Episode 1666 words0 views

প্রথম অধ্যায়: শূন্যতা

অনন্যা বোস শেষ সতেরো দিন ধরে ঠিকমতো ঘুমায়নি। না, ঠিক তা নয়। সে হয়তো ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু সেই ঘুম ছিল জাগরণের থেকেও বেশি ক্লান্তিকর। একটা আঠালো, ধূসর কুয়াশার মতো স্তর তার চেতনাকে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছিল যে, জেগে উঠেও সে পৃথিবীর রঙ, রূপ, গন্ধ কিছুই ঠিকমতো পাচ্ছিল না। এই সতেরো দিনে তার চারপাশের পৃথিবীটা কেমন যেন অস্পষ্ট, অনুজ্জ্বল হয়ে গেছে। শব্দেরা তার কানে পৌঁছানোর আগেই বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে কফিতে চিনি মেশাতে গিয়ে লবণ মিশিয়ে ফেলছে, ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড তিনবার ভুল টাইপ করছে, মাঝরাতে হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে উঠে ফোনটা দেখছে—এই বুঝি রিংটোন বেজে উঠল। এই বুঝি রিয়ার সেই খিলখিল হাসির গলাটা বলে উঠল, "সরি यार, ফোনটা সাইলেন্ট ছিল!" রিয়া সেন নিখোঁজ। খবরের কাগজের ভাষায় "নিখোঁজ"। কী নির্লিপ্ত, কী ঠুনকো, কী অপমানজনক একটা শব্দ! অনন্যার কাছে শব্দটা যথেষ্ট নয়। রিয়া তার জীবনের একটা অংশ, তার কলেজ জীবনের প্রতিচ্ছবি, তার সবথেকে কাছের বন্ধু। রিয়া, যে মেয়েটা পূর্ণিমার রাতে গঙ্গার ঘাটে বসে খালি গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারত, আবার পরক্ষণেই বাইক নিয়ে ঝড়ের বেগে নিউ টাউনের ফাঁকা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। রিয়া, যে বলত, "জীবনটা খুব ছোট, অনু। এর প্রতিটা সেকেন্ড নিংড়ে খেতে হবে।" সে "নিখোঁজ" হতে পারে না। রিয়া মানেই জীবন, রিয়া মানেই অট্টহাসি, রিয়া মানেই বেপরোয়া পরিকল্পনা। কিন্তু গত সতেরো দিন ধরে রিয়ার ফোন সুইচড অফ। তার মেসেঞ্জারের লাস্ট সিন সতেরো দিন আগেকার। হোয়াটস্যাপের প্রোফাইল পিকচারটা এখনও হাসছে। কলকাতার এক বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক, 'দ্য মেট্রো ক্রনিকল'-এর জুনিয়র রিপোর্টার অনন্যা। সে গত দু'সপ্তাহে তার সমস্ত সাংবাদিক সত্তা দিয়ে রিয়াকে খুঁজেছে। লেক গার্ডেনসের ভাড়াবাড়িটা, যেটা রিয়া আর সে মিলে সাজিয়েছিল, সেটা এখন পুলিশের সিল করা। সাউথ সিটি মলের সিসিটিভি ফুটেজ, যেখানে রিয়াকে শেষবার দেখা গেছে—একটা হলুদ টপ আর ডেনিম জ্যাকেট পরে একাই ঢুকছে। তারপর আর বেরোয়নি। না, অন্তত সিসিটিভি ফুটেজে তাকে আর বেরোতে দেখা যায়নি। পার্ক স্ট্রিট থানার ইন্সপেক্টর চ্যাটার্জি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন, "দেখুন ম্যাডাম, আপনার বন্ধু প্রাপ্তবয়স্ক। একুশ বছর বয়স। মডেলিং করতেন। এরকম মেয়েরা... আপনি তো বোঝেন। প্রায়ই 'বড় ব্রেক'-এর আশায় বা প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। আমাদের রোজকার কাজ এটা। দু'সপ্তাহ কিছুই না। ফিরে আসবে।" অনন্যা টেবিলে ঘুষি মারতে চেয়েছিল। "রিয়া সেরকম মেয়ে নয়। ওর স্বপ্ন ছিল বড়, কিন্তু তার পা মাটিতে ছিল। ও পালালে আমাকে না জানিয়ে পালাবে না!" "সবাই তাই বলে, ম্যাডাম," চ্যাটার্জি উদাসভাবে ফাইলে সই করতে করতে বলেছিলেন। "চিন্তা করবেন না। আমরা দেখছি।" অনন্যা বুঝেছিল, এই "দেখছি" মানে ফাইলটা লাল ফিতের নিচে চাপা পড়া। আজ সকালে এডিটোরিয়াল মিটিং-এ অনন্যা বসের ধমক খেয়েছে। তার নতুন অ্যাসাইনমেন্ট ছিল শহরের দুর্গাপুজোর থিম নিয়ে একটা এক্সক্লুসিভ স্টোরি। সে কিছুই লেখেনি। মন লাগছে না। তার এডিটর, রঞ্জন বাবু, তাকে নিজের কাঁচের কেবিনে ডেকে পাঠালেন। "অনন্যা, আমি জানি তোমার বন্ধুর জন্য তুমি আপসেট। তোমার পার্সোনাল লিভ দরকার হলে নিতে পারো," রঞ্জন বাবু তার চশমা মুছতে মুছতে বললেন। "কিন্তু প্রফেশনালিজম..." "আমার লিভ লাগবে না, স্যার। আমি ঠিক আছি।" "তুমি ঠিক নেই," রঞ্জন বাবু সরাসরি বললেন। "তোমার কপিগুলোয় মন নেই। তুমি তোমার ফোনটা প্রতি দু'মিনিট অন্তর দেখছ। শোনো, তোমাকে একটা বড় অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছি। এটা তোমার মুডও ভালো করবে, আর আমাদের কাগজের জন্যও একটা বিরাট এক্সক্লুসিভ। তুমি ডক্টর অরিন্দম রায়ের নাম শুনেছো?" অনন্যা মাথা নাড়ল। নামটা অস্পষ্টভাবে চেনা। আর্ট পেজে দু-একবার দেখে থাকতে পারে। "বিখ্যাত ভাস্কর। কিন্তু লোকে বলে রিইক্লুসিভ জিনিয়াস। প্রায় পাগল। লোকজনের সাথে মেশেন না। বালিগঞ্জে তাঁর প্রকাণ্ড বাড়িটাই স্টুডিও। পনেরো বছর পর তিনি প্রথমবার মিডিয়াকে ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছেন। আর অদ্ভুতভাবে, তিনি বিশেষ করে তোমাকেই চেয়েছেন। আমাদের চিফ রিপোর্টারকে নয়, তোমাকে।" অনন্যা অবাক হলো। "আমাকে? আমি তো মূলত লাইফস্টাইল আর কালচারাল ইভেন্ট কভার করি।" "এটাই তো অদ্ভুত," রঞ্জন বাবু একটা ফাইল অনন্যার দিকে এগিয়ে দিলেন। "উনি নাকি তোমার লেখা ফলো করেন। বিশেষ করে তোমার ওই 'গঙ্গার ঘাটে সূর্যাস্ত' লেখাটা ওঁর খুব পছন্দ। উনি দেখতে চান, যে মেয়ে গঙ্গার ঘাটে বসে কাব্যি করতে পারে, সে ওঁর শিল্প বুঝতে পারে কি না।" অনন্যা ফাইলটা হাতে নিল। "কবে যেতে হবে?" "আজ বিকেল চারটে। আমাদের চিফ ফটোগ্রাফার শুভময়, মানে শুভ, তোমার সাথে যাবে। শুভকে আমি আলাদা করে বলে দিয়েছি, খুব সাবধানে কাজ করতে। লোকটা খামখেয়ালি। এটা ভালো করে কোরো, অনন্যা। এটা তোমার কভার স্টোরি হতে পারে। আর... মনটাও অন্যদিকে ঘুরবে।" অনন্যা ফাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। ডক্টর অরিন্দম রায়। নামটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। রিয়ার চিন্তাটা এক মুহূর্তের জন্য হলেও সরে গিয়ে একটা নতুন কৌতূহল জায়গা নিল।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion