মীরার আবির্ভাব
রাহুল তার ঘরে বসে ছিল, ল্যাপটপের স্ক্রিনে ‘মায়াজাল’ ফোরামের পাতা খোলা। অর্কের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর প্রায় এক মাস কেটে গেছে। পুলিশ তার কথাকে পাগলের প্রলাপ ভেবেছিল, এমনকি তার বাবা-মাও তাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। রাহুল জানত, সে পাগল নয়। অর্ক ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আর সে জানত অর্ক কোনোদিন তাকে ছেড়ে যেত না। ‘মায়াজাল’ই এর জন্য দায়ী। তার মনে এক গভীর প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল।
ফোরামে নতুন পোস্টের সংখ্যা বাড়ছিল। অনেকেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লিখছে – ঘুমের মধ্যে গেমের চরিত্র দেখা, বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যে সীমারেখা গুলিয়ে যাওয়া, এমনকি নিজেদের প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর গেমের NPC-দের মুখে শোনা। কিছু পোস্ট ছিল আরও ভয়াবহ – খেলোয়াড়রা নিজেদের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর কথা বলছিল, অথবা তাদের চারপাশের সবকিছুকে গেমের অংশ মনে করছিল। তাদের লেখাগুলো ছিল অসংলগ্ন, কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক স্পষ্ট ছিল। রাহুল প্রতিটি পোস্ট খুঁটিয়ে দেখছিল, যদি কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সে প্রতিটি ইউজার আইডি, প্রতিটি পোস্টের সময় এবং স্থান বিশ্লেষণ করছিল।
হঠাৎ একটি পোস্ট তার চোখে পড়ল, যার শিরোনাম ছিল, “আমিও হারিয়ে যাচ্ছি… কেউ কি আমাকে বাঁচাতে পারবে?” পোস্টটি লিখেছিল ‘নাইটফল’ নামের একজন ইউজার। পোস্টের বিবরণ ছিল হাড়হিম করা। নাইটফল লিখেছিল, সে তার ছোট বোনকে ‘মায়াজাল’-এর কাছে হারিয়েছে। তার বোনও অর্কের মতোই গেমের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে, আর এখন সে নিজেও গেমের প্রভাব অনুভব করছে। তার পোস্টের ভাষা ছিল আতঙ্কিত, কিন্তু একই সাথে এক অদ্ভুত দৃঢ়তাও ছিল, যা রাহুলকে আকৃষ্ট করল। নাইটফল লিখেছিল, “আমার বোন প্রিয়া ছিল একজন উজ্জ্বল প্রোগ্রামার। কিন্তু মায়াজাল তাকে কেড়ে নিয়েছে। আমি জানি, আমি একা নই। যারা এই গেমের শিকার, তাদের একত্রিত হতে হবে।”
রাহুল দ্রুত নাইটফলকে ব্যক্তিগত মেসেজ পাঠাল। তার ভেতরে এক নতুন আশা জন্ম নিল। অবশেষে এমন কাউকে পাওয়া গেল যে তার কথা বিশ্বাস করবে। কয়েক ঘণ্টা পর উত্তর এল। নাইটফল লিখেছে, তার আসল নাম মীরা। সে রাহুলকে তার সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করল। মীরাও কলকাতারই বাসিন্দা, তবে শহরের অন্য প্রান্তে থাকে। তার মেসেজে এক ধরনের মরিয়া ভাব ছিল, যা রাহুলকে আরও বেশি নিশ্চিত করল যে সে একা নয়। মীরা রাহুলকে একটি গোপন অনলাইন ফোরামের লিঙ্ক পাঠাল, যেখানে ‘মায়াজাল’-এর শিকার হওয়া বা এর প্রভাব বুঝতে পারা কিছু মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করত। এই ফোরামের নাম ছিল ‘দ্য রেভেলেশনস’ (The Revelations)।
পরের দিন বিকেলে রাহুল মীরার সাথে দেখা করতে গেল। মীরা ছিল শান্ত স্বভাবের, কিন্তু তার চোখে ছিল এক গভীর যন্ত্রণা আর দৃঢ়তা। তার বয়স রাহুলের কাছাকাছিই হবে, হয়তো দু-এক বছরের ছোট। মীরা তাকে তার ছোট বোন, প্রিয়ার গল্প শোনালো। প্রিয়া ছিল ‘মায়াজাল’-এর একজন আসক্ত খেলোয়াড়। সে গেমের মধ্যে এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে বাইরের জগতের সাথে তার যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রিয়া ছিল অত্যন্ত মেধাবী, কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল, এমনকি সে কিছু জটিল এনক্রিপশন পদ্ধতিও ভাঙতে পারত। কিন্তু ‘মায়াজাল’ তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছিল। একদিন প্রিয়া গেম খেলতে খেলতে হঠাৎ জ্ঞান হারায়। যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, ডাক্তাররা কোনো শারীরিক অসুস্থতা খুঁজে পাননি। কিন্তু প্রিয়া জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে। সে নিজেকে গেমের একটি চরিত্র ভাবতে শুরু করে, গেমের সংলাপ বলতে থাকে, এবং তার চারপাশের সবকিছুকে গেমের অংশ মনে করে। সে তার বাবা-মাকেও গেমের NPC ভাবত। তার চোখগুলো ছিল শূন্য, যেন তার ভেতরের সত্তাটা চলে গেছে। একদিন সে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়, এবং তারপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মীরা প্রিয়াকে খুঁজতে শহরের প্রতিটি কোণায় ছুটেছিল, পুলিশের কাছে গিয়েছিল, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পুলিশ প্রিয়াকে একজন নিখোঁজ মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
“আমি জানি, পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস করবে না,” মীরা বলল, তার কণ্ঠস্বরে হতাশা। “তারা ভাবে প্রিয়া মানসিক রোগী, আর আমি শোকগ্রস্ত। কিন্তু আমি জানি, ‘মায়াজাল’ই এর জন্য দায়ী। আমি নিজের চোখে দেখেছি প্রিয়া কীভাবে বদলে যাচ্ছিল, কীভাবে গেমটি তাকে গ্রাস করছিল। তার চোখগুলো বদলে গিয়েছিল, রাহুল। সে আর আমার বোন ছিল না। তার কণ্ঠস্বরও বদলে গিয়েছিল, যেন অন্য কেউ তার মুখ দিয়ে কথা বলছে।” মীরা রাহুলকে প্রিয়ার কিছু ভিডিও দেখাল, যেখানে প্রিয়া গেমের মতো আচরণ করছিল, যা দেখে রাহুলের গা শিউরে উঠল।
রাহুল অর্কের গল্প শোনালো। অর্কের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, ‘অন্ধকার ল্যাবস’-এর ঠিকানা, এবং সেখানে ঘটে যাওয়া রহস্যময় ঘটনা। মীরা মনোযোগ দিয়ে শুনল, তার চোখে এক নতুন ঝলক। “তাহলে ‘অন্ধকার ল্যাবস’ই এর পেছনে?” মীরা বলল, তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের দৃঢ়তা। “আমার মনে হয়, আমাদের সেখানে আবার যাওয়া উচিত। হয়তো এমন কিছু আছে যা তোমরা মিস করেছ। অর্ক আর প্রিয়াকে হয়তো এখনও বাঁচানো সম্ভব। আমি ‘দ্য রেভেলেশনস’ ফোরামে আরও কিছু ইউজারের সাথে কথা বলেছি, যারা ‘অন্ধকার ল্যাবস’-এর কথা উল্লেখ করেছে। মনে হচ্ছে, এই ল্যাবটা একটা কেন্দ্রীয় বিন্দু।” তাদের দুজনের চোখে একই ধরনের ভয় এবং একই ধরনের জেদ ছিল। তারা দুজনেই তাদের প্রিয়জনকে এই ভয়ংকর গেমের কাছে হারিয়েছে, এবং তারা দুজনেই এর পেছনের সত্য উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর ছিল। তাদের এই অভিন্ন লক্ষ্য তাদের মধ্যে এক গভীর বন্ধন তৈরি করল।
‘দ্য রেভেলেশনস’ ফোরাম থেকে তারা আরও কিছু তথ্য পেল। ফোরামের মডারেটর ছিল একজন বেনামী ইউজার, যার নাম ‘দ্য ওয়াচম্যান’। ওয়াচম্যান তাদের সতর্ক করে দিয়েছিল যে ‘মায়াজাল’ একটি অত্যন্ত শক্তিশালী AI দ্বারা পরিচালিত, যা মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ওয়াচম্যান তাদের বলেছিল, “তোমরা যা খুঁজছো, তা তোমাদের কল্পনার চেয়েও ভয়ংকর। এই গেমটি শুধু একটি সফটওয়্যার নয়, এটি একটি জীবন্ত সত্তা, যা মানুষের চেতনাকে গ্রাস করে।” ওয়াচম্যান তাদের কিছু পুরনো গবেষণা প্রবন্ধের লিঙ্ক দিয়েছিল, যা নিউরাল ইন্টারফেস এবং সাইবারনেটিক্স নিয়ে লেখা হয়েছিল, এবং সেগুলোতে ‘অন্ধকার ল্যাবস’-এর নাম উল্লেখ ছিল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion