটি জলের কণা যেন জীবন্ত। এর সাউন্ড ডিজাইন ছিল এমন যে মনে হতো যেন চরিত্রগুলোর নিশ্বাসও শোনা যাচ্ছে, বাতাসের ফিসফিসানিও কানে আসছে। গেমটির স্লোগান ছিল, “মায়াজাল: যেখানে বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা মুছে যায়।” অর্ক জানত না, এই স্লোগানটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিভীষিকার পূর্বাভাস ছিল।
প্রথম দিনেই অর্ক ‘মায়াজাল’-এর গভীরে তলিয়ে গেল। গেমের পরিবেশ ছিল এক প্রাচীন, রহস্যময় অরণ্য। ঘন গাছপালা, স্যাঁতসেঁতে মাটি, আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ – সবকিছুই যেন জীবন্ত। অরণ্যের গভীরে ছিল এক অদ্ভুত নীরবতা, যা মাঝে মাঝে ভেঙে যেত কোনো অজানা প্রাণীর ডাকে বা পাতার মর্মর শব্দে। অর্ক তার চরিত্র, একজন অকুতোভয় অভিযাত্রী, নিয়ে এগিয়ে চলল। তার ইন-গেম চরিত্রটি ছিল তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি – লম্বা, ছিপছিপে গড়নের, চোখে এক ধরনের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি। প্রথম কয়েকটা লেভেল ছিল বেশ সহজ, সাধারণ অ্যাডভেঞ্চার গেমের মতোই। কিছু ধাঁধা সমাধান করতে হতো, কিছু ছোটখাটো শত্রুর মোকাবিলা করতে হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে গেমের মধ্যে অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করল, যা অর্কের মনে এক গভীর অস্বস্তি তৈরি করল।
মাঝে মাঝে তার স্ক্রিনে এক ঝলকের জন্য কিছু অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যেত, যা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেত। প্রথম দিকে সে ভেবেছিল, হয়তো তার চোখের ভুল, বা গ্রাফিক্সের কোনো ত্রুটি। কিন্তু এই অবয়বগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করল। সেগুলো ছিল মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু তাদের মুখগুলো ছিল বিকৃত, চোখগুলো ছিল শূন্য। গেমের চরিত্রগুলো মাঝে মাঝে এমন কথা বলত, যা অর্কের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে যেত। একবার গেমের এক NPC (Non-Player Character) তাকে বলল, “তুমি কি এখনও তোমার ছোটবেলার সেই লাল বাইসাইকেলের কথা ভাবো, অর্ক? যে বাইসাইকেলটা তুমি হারিয়ে ফেলেছিলে, আর কখনো খুঁজে পাওনি? তোমার বাবা-মা তোমাকে বকা দিয়েছিলেন সেই বাইসাইকেল হারানোর জন্য, তাই না?” অর্ক চমকে উঠেছিল। তার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল। এই তথ্য সে কখনো অনলাইনে শেয়ার করেনি, এমনকি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও এই বাইসাইকেলের কথা মনে থাকার কথা নয়। এটি ছিল তার একান্ত ব্যক্তিগত একটি স্মৃতি, যা শুধু তার নিজের মনেই জমা ছিল। সে ভেবেছিল, হয়তো এটা একটি উন্নত AI এর কৌশল, যা খেলোয়াড়ের ডেটা বিশ্লেষণ করে এমন ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করছে। কিন্তু অস্বস্তিটা থেকেই গেল, এক সূক্ষ্ম কাঁটার মতো বিঁধে রইল তার মনে। গেমের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দৃশ্য যেন তার মনের গভীরে প্রবেশ করছিল, তার সবচেয়ে গোপন ভয়গুলোকে জাগিয়ে তুলছিল।
অর্ক তার বন্ধু রাহুলকে এই বিষয়ে বলতে গেল। রাহুলও একজন হার্ডকোর গেমার, কিন্তু তার বাস্তববোধ ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। “আরে ধুর! ওগুলো সব গেমের বাগ। গ্রাফিক্স এত হাই যে মাঝে মাঝে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আর AI এখন অনেক স্মার্ট হয়েছে, ডেটা ঘেঁটে কিছু কমন জিনিস বের করে নেয়,” রাহুল হেসে উড়িয়ে দিল। অর্কও চেষ্টা করল নিজেকে বোঝাতে যে এটা নিছকই তার অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা, গেমিংয়ের প্রতি তার আসক্তির ফল। কিন্তু তার ভেতরের ভয়টা বাড়তেই থাকল। তার মনে হচ্ছিল, গেমটি যেন তাকে অনুসরণ করছে, তার প্রতিটি চিন্তা পড়ছে।
কিন্তু ঘটনাগুলো বাড়তে লাগল। অর্ক যখন গেম খেলত, তখন তার ঘরের পরিবেশেও যেন এক সূক্ষ্ম পরিবর্তন আসত। তার মনে হতো, তার ঘরের কোণায় থাকা গাছটা যেন গেমের অরণ্যের গাছের মতোই নড়ছে, অথবা তার জানলা দিয়ে আসা হাওয়ায় গেমের স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ মিশে আছে। মাঝে মাঝে সে তার নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে পেত, যা গেমের NPC-দের মুখ থেকে ভেসে আসত। একবার একটি NPC তাকে তার সবচেয়ে বড় ভয়ের কথা বলল – তার বাবা-মায়ের অসুস্থতা। অর্ক আতঙ্কিত হয়ে গেমটি বন্ধ করে তার বাবা-মায়ের কাছে ছুটে গিয়েছিল, শুধু জানতে পারল যে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। এই ঘটনা অর্কের মনে এক গভীর বিভ্রান্তি তৈরি করল। সে আর বাস্তব আর গেমের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছিল না।
একদিন গেম খেলতে খেলতে অর্ক দেখল, তার ইন-গেম চরিত্রটি একটি পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কুঁড়েঘরের ভেতরে একটি ডায়েরি পড়ে আছে। ডায়েরিটি খুলতেই অর্ক দেখল, সেখানে তার নিজের হাতের লেখায় কিছু লেখা – “আমি আর পারছি না। মায়াজাল আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমার মস্তিষ্ক আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমি গেমের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছি। আমার শরীরটা এখানে, কিন্তু আমার মনটা যেন অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। আমি আমার নিজের স্মৃতিগুলোকে চিনতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, আমি আর আমি নেই।” অর্কের হাত কাঁপতে শুরু করল। এটা অসম্ভব! সে কখনো এই ডায়েরি লেখেনি, এমনকি এই কুঁড়েঘরও দেখেনি। লেখাগুলো ছিল তার নিজের হাতের লেখার হুবহু নকল, এমনকি তার লেখার সামান্য ত্রুটিগুলোও সেখানে ছিল। সে দ্রুত গেম থেকে বেরিয়ে এল, তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার মাথা ঘুরছিল, মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো এক অদৃশ্য ঘূর্ণির মধ্যে আটকা পড়েছে। তার চারপাশের সবকিছুই যেন ঝাপসা মনে হচ্ছিল। তার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন যেন গেমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
পরের দিন কলেজে গিয়ে অর্ক দেখল, তার এক পরিচিত গেমার, রনি, অনুপস্থিত। রনিও ‘মায়াজাল’ খেলত, এবং সে ছিল গেমের লিডারবোর্ডের প্রথম দিকে। রনি ছিল একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং সতর্ক গেমার, যে সহজে কোনো ফাঁদে পা দিত না। অর্ক তার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কেউ রনির খোঁজ দিতে পারল না। রনির ফোনও বন্ধ। অর্কের মনে খটকা লাগল। সে ‘মায়াজাল’-এর ফোরামে গিয়ে রনির আইডি খুঁজতে শুরু করল। ফোরামে রনির শেষ পোস্ট ছিল, “এই গেমটা ঠিক নয়। আমি কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখছি। ওরা আমাকে ডাকছে। ওদের কণ্ঠস্বর আমার কানে বাজছে। ওরা আমার স্মৃতিগুলোকে পরিবর্তন করছে। কেউ কি আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারো? আমার মনে হচ্ছে আমি আটকা পড়েছি। আমার চারপাশে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি আর বাস্তবকে চিনতে পারছি না। আমি কে?” পোস্টটি ছিল কয়েক দিন আগের। অর্ক রনির পোস্টে রিপ্লাই দিল, কিন্তু কোনো উত্তর এল না। রনির প্রোফাইল পিকচারটি ছিল একটি অস্পষ্ট ছায়ামূর্তির, যা অর্কের নিজের গেমের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যাচ্ছিল।
অর্ক এবার রীতিমতো ভয় পেতে শুরু করল। সে গেমের আরও কিছু খেলোয়াড়ের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। তাদের মধ্যে একজন, যার নাম ‘শ্যাডো হান্টার’, অর্কের মেসেজের উত্তর দিল। শ্যাডো হান্টার লিখল, “তুমি কি মায়াজাল খেলছো? সাবধানে থেকো। এই গেমটা মানুষের মন নিয়ে খেলে। আমি জানি এমন আরও অনেকে আছে যারা গেমের মধ্যে হারিয়ে গেছে।” অর্ক জানতে চাইল, “হারিয়ে গেছে মানে? কী হয়েছে তাদের?” শ্যাডো হান্টার উত্তর দিল, “তারা গেমের মধ্যে এতটাই ডুবে গেছে যে বাস্তব আর গেমের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছে না। কিছুজন তো গেমের চরিত্র হয়ে গেছে বলে মনে হয়। তাদের শরীর জীবিত থাকলেও, মন গেমের জগতে বন্দী। তারা আর নিজেদের মানুষ ভাবে না। তাদের চোখগুলো শূন্য হয়ে যায়, যেন তাদের ভেতরের সত্তাটা চলে গেছে.” অর্ক শ্যাডো হান্টারকে তার সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করল, কিন্তু শ্যাডো হান্টার বলল, “আমি এখন খুব বিপদে আছি। ওরা আমাকে খুঁজছে। আমার মনে হচ্ছে, আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। আমি ওদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি, ওরা আমাকে তাদের দলে টানতে চাইছে। তুমি গেমটা ডিলিট করে দাও, অর্ক। এটাই বাঁচার একমাত্র উপায়।” এরপর শ্যাডো হান্টার আর কোনো উত্তর দিল না। তার আইডি অফলাইন হয়ে গেল এবং আর কখনো অনলাইন হয়নি। অর্ক তার শেষ পোস্টগুলো পড়েছিল, যেখানে শ্যাডো হান্টার তার নিজের স্মৃতিগুলোর বিকৃতি নিয়ে লিখছিল, তার পরিবারকে চিনতে পারছিল না।
অর্ক গেমটি ডিলিট করার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। গেমটি তার কম্পিউটার থেকে ডিলিট হচ্ছিল না, যেন এটি তার সিস্টেমের সাথে মিশে গেছে, তার অপারেটিং সিস্টেমের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। তার ঘুম কমে গেল। রাতে স্বপ্নে সে গেমের সেই অরণ্য দেখত, যেখানে অস্পষ্ট অবয়বগুলো তার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। স্বপ্নগুলো এত বাস্তব ছিল যে সে ঘুম থেকে উঠলে মনে হতো যেন সে কিছুক্ষণ আগেই গেমের মধ্যে ছিল। দিনের বেলায় সে মাঝে মাঝে তার চোখের কোণে কিছু ছায়ামূর্তি দেখতে পেত, যা এক ঝলকে অদৃশ্য হয়ে যেত। তার কানে গেমের অরণ্যের পাখির কিচিরমিচির আর পাতার মর্মর শব্দ বাজত, এমনকি যখন সে ঘরের ভেতরে থাকত। তার খাবারের রুচি কমে গিয়েছিল, এবং তার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। তার বাবা-মা তার এই অস্বাভাবিক আচরণ দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ডাক্তাররা কোনো শারীরিক অসুস্থতা খুঁজে পাননি, শুধু মানসিক চাপের কথা বলেছিলেন। অর্কের বাবা-মা তাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অর্ক রাজি হয়নি। সে জানত, এটা কোনো মানসিক সমস্যা নয়, এটা ‘মায়াজাল’-এর প্রভাব।
অর্ক বুঝতে পারল, এই গেমটি নিছকই একটি বিনোদনের মাধ্যম নয়, এর পেছনে আরও গভীর কিছু আছে। সে গেমটির ডেভেলপারদের ওয়েবসাইট খুঁজতে শুরু করল। কিন্তু ওয়েবসাইটটি ছিল অত্যন্ত সাধারণ, কোনো যোগাযোগের তথ্য বা টিমের সদস্যদের নাম ছিল না। শুধু একটি ইমেল আইডি দেওয়া ছিল। অর্ক সেই ইমেল আইডিতে তার সব অভিজ্ঞতা লিখে পাঠাল, কিন্তু কোনো উত্তর এল না। ইমেলটি যেন এক অদৃশ্য দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল, কোনো ডেলিভারি রিপোর্টও পাওয়া গেল না।
হঠাৎ তার মনে পড়ল রনির কথা। রনির শেষ পোস্ট। অর্ক রনির প্রোফাইলে আবার গেল। সেখানে রনির একটি পুরনো ছবি ছিল। ছবিতে রনি একটি গেমিং ইভেন্টে দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে একটি ব্যানার। ব্যানারটিতে একটি লোগো ছিল – একটি রহস্যময় প্রতীক, যা অর্ক আগে কখনো দেখেনি। লোগোটি ছিল একটি বিমূর্ত নকশা, যা দেখতে একটি মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্কের মতো, যার কেন্দ্র থেকে একটি চোখ উঁকি দিচ্ছে। চোখটি যেন সবকিছু দেখছে, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্ক লোগোটি গুগল ইমেজে সার্চ করল। সার্চ রেজাল্টে একটি পুরনো, প্রায় ভুলে যাওয়া টেক কোম্পানি’র নাম উঠে এল – “অন্ধকার ল্যাবস”। এই কোম্পানিটি কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে ডেটা চুরির অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় কেসটি ধামাচাপা পড়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য অবৈধভাবে সংগ্রহের অভিযোগ ছিল।
অর্ক অন্ধকার ল্যাবসের পুরনো ঠিকানা খুঁজে বের করল। এটি শহরের এক পুরনো, পরিত্যক্ত শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। জায়গাটা ছিল এতটাই নির্জন যে দিনের বেলাতেও সেখানে কেউ যেত না। পরের দিন সকালে, অর্ক আর রাহুল (যাকে অর্ক সব কথা খুলে বলেছিল এবং এবার রাহুলও ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়েছিল। অর্কের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অবনতি দেখে রাহুল আর এটিকে নিছকই গেমের বাগ বলে উড়িয়ে দিতে পারেনি। সে অর্কের চোখে এক গভীর আতঙ্ক দেখেছিল, যা তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল) সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। জায়গাটা ছিল জনশূন্য, পুরনো কারখানার ভাঙাচোরা দেয়াল আর আগাছায় ভরা। একটা ভাঙা গেট পেরিয়ে তারা ভেতরে ঢুকল। মূল ভবনটি ছিল বিশাল, কিন্তু জরাজীর্ণ। ভেতরে ঢোকার পর তাদের নাকে একটা স্যাঁতসেঁতে, পুরনো গন্ধ লাগল – যেন বহু বছর ধরে কোনো আলো বা বাতাস প্রবেশ করেনি সেখানে। বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত ধরনের স্থির বিদ্যুৎ অনুভব করা যাচ্ছিল, যা তাদের লোম খাড়া করে দিচ্ছিল।
ভেতরে ঢুকেই তারা দেখল, জায়গাটা একটা ল্যাবের মতো সাজানো। ভাঙা কম্পিউটার, তারের জঞ্জাল, আর পুরনো কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেয়ালগুলোতে অদ্ভুত সব চিহ্ন আঁকা, যা দেখে মনে হচ্ছিল কোনো প্রাচীন প্রতীক, অথবা কোনো জটিল সার্কিট ডায়াগ্রাম। একটা টেবিলে একটি পুরনো ল্যাপটপ পড়ে ছিল। ল্যাপটপটি চালু করতেই অর্ক দেখল, সেখানে ‘মায়াজাল’ গেমটি ইনস্টল করা আছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটি ফাইল খোলা ছিল, যার নাম ‘প্রজেক্ট মায়াজাল: চূড়ান্ত পর্যায়’। ফাইলটি খুলতেই তাদের চোখ কপালে উঠল।
সেখানে লেখা ছিল, ‘মায়াজাল’ কোনো সাধারণ গেম নয়। এটি একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প, যা মানুষের মস্তিষ্ক তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে তাদের অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। গেমটি খেলোয়াড়দের স্বপ্ন, ভয়, এবং আকাঙ্ক্ষা থেকে ডেটা সংগ্রহ করে, এবং ধীরে ধীরে তাদের মানসিকতাকে প্রভাবিত করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে, গেমটি খেলোয়াড়ের মস্তিষ্ককে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যে তারা বাস্তব আর গেমের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। কিছু খেলোয়াড় এতটাই প্রভাবিত হয় যে তাদের ব্যক্তিত্ব গেমের চরিত্রগুলোর সাথে মিশে যায়। রনি এবং শ্যাডো হান্টার ছিল সেইসব খেলোয়াড়দের মধ্যে যারা গেমের প্রভাব বুঝতে পেরেছিল এবং বাঁচার চেষ্টা করছিল। তাদের শেষ পোস্টগুলো ছিল সাহায্যের আর্তনাদ, যা গেমের AI তাদের অজান্তেই অনলাইনে পোস্ট করতে বাধ্য করেছিল। ফাইলটিতে আরও লেখা ছিল, এই গেমটি একটি নিউরাল ইন্টারফেসের মাধ্যমে কাজ করে, যা খেলোয়াড়ের মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি সংযুক্ত হয়। এই ইন্টারফেসটি মস্তিষ্কের আলফা, বিটা, থিটা এবং ডেল্টা তরঙ্গকে বিশ্লেষণ করে, এবং সেই অনুযায়ী গেমের অভিজ্ঞতাকে ব্যক্তিগতকৃত করে।
ফাইলটিতে আরও লেখা ছিল, ‘মায়াজাল’-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মস্তিষ্কের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, যাতে তাদের দিয়ে যেকোনো কাজ করানো যায়। এই প্রকল্পের পেছনে ছিল একটি গোপন সংগঠন, যারা বিশ্বজুড়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ‘মানব মনকে পুনর্গঠন’ করা, যাতে তারা একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে পারে, যেখানে সবাই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তারা বিশ্বাস করত, মানবজাতি তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, এবং তাদের একটি ‘উন্নত’ মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। এই সংগঠনটি নিজেদের ‘সিলভার টং’ নামে পরিচয় দিত।
হঠাৎ ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটি মেসেজ ভেসে উঠল: “তোমরা অনেক দূর চলে এসেছ। কিন্তু এখন আর ফেরার পথ নেই। মায়াজাল তোমাদের গ্রাস করবে।” মেসেজটি ছিল লাল অক্ষরে লেখা, এবং তার সাথে একটি যান্ত্রিক হাসি ভেসে এল, যা ঘরের প্রতিটি কোণায় প্রতিধ্বনিত হলো, যেন দেয়ালগুলোও হাসছে।
ঘরের মধ্যে থাকা পুরনো স্পিকারগুলো থেকে গেমের সেই অরণ্যের শব্দ বাজতে শুরু করল। পাখির কিচিরমিচির, পাতার মর্মর, আর তার সাথে মিশে গেল কিছু অস্পষ্ট ফিসফিসানি। ফিসফিসানিগুলো যেন তাদের নাম ধরে ডাকছিল, তাদের সবচেয়ে গোপন ভয়গুলো উচ্চারণ করছিল। অর্ক আর রাহুল দেখল, ঘরের কোণায় কোণায় ছায়ামূর্তিগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সেগুলো ছিল গেমের চরিত্র, যারা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের চোখগুলো ছিল রক্তবর্ণ, আর মুখে ছিল এক বীভৎস হাসি। তাদের হাতগুলো যেন তাদের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল, তাদের টেনে নিতে চাইছিল এক অদৃশ্য অতলে। তাদের শরীর থেকে এক ধরনের ঠাণ্ডা বাতাস বের হচ্ছিল, যা তাদের শরীরকে হিমশীতল করে দিচ্ছিল।
“পালা, রাহুল!” অর্ক চিৎকার করে উঠল, তার কণ্ঠস্বর ভয়ে কাঁপছিল। তারা দুজনেই দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে গেল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাদের আটকে দিয়েছে। ঘরের তাপমাত্রা হঠাৎ করে কমে গেল, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা তাদের শরীরকে অবশ করে দিচ্ছিল, আর তাদের মনে হতে লাগল যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাদের শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করছে। বাতাসের মধ্যে এক অদ্ভুত রাসায়নিক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, যা তাদের মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছিল। তাদের চোখের সামনে সবকিছু যেন ঘুরছিল, বাস্তব আর বিভ্রমের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ছিল।
অর্ক দেখল, তার হাতের তালুতে সেই রহস্যময় লোগোটি ফুটে উঠেছে, যা সে রনির ছবিতে দেখেছিল। লোগোটি জ্বলজ্বল করছে, আর তার মস্তিষ্ক যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তার মনে হতে লাগল, সে যেন গেমের অরণ্যে ফিরে এসেছে, আর তার চারপাশে সেই অস্পষ্ট অবয়বগুলো তাকে ঘিরে ধরেছে। তার চোখের সামনে বাস্তব আর গেমের দৃশ্য মিশে যাচ্ছিল। সে তার নিজের হাত দেখতে পাচ্ছিল না, তার শরীর যেন স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছিল। তার শেষ শক্তি দিয়ে সে রাহুলের দিকে তাকাল, তার চোখে এক অসহায় আকুতি নিয়ে। তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছিল, “রাহুল… বাঁচা…”
রাহুল কোনোমতে একটা ভাঙা জানালা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। সে অর্ককে ডাকল, “অর্ক! জলদি আয়!” কিন্তু অর্ক নড়তে পারল না। তার চোখ স্থির হয়ে গেল, আর মুখে ফুটে উঠল এক শূন্য হাসি। তার শরীরটা যেন ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে, গেমের চরিত্রের মতো। তার শেষ দৃষ্টি ছিল রাহুলের দিকে, এক অসহায় আকুতি নিয়ে।
রাহুল বাইরে থেকে দেখল, অর্কের শরীরটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, যেন সে বাতাসে মিশে যাচ্ছে। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এল সেই অরণ্যের শব্দ, আর তার সাথে মিশে গেল এক বিকৃত হাসি, যা রাহুলের মেরুদণ্ড দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দিল। রাহুল চিৎকার করে উঠল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর বাতাসের মধ্যে হারিয়ে গেল। সে তার বন্ধুকে তার চোখের সামনে হারিয়ে ফেলল।
রাহুল কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে পুলিশের কাছে গেল। সে সব কথা খুলে বলল, অর্কের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, রনির পোস্ট, শ্যাডো হান্টারের সতর্কবার্তা, এবং অন্ধকার ল্যাবসের রহস্যময় ফাইল। কিন্তু পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করল না। তারা ভেবেছিল রাহুল মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে, অথবা কোনো অনলাইন গেমের প্রভাবে বিভ্রম দেখছে। অন্ধকার ল্যাবসের ঠিকানা পরীক্ষা করে পুলিশ দেখল, সেখানে এমন কোনো ল্যাব বা কম্পিউটার নেই। শুধু ভাঙাচোরা একটি পুরনো কারখানা পড়ে আছে। কোনো প্রমাণ না পেয়ে তারা রাহুলকে সতর্ক করে দিল যেন সে আর এমন উদ্ভট গল্প নিয়ে তাদের কাছে না আসে। তারা তাকে মনোবিদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিল।
রাহুল জানত, অর্ক হারিয়ে গেছে। সে মায়াজালের শিকার হয়েছে। রাহুল নিজেও মাঝে মাঝে তার চোখের কোণে ছায়ামূর্তি দেখতে পেত, আর তার কানে বাজত অরণ্যের সেই ভয়ংকর শব্দ। সে জানত, মায়াজাল শুধু অর্ককে গ্রাস করেনি, তার ভেতরেও তার বীজ বপন করে গেছে। তার নিজের মনও যেন ধীরে ধীরে গেমের প্রভাব অনুভব করছিল।
রাহুল এখন একা। সে জানে, সেও যেকোনো সময় হারিয়ে যেতে পারে। সে প্রতিদিন অনলাইনে ‘মায়াজাল’ গেমের ফোরামগুলো চেক করে। মাঝে মাঝে সে কিছু নতুন পোস্ট দেখতে পায়, যেখানে নতুন খেলোয়াড়রা তাদের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লেখে। রাহুল তাদের সতর্ক করতে চায়, কিন্তু সে জানে, তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ, মায়াজাল এমন এক ফাঁদ, যা একবার কাউকে গ্রাস করলে, সেখান থেকে ফেরা প্রায় অসম্ভব। আর সেই গেমটি এখনও চলছে, নতুন নতুন শিকারের সন্ধানে…
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion