রাত গভীর। নদীর জলে তখনো জোয়ারের হালকা স্রোত। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর ঘন জঙ্গলের নৈঃশব্দ্য ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। নৌকোয় করে নদীর একটি শাখা ধরে জঙ্গলের আরও ভেতরে ঢুকছে অরূপ। প্রায় চার ঘণ্টা বৈঠা বাইবার পর সে পায়ে হেঁটে জঙ্গলে প্রবেশ করল। মাথার উপরে ম্যানগ্রোভের শাখা-প্রশাখা এমনভাবে জড়ানো যে চাঁদ বা নক্ষত্রের আলো ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে না।
কিছুদূর যেতেই শুরু হলো সেই বীভৎস দৃশ্য। একটি হরিণ দৌড়ানোর ভঙ্গিতে পাথর হয়ে আছে, তার চোখে ভয়। যেন শেষ মুহূর্তে সে মুক্তি চেয়েছিল। একটু দূরে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, থাবা তোলার মুহূর্তে স্থির। তার হিংস্রতা চিরকালের জন্য জমে গেছে। এই প্রস্তরীভূত অরণ্য যেন প্রকৃতির উপর এক জাদুকরী আক্রমণ, সময়ের এক নিষ্ঠুর উপহাস। গাছগুলোও অদ্ভুতভাবে পাথর হয়ে গেছে, তাদের শিরা-উপশিরাগুলোও যেন কঠিন হয়ে গিয়েছে।
এরপর অরূপ একটি খোলা জায়গায় এসে পৌঁছাল। জায়গাটা ছিল মাটির ঢিবির পাশে, একটি নীরব গবেষণাগার যেন।
প্রথমেই সে দেখল, মাটিতে পড়ে আছে কিছু অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম—একটি ট্রাইপডে বসানো তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপক যন্ত্র, একটি ভেঙে যাওয়া ল্যাপটপ, এবং কিছু তার। যন্ত্রগুলোতে এখনও যেন বিদ্যুতের তীব্র ক্ষরণের চিহ্ন লেগে আছে। এটি নিশ্চিতভাবে ডঃ মিতালী বসুর জিনিস।
তার ঠিক পাশেই, পাথরের বাঘটির কাছাকাছি, সে দেখল ধ্রুবর জিনিসপত্র—ধ্রুবর প্রিয় ক্যামেরা, Canon EOS R5, এবং তার গলায় ঝোলানো চেইন। ক্যামেরাটি হাতে নিতেই অরূপ অনুভব করল, এটি অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। যেন তার সব উষ্ণতা শুষে নেওয়া হয়েছে। ক্যামেরা থেকে মেমরি কার্ডটি বের করে দ্রুত পকেটে রাখল অরূপ। এই কার্ডটিই তার শেষ ভরসা।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক দৃশ্যটি ছিল কাছেই। মাটির ঢিবির পাশে, একটি বসার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে আছে একজন পাথরের নারী মূর্তি। মূর্তির গায়ে ল্যাব কোট আর হাতে একটি নোটবুক, যা পাথরের সাথে মিশে গেছে। মূর্তিটি ডঃ মিতালী বসুর!
মিতালীর মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে অরূপের শরীর হিম হয়ে গেল। হরিণ বা বাঘের চোখে ভয় ছিল, কিন্তু মিতালীর চোখে কোনো ভয় নেই। সেখানে একটা অদ্ভুত শান্তি এবং কৌতূহল! যেন তিনি কোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর পেয়েছেন, আর সেই উত্তরটি এতটাই ভয়ঙ্কর যে তার শরীরকে নিথর করে দিলেও মনকে মুক্তি দিয়েছে।
এই দৃশ্যে অরূপের যুক্তিবাদী মন সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেল। এই আলো শুধু প্রাণশক্তি শুষে নেয় না, এটি সম্ভবত জীবনের সব প্রশ্নকে নিথর করে দেয়।
মিতালী ও ধ্রুবর জিনিসপত্রের একটু দূরেই সে দেখতে পেল সেই আলোর স্তম্ভ (Pillar of Light)। প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচু, ঘোরানো, ধোঁয়ার মতো একটি আলো, যা তীব্রভাবে কম্পনশীল। স্তম্ভের গোড়ায় মাটিতে খোদাই করা কিছু অদ্ভুত প্রতীক এবং একটি ভাঙা ত্রিশূলের চিহ্ন স্পষ্ট। স্তম্ভটি থেকে একটা নিম্ন কম্পাঙ্কের গুঞ্জন ভেসে আসছে, যা কানে না বেজে সরাসরি মস্তিষ্কে আঘাত করছে।
অরূপ নিজেকে জোর করে থামাল এবং স্তম্ভের আকর্ষণ থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তার এখন শুধু একটিই কাজ—ধ্রুবকে খুঁজে বের করা।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion