সূর্য তখন সবেমাত্র সুন্দরবনের কাদা-মাটি আর ম্যানগ্রোভ গাছের মাথার উপর আলো ছড়াতে শুরু করেছে। বনবিভাগের অফিসার অরূপ সেন তার অফিসের বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল। বাতাসে একটা আর্দ্র নোনতা গন্ধ, তার বহুদিনের চেনা। তবুও আজ কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক নীরবতা। এই নীরবতা সুন্দরবনের স্বাভাবিক নিস্তব্ধতা নয়, এ যেন এক আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস, যা সমস্ত প্রাণীর শব্দকেও গ্রাস করেছে।
অরূপের পেশা যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনই রোমাঞ্চকর, কিন্তু গত এক মাস ধরে পরিবেশ যেন আরও বেশি রহস্যময়। তিন সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হয়েছে তিনজন কাঠুরে, তারপর একজন মউলি (মধু সংগ্রহকারী) ফিরে এসে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। তার চোখগুলো সব সময় যেন অদেখা কোনো আলোর আতঙ্ক নিয়ে স্থির। আর সবথেকে বড় দুশ্চিন্তা—অরূপের ছোট ভাই ধ্রুবও নিখোঁজ।
ধ্রুব একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। তার চোখ সবসময় খুঁজে বেড়াতো প্রকৃতির লুকানো সৌন্দর্য। সপ্তাহখানেক আগে ধ্রুব শেষবার অরূপকে ফোন করেছিল। তার কণ্ঠস্বর ছিল ভাঙা, উত্তেজিত এবং ভয় মেশানো।
"দাদা, এখানে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখছি। আকাশ থেকে একটা ঘূর্ণায়মান, ধোঁয়াময় আলোর স্তম্ভ নেমে এসে জঙ্গলটাকে যেন দুভাগ করে দিয়েছে। স্তম্ভের চারপাশে গাছপালাগুলো যেন সময়ের গভীরে জমে গেছে। এর থেকে একটা কম্পন অনুভব করা যাচ্ছে, কিন্তু কাছে যেতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এটা প্রকৃতি নয়, অন্য কোনো এক অজানা জগতের সৃষ্টি। ক্যামেরা কাজ করছে না, দাদা! আমার সমস্ত যন্ত্রপাতি ডেড!"
ফোনটা কেটে যাওয়ার পরই শুরু হলো খোঁজ। সরকারি অনুসন্ধান দল, স্থানীয় মাঝি—সবাই ব্যর্থ। ধ্রুবর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অরূপের যুক্তিবাদী মন এখন এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। সে জানে, এই ঘটনাকে কোনো সাধারণ বাঘের আক্রমণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
অরূপের অস্বস্তির আরও একটি কারণ ছিল। গত দশ দিন ধরে সে একজন পরিবেশ বিজ্ঞানী ডঃ মিতালী বসুর কিছু অদ্ভুত রিপোর্ট পড়ছিল। মিতালী এসেছিলেন এই অঞ্চলের মাটি এবং প্রাণিজগতে হঠাৎ পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করতে।
মিতালীর শেষ রিপোর্টে লেখা ছিল: "জঙ্গলের মধ্যভাগে একটি অস্বাভাবিক 'শক্তি শোষণ ক্ষেত্র' (Energy Absorption Field) তৈরি হচ্ছে। এটি কেবল ইলেকট্রনিক্স নয়, বরং জৈবিক প্রাণশক্তিকেও শুষে নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি কোনো প্রাকৃতিকভাবে অসম্ভব ডাইমেনশনাল ফল্ট বা সময়-স্থানের ত্রুটি নির্দেশ করে। এই শক্তি ক্ষেত্রটি ক্রমাগত বাড়ছে। আমি এর উৎসের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। মনে হচ্ছে, আমি এক মৃত্যুর দরজা-র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি।"
অরূপের সামনে তখন বসে আছে স্থানীয় গাইড আনোয়ার। আনোয়ারের চোখ ভয়ে স্থির, তার গালের শিরাগুলো স্পষ্ট।
"ছোটবাবু, ওই অঞ্চলে আর পা দেবো না। ওটা 'আলো-চক্রের' জায়গা। যারা গেছে, কেউ ফেরেনি। ওখানকার আলোটা কেবল চোখের ধাঁধা নয়, ওটা আত্মার ফাঁদ। চার দিন আগে আমি নিজে দেখেছি... একটা মানুষ আলোর খুব কাছে যেতেই... একটা চিৎকার... আর তারপর সে নিথর পাথর হয়ে গেল! ধ্রুববাবুও যদি..."
অরূপের হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠল। পাথর! এই লোককথা আর মিতালীর বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট যেন এক অন্ধকার সত্যের দিকে ইঙ্গিত করছে। সে দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। "আনোয়ার, তুমি থাকো। আমি একা যাব। শুধু আমাকে বলো, মিতালী বসু নামে কোনো মহিলা গবেষক এর আশেপাশে ছিলেন কিনা?"
"হ্যাঁ ছোটবাবু। ওই যে বড়বাবু (ফরেস্ট রেঞ্জার) যাকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি ক'দিন আগে ওই আলো-চক্রের দিকেই তার সব যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কী যেন মেপে দেখছিলেন আর বারবার বলছিলেন—'মৃত্যুর দরজা'," আনোয়ার বলল।
অরূপের হাতে সময় নেই। আজ রাতের জোয়ারের আগেই তাকে রহস্যের কেন্দ্রে পৌঁছাতে হবে। সে তার পিঠে একটি ছোট ব্যাগ, শক্তিশালী টর্চ, এবং তার সার্ভিস রিভলভার নিয়ে প্রস্তুত হলো। সে জানে, এই পথ কেবল জঙ্গলের নয়, এ পথ এক গভীর, প্রাচীন রহস্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তার যুক্তির প্রাচীর ভেঙে পড়তে পারে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion