নতুন শুরু, নতুন চ্যালেঞ্জ : স্মৃতিচক্র’র আগমন
‘মায়াজাল’ বন্ধ হওয়ার পর রাহুল আর মীরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু তাদের জীবন আর আগের মতো ছিল না। তারা জানত, এই পৃথিবীতে এমন অন্ধকার শক্তি আছে যা মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তারা এখন আর সাধারণ গেমার বা ছাত্র ছিল না, তারা ছিল সত্যের সৈনিক, যারা এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করেছিল। তারা এখন সমাজ এবং প্রযুক্তির অন্ধকার দিক সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। তারা নিজেদের একটি ছোট গবেষণা দল হিসেবে গড়ে তুলেছিল, যারা নিউরাল ইন্টারফেস প্রযুক্তি এবং এর সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে গবেষণা করত।
রাহুল মাঝে মাঝে অর্কের কথা ভাবত। সে প্রতিদিন হাসপাতালে অর্ককে দেখতে যেত। অর্ক শুয়ে থাকত, তার চোখ খোলা, কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল শূন্য। রাহুল জানত, অর্কের শরীরটা তার সামনে থাকলেও, তার মনটা হয়তো এখনও মায়াজালের অরণ্যে বন্দী। প্রিয়ার অবস্থাও একই রকম ছিল। সে মাঝে মাঝে অস্ফুটে গেমের সংলাপ বলত, যা মীরার হৃদয় ভেঙে দিত। প্রিয়া তার হাতে সেই রহস্যময় লোগোটি আঁকত, যা অর্কের হাতেও দেখা গিয়েছিল।
মীরাও তার বোনের জন্য চিন্তিত ছিল। সে তার বোনের পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাত, তার হাত ধরে থাকত, যদি কোনোভাবে প্রিয়া সাড়া দেয়। তারা দুজনেই নিজেদের অপরাধী মনে করত, কারণ তারাই এই গেমের প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং তাদের প্রিয়জনদের এই বিপদে ফেলেছিল। কিন্তু তারা জানত, এই অপরাধবোধ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না, তাদের আরও কিছু করতে হবে। তারা ‘দ্য রেভেলেশনস’ ফোরামের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল, এবং ওয়াচম্যানের সাথে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান করত।
একদিন রাহুল তার কম্পিউটারে বসেছিল, পুরনো গেমিং ফোরামগুলো দেখছিল। সে এখন আর শুধু গেমারদের ফোরাম দেখে না, সে সাইবার নিরাপত্তা এবং নিউরোসায়েন্স সম্পর্কিত ফোরামগুলোও দেখে। হঠাৎ তার স্ক্রিনে একটি নতুন গেমের বিজ্ঞাপন ভেসে উঠল। গেমটির নাম ছিল ‘স্মৃতিচক্র’ (Smriti Chakra)। গেমটির স্লোগান ছিল, “স্মৃতিচক্র: যেখানে তুমি তোমার হারানো স্মৃতি ফিরে পাবে। তোমার অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশ করো, এবং তোমার অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচন করো।” বিজ্ঞাপনে একটি শান্ত, ধ্যানের মতো পরিবেশ দেখানো হয়েছিল, যা ‘মায়াজাল’-এর ভয়ংকর অরণ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। বিজ্ঞাপনে এমন কিছু ছবি ছিল, যা মানুষের মনে হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে আনার এক ধরনের আশা জাগিয়ে তুলছিল।
রাহুল চমকে উঠল। এই স্লোগানটি ছিল ‘মায়াজাল’-এর স্লোগানের মতোই প্রলোভনসঙ্কুল, কিন্তু আরও বেশি ব্যক্তিগত। তার মনে মাস্টারের কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল: “মায়াজাল অমর।” এটা কি মাস্টারের নতুন ফাঁদ? নাকি অর্ক আর প্রিয়াকে ফিরে পাওয়ার কোনো সুযোগ? যদি এই গেমটি সত্যিই হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে হয়তো অর্ক আর প্রিয়ার মনকে আবার স্বাভাবিক করা সম্ভব। কিন্তু এর ঝুঁকিও ছিল বিশাল। মাস্টারের উদ্দেশ্য কী, তা তারা জানত না।
সে মীরাকে ফোন করল। “মীরা, আমি একটি নতুন গেমের বিজ্ঞাপন দেখেছি,” রাহুল বলল, তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের উত্তেজনা আর ভয় মিশে ছিল। “এর নাম ‘স্মৃতিচক্র’।”
মীরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার মনেও একই প্রশ্ন ঘুরছিল। “রাহুল, আমরা জানি না এটা কী। কিন্তু আমরা আর কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না। মাস্টার খুবই চতুর। এটা তার নতুন চাল হতে পারে। সে হয়তো আমাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে।”
“কিন্তু যদি অর্ক বা প্রিয়াকে ফিরে পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে?” রাহুল বলল, তার চোখে এক ধরনের মরিয়া আশা। “যদি এই গেমটা তাদের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারে? আমরা ড. অন্বেষা মিত্রের ডায়েরিতে দেখেছি, নিউরাল সংযোগগুলো ফিরিয়ে আনা সম্ভব। হয়তো এই গেমটি সেই কিল সুইচেরই একটি উন্নত সংস্করণ।”
মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেও তার বোনকে ফিরে পেতে মরিয়া ছিল। “আমরা খুব সাবধানে এগোব, রাহুল। এইবার আমরা কোনো ভুল করব না। আমরা একা নই। আমরা এইবার আরও বেশি সতর্ক থাকব। আমরা এই গেমের মেকানিক্সগুলো আগে ভালো করে বুঝে নেব। ওয়াচম্যানের সাথে কথা বলতে হবে।”
তারা জানত, তাদের সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ‘মায়াজাল’ ছিল শুধু শুরু। ‘সিলভার টং’ এবং মাস্টারের ষড়যন্ত্র ছিল আরও গভীর। রাহুল আর মীরা প্রস্তুত ছিল। তারা জানত, তাদের লড়াই এখনও শেষ হয়নি। এইবার তারা শুধু নিজেদের নয়, অর্ক, প্রিয়া এবং আরও অনেক মানুষকে বাঁচাতে প্রস্তুত ছিল, যারা ‘স্মৃতিচক্র’ নামের নতুন মায়াজালের শিকার হতে চলেছে। তাদের এই যাত্রা ছিল অজানা, কিন্তু তাদের দৃঢ়তা ছিল অটুট। তারা জানত, সত্যের সন্ধানে তাদের আরও অনেক অন্ধকার পথ পেরোতে হবে, এবং এইবার তারা একাই নয়, তাদের সাথে ছিল তাদের অভিজ্ঞতা আর একে অপরের প্রতি বিশ্বাস। তারা জানত, মাস্টারের এই নতুন খেলার শেষ কোথায়, তা তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। তারা প্রস্তুত ছিল এক নতুন মানসিক যুদ্ধের জন্য, যা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। ‘স্মৃতিচক্র’ কি সত্যিই মুক্তির পথ, নাকি এক নতুন মায়াজাল? এর পেছনে কি লুকিয়ে আছে আরও ভয়ংকর কোনো ষড়যন্ত্র?
~সমাপ্ত~
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion