অন্ধকার ল্যাবসের চূড়ান্ত অধ্যায়
কিল সুইচ অ্যাক্টিভেট হওয়ার পর ‘মায়াজাল’ গেমটি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। রাহুলের কম্পিউটার থেকে গেমের সমস্ত ফাইল মুছে গেল, যেন এটি কখনো ছিলই না। কিন্তু রাহুল আর মীরা জানত, তাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। ‘অন্ধকার ল্যাবস’ এবং এর পেছনের গোপন সংগঠন সম্পর্কে তাদের আরও জানতে হবে। তাদের প্রিয়জনদের ফিরে পাওয়ার এখনও একটি ক্ষীণ আশা ছিল।
তারা আবার অন্ধকার ল্যাবসে ফিরে গেল। এবার জায়গাটা ছিল সম্পূর্ণ নীরব। গেমের কোনো শব্দ নেই, কোনো ছায়ামূর্তি নেই। বাতাসের সেই স্যাঁতসেঁতে গন্ধটাও যেন কমে গেছে। তারা সেই কক্ষের দিকে গেল যেখানে অর্ক অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কক্ষটি ছিল খালি, কিন্তু মাঝখানে একটি ছোট ডিভাইস পড়ে ছিল, যা আগে তারা দেখেনি। ডিভাইসটি ছিল একটি প্রজেক্টর, যা মানুষের মস্তিষ্ক তরঙ্গকে ডিজিটাল সিগন্যালে রূপান্তরিত করতে পারত এবং গেমের জগতে তাদের অস্তিত্বকে প্রক্ষেপণ করত। এই ডিভাইসটিই ছিল ‘মায়াজাল’-এর মূল ভিত্তি। এটি একটি নিউরাল ইন্টারফেস প্রজেক্টর (NIP) নামে পরিচিত ছিল।
মীরা ডিভাইসটি পরীক্ষা করল। “এটা ড. অন্বেষা মিত্রের ডায়েরিতে লেখা সেই ডিভাইস,” মীরা বলল। “এটা দিয়েই তারা মানুষের মনকে গেমের সাথে সংযুক্ত করত। এটা নিউরাল ইন্টারফেস প্রজেক্টর।” মীরা তার পোর্টেবল ল্যাপটপটি ডিভাইসের সাথে সংযুক্ত করল এবং ডেটা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করল। সে দেখল, ডিভাইসের ভেতরে একটি ছোট মেমরি কার্ড লুকানো আছে।
তারা ডিভাইসটি নিয়ে বাইরে এল। মীরা তার ল্যাপটপে মেমরি কার্ডটি সংযুক্ত করল। মেমরি কার্ডটি থেকে কিছু ডেটা উদ্ধার হলো। ডেটাগুলো ছিল ‘অন্ধকার ল্যাবস’-এর কর্মীদের তালিকা, তাদের গবেষণার বিস্তারিত বিবরণ, এবং তাদের গোপন সংগঠনের নাম – ‘সিলভার টং’ (Silver Tongue)। ডেটাগুলোর মধ্যে কিছু অডিও ফাইলও ছিল, যেখানে কর্মীদের কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছিল। এই অডিও ফাইলগুলোতে ‘সিলভার টং’-এর সদস্যদের পরিকল্পনা এবং তাদের ভয়ংকর উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
‘সিলভার টং’ ছিল একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, যারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল বিশ্বজুড়ে ক্ষমতা দখল করা, এবং ‘মায়াজাল’ ছিল তাদের প্রথম ধাপ। তারা মানুষের ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ করত, তাদের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করত, এবং তারপর ‘মায়াজাল’ গেমের মাধ্যমে তাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করত। যারা গেমের গভীরে প্রবেশ করত, তাদের ব্যক্তিত্বকে তারা শোষণ করে নিত, এবং তাদের দিয়ে তাদের ইচ্ছামতো কাজ করাত। অর্ক আর প্রিয়া ছিল তাদের শিকার। তাদের মস্তিষ্ক এখন এক ধরনের কোমায় ছিল, যেখানে তারা গেমের জগতে বন্দী। ‘সিলভার টং’ বিশ্বাস করত যে তারা মানবজাতির বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে, একটি ‘উন্নত’ এবং ‘নিয়ন্ত্রিত’ সমাজ তৈরি করছে। তাদের স্লোগান ছিল, “নিয়ন্ত্রণই মুক্তি।”
ডেটাগুলোতে ‘সিলভার টং’-এর প্রধানের নামও ছিল – একজন রহস্যময় ব্যক্তি, যার নাম শুধু ‘মাস্টার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মাস্টার ছিল একজন প্রাক্তন নিউরোসায়েন্টিস্ট, যিনি ড. অন্বেষা মিত্রের সহকর্মী ছিলেন। তার আসল নাম ছিল ড. বিক্রম রায়। অডিও ফাইলগুলোতে মাস্টারের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল – ঠান্ডা, আত্মবিশ্বাসী, এবং এক ধরনের বিকৃত অহংকারপূর্ণ। সে ড. মিত্রকে তার গবেষণার জন্য ব্যবহার করেছিল, এবং যখন ড. মিত্র তার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলেন, তখন মাস্টার তাকে আটকে রেখেছিল, যাতে তার পরিকল্পনা ফাঁস না হয়।
ড. বিক্রম রায় ছিলেন একসময় একজন উজ্জ্বল নিউরোসায়েন্টিস্ট, যিনি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানব মস্তিষ্ক তার সম্পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে না, এবং এটি বিশৃঙ্খল আবেগ ও দুর্বলতার দ্বারা পরিচালিত হয়। তার লক্ষ্য ছিল এমন একটি প্রযুক্তি তৈরি করা, যা মানুষের মনকে ‘পুনর্গঠন’ করতে পারে, যাতে তারা আরও যুক্তিসঙ্গত এবং উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তিনি তার গবেষণার জন্য অর্থায়ন পেতে ব্যর্থ হন, এবং তাকে ‘উন্মাদ বিজ্ঞানী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রত্যাখ্যান তাকে আরও বেশি করে তার নিজের বিশ্বাসে দৃঢ় করে তোলে।
এই সময়েই তার সাথে পরিচয় হয় এক গোপন সংগঠনের, যারা নিজেদের ‘সিলভার টং’ নামে পরিচয় দিত। এই সংগঠনটি ছিল সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একটি গোপন নেটওয়ার্ক, যারা বিশ্বজুড়ে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। তারা মাস্টারের গবেষণার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল এবং তাকে অর্থায়ন করার প্রস্তাব দিয়েছিল। মাস্টারের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মনকে ‘উন্নত’ করা, আর ‘সিলভার টং’-এর উদ্দেশ্য ছিল সেই ‘উন্নত’ মনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও, তাদের পথ ছিল একই। এভাবেই ‘অন্ধকার ল্যাবস’ প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ‘মায়াজাল’ প্রকল্প শুরু হয়। ‘মায়াজাল’ ছিল তাদের প্রথম বড় আকারের পরীক্ষা, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর চালানো হয়েছিল।
রাহুল আর মীরা বুঝতে পারল, তাদের সামনে এক বিশাল ষড়যন্ত্রের জাল। তারা শুধু একটি গেম বন্ধ করেনি, তারা একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী সংগঠনের মুখোশ উন্মোচন করেছে। ‘সিলভার টং’-এর সদস্যরা ছিল সমাজের উচ্চ স্তরের মানুষ – বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, এমনকি কিছু সামরিক কর্মকর্তা। তাদের ক্ষমতা ছিল বিশাল, এবং তাদের নেটওয়ার্ক ছিল বিশ্বজুড়ে।
তারা সমস্ত তথ্য পুলিশের কাছে নিয়ে গেল। এবার পুলিশ তাদের কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো, কারণ তাদের কাছে ছিল ড. অন্বেষা মিত্রের ডায়েরি, ডিভাইস থেকে উদ্ধার করা ডেটা, এবং মাস্টারের অডিও ফাইল, যা তাদের ষড়যন্ত্রের প্রমাণ দিচ্ছিল। ‘সিলভার টং’-এর বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরু হলো। তাদের গোপন ল্যাবগুলো খুঁজে বের করা হলো, এবং তাদের কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হলো। সারা বিশ্বে এই খবর ছড়িয়ে পড়ল, এবং মানুষ ‘মায়াজাল’ গেমের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পারল। সরকারগুলো দ্রুত অনলাইন গেমিং এবং নিউরাল ইন্টারফেস প্রযুক্তির উপর নতুন নিয়মকানুন জারি করল।
কিন্তু মাস্টার, ড. বিক্রম রায়কে খুঁজে পাওয়া গেল না। সে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, যেন সে বাতাসে মিশে গেছে। তার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। রাহুল আর মীরা জানত, মাস্টার যেকোনো সময় আবার ফিরে আসতে পারে, এবং নতুন কোনো ‘মায়াজাল’ তৈরি করতে পারে। সে ছিল একজন চতুর এবং বিপজ্জনক ব্যক্তি, যে মানুষের মনকে তার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। তার উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতিকে তার নিয়ন্ত্রণে আনা, এবং সে সহজে হাল ছাড়ার পাত্র ছিল না।
অর্কের বাবা-মা এবং প্রিয়ার বাবা-মা তাদের সন্তানদের ফিরে পেয়েছিলেন, কিন্তু তারা ছিল এক ধরনের কোমা অবস্থায়। কিল সুইচ গেমটিকে বন্ধ করে দিলেও, তাদের মস্তিষ্কের উপর গেমের প্রভাব সম্পূর্ণভাবে দূর হয়নি। ডাক্তাররা বলেছিলেন, তাদের মস্তিষ্কের নিউরাল সংযোগগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে, এবং তারা সম্পূর্ণ সুস্থ হবে কিনা, তা কেউ বলতে পারছিল না। রাহুল আর মীরা জানত, তাদের লড়াই এখনও শেষ হয়নি। তাদের প্রিয়জনদের সুস্থ করে তোলার জন্য তাদের আরও কিছু করতে হবে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion