অরূপ, আনোয়ার, নগেন সাধু এবং অমল রায়—চারজনের একটি অপ্রত্যাশিত দল সেই রাত দ্বিপ্রহরে অন্ধকূপের দিকে রওনা হলো। এই চারজন যেন যুক্তি, লোকবিশ্বাস, সাহস আর গোপন জ্ঞানের এক অদ্ভুত সমন্বয়।
অন্ধকূপটি ছিল ম্যানগ্রোভের একেবারে কেন্দ্রে, একটি ছোট মাটির টিলার নিচে লুকিয়ে থাকা এক গভীর কালো জলের কুয়ো। কুয়োর জল ছিল স্থির এবং গভীর, তার মধ্যে যেন অন্য কোনো জগতের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল। জায়গাটা ছিল শীতল এবং ভয়ংকর।
তারা যখন পৌঁছাল, তখন কুয়োর ধার বরাবর সেই আলোর স্তম্ভটি আবার ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। তবে এবার আলোটা সাদা বা নীল নয়, এটি একটি কালো আলো (Black Light), যা চারপাশের সমস্ত আলো শুষে নিচ্ছে, যেন এক শক্তিশালী শূন্যতা।
নরোত্তম কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করছে। তার হাতে জাদুদণ্ডের তিনটি টুকরো জোড়া লাগানো। তৃতীয় টুকরোটি লাগানোর ফলে দণ্ডটি এখন কালো ধাতু এবং কাঁচের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি। দণ্ডটি থেকে তীব্র ধাতব শব্দ বের হচ্ছিল।
"তোমরা কেন এসেছো? তোমরা কি আমার জ্ঞান আর ক্ষমতার পথে বাধা দিতে চাও?" নরোত্তম তীক্ষ্ণ স্বরে হেসে উঠল। "তোমাদের এই পৃথিবী, এই সুন্দরবন—সবই ধ্বংস হবে। আমি নতুন রহস্যের স্রষ্টা হব!"
নগেন সাধু চিৎকার করে বললেন, "নরোত্তম! তুই এই ধ্বংসলীলা বন্ধ কর! তুই জাঙ্গালদের চুক্তির অবমাননা করছিস!"
"চুক্তি?" নরোত্তম টিটকারি দিল। "তোমরা আমাকে বহিষ্কার করেছো, আর আজ সেই চুক্তির দোহাই দিচ্ছ? আমি এই দরজা খুলে দেব, এবং মৃত্যু-ছায়া এসে এই সুন্দরবনকে তার আসল রহস্যলোকে পরিণত করবে!" তার হাসি ছিল উন্মত্ত এবং ভয়ঙ্কর।
নরোত্তম তার দণ্ডটি কুয়োর কালো জলের দিকে তাক করল। দণ্ডের তৃতীয় টুকরোটি জ্বলজ্বল করে উঠল। কালো আলো স্তম্ভ থেকে কুয়োর জলে প্রবেশ করতে লাগল।
অমল রায় তার ব্যাগ থেকে একটি বিশেষ কম্পন-সৃষ্টিকারী যন্ত্র বের করার চেষ্টা করলেন। "এই জাদুকরী শক্তি আমি বুঝি না, কিন্তু আমি এর কম্পনে বাধা দিতে পারি।" তিনি দ্রুত যন্ত্রটি সেট করতে লাগলেন।
অরূপ হঠাৎ উপলব্ধি করল, নগেন সাধু বা অমল রায় কেউই জানেন না। তৃতীয় টুকরোটি কেবল নিয়ন্ত্রণের চাবি ছিল না, এটা ছিল একটি পরিবর্ধক (Amplifier)। ভবানী তার মেয়েকে ফেরানোর জন্য শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, আর নরোত্তম সেই শক্তি মুক্ত করতে চাইছে।
"নরোত্তম! এটা তোর ক্ষমতা নয়! তুই কেবল এক দাস! মৃত্যু-ছায়া তোকে ব্যবহার করছে!" অরূপ চিৎকার করল।
নরোত্তম হাসল। কালো আলো স্তম্ভটি ভয়ংকর আকার নিতে শুরু করল। স্তম্ভের ভেতর দিয়ে একটি বিশাল, কালো, ধোঁয়ার মতো হাত বেরিয়ে এলো—মৃত্যু-ছায়া! তার আগমন সমস্ত বাতাসকে শীতল করে দিল।
সময় নেই। অরূপ তার পকেট থেকে মহাপাড়ের তারা পাতা এবং ভবানীর দণ্ডের দুটি টুকরো বের করল।
"আনোয়ার! অমল রায়!" অরূপ নির্দেশ দিল। "তোমরা নরোত্তমের মনোযোগ অন্যদিকে নাও! আঘাত করো, নইলে সব শেষ!"
আনোয়ার আর অমল রায় দুজনই ঝাঁপিয়ে পড়ল নরোত্তমের দিকে। অমল রায় দ্রুত একটি বিস্ফোরক পিন নরোত্তমের দিকে ছুড়ে মারলেন, যা তীব্র ধোঁয়া সৃষ্টি করল। নরোত্তম মন্ত্রপাঠ বন্ধ করে তাদের ধাক্কা মারল।
এই সুযোগ! অরূপ কাঁপতে কাঁপতে তার হাতে থাকা দণ্ডের দুটি টুকরো, এবং ধ্রুবর দেওয়া মহাপাড়ের তারা পাতা-টি এক করে কুয়োর কালো আলোর সামনে ধরল। সে তখন যেন এক প্রাচীন পুরোহিত।
পাতাটি আর দণ্ডের ভাঙা টুকরোগুলো একসঙ্গে মিলে একটা তীব্র সবুজ রঙের বেষ্টনী তৈরি করল। এই সবুজ আলো (জীবনের প্রতীক) আর কালো আলো (মৃত্যু-ছায়া)—দুটি বিপরীত শক্তি মুখোমুখি হলো।
অরূপ তার শেষ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল, "ওঁ বন্ধন! ওঁ বন্ধন! ওঁ বন্ধন!"
সবুজ বেষ্টনীটি নরোত্তমের হাতে থাকা সম্পূর্ণ জাদুদণ্ডটিকে লক্ষ্য করে ধাবিত হলো। দণ্ডটি প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে গেল। এবার দণ্ডটি কেবল তিনটি টুকরোয় নয়, বরং অসংখ্য ছোট ছোট কণায় বিভক্ত হয়ে গেল। দণ্ডের টুকরোগুলো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
নরোত্তম স্তম্ভিত হয়ে গেল। "না! আমার জ্ঞান! আমার ক্ষমতা!"
মৃত্যু-ছায়া সত্তাটি যেন তার শক্তি হারিয়ে ফেলল। কালো আলো স্তম্ভটি নিভে গেল। কিন্তু পুরোপুরি বিলীন হওয়ার আগে, মৃত্যু-ছায়া নরোত্তমকে গ্রাস করে নিল। নরোত্তমের শরীর কুয়োর কালো জলে বিলীন হয়ে গেল।
অরূপ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সব শেষ।
অন্ধকূপের ঘটনা সরকারী রিপোর্টেও স্থান পেল না। অমল রায় তাদের গোপন সংস্থা থেকে সবকিছু মিটিয়ে দিলেন। তিনি অরূপকে বললেন, "আপনার গল্প কেউ বিশ্বাস করবে না। নীরবতাই আপনাদের ঢাল। আমরা এই গ্রহের সমস্ত অতিপ্রাকৃত ঘটনাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখি। আপনি এখন তাদেরই একজন।"
অমল রায় চলে গেলেন, কিন্তু যাওয়ার আগে অরূপকে একটি পুরনো জাঙ্গাল পুঁথি উপহার দিলেন। পুঁথিটিতে লেখা ছিল: আলোর স্তম্ভ কেবল প্রবেশদ্বার ছিল না, এটা ছিল এক সতর্কবাণী। দরজা একবার বন্ধ হলে, তার চাবি যেন আর কোনোদিন জোড়া না লাগে।
ধ্রুব ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগল, কিন্তু তার চোখের সেই উদাসীনতা যায়নি। সে আর কখনো ক্যামেরার দিকে তাকায় না। তার চোখে এখন কেবল জীবনের মূল্য।
অরূপ তার চাকরিতে ফিরে আসেনি। সে এখন নগেন সাধু এবং আনোয়ারের সাথে সুন্দরবনের লোককথা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। সে এখন আর যুক্তিবাদী অফিসার নয়, সে রহস্যলোকের প্রহরী। সে জানে, জাদুকর ভবানীর প্রতিশোধের নেশা, মিতালী বসুর বৈজ্ঞানিক কৌতূহল এবং নরোত্তমের ক্ষমতার লোভ—এই সব কিছুই এক ভয়ঙ্কর সত্যের দিকে ইশারা করে: সুন্দরবনের গভীরে চিরকাল লুকিয়ে আছে এক রহস্যলোক, যার দরজা যেকোনো সময় আবার খুলে যেতে পারে।
আজও, অরূপের বাড়িতে, ভবানীর জাদুদণ্ডের দুটি ভাঙা টুকরো যত্ন করে রাখা আছে। আর মাঝে মাঝে, রাতের নীরবতায়, অরূপ শুনতে পায়, কুয়োর কালো জলের নিচ থেকে ভেসে আসছে এক গভীর, অস্পষ্ট গুঞ্জন—যেন মৃত্যু-ছায়া আবার মুক্তির প্রহর গুনছে।
এই গল্প শেষ হয় না, এটি কেবল একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি, এবং রহস্যলোকের প্রবেশদ্বার চিরকাল খোলা থাকার সতর্কবাণী।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion