Episode 2636 words0 views

দ্বিতীয় অধ্যায়: শিল্পীর ঘর

বিকেল চারটে। বালিগঞ্জের এক পুরনো, অভিজাত পাড়া। গাড়িগুলোও এখানে যেন একটু আস্তে চলে। মস্ত বড়, প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু একটা লোহার গেটের ওপারে একটা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের বাড়ি। মনে হয়, কোনো ইংরেজ ব্যারন হয়তো শখ করে বানিয়েছিলেন। বাড়ির দেওয়াল জুড়ে প্রাচীন আইভি লতা এমনভাবে জড়িয়ে আছে, মনে হয় ওটাই বাড়িটাকে ধরে রেখেছে। বাইরে থেকে বাড়িটাকে নিঃশব্দ, ঘুমন্ত মনে হয়। শুভ, অনন্যার সহকর্মী ফটোগ্রাফার, ক্যামেরা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল, "বাপরে! এ তো ভূতের বাড়ি মনে হচ্ছে। 'দ্য অ্যাডামস ফ্যামিলি'র সেট। এই লোকটা এখানে বসে বসে মূর্তি বানায়?" অনন্যা কলিং বেল বাজাল। কোনো শব্দ হলো না। সে আবার বাজাল। অনেকক্ষণ পর একটা ধাতব কিচকিচ শব্দ করে গেটটা খুলে গেল। ভেতরে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে। নিখুঁত সাদা শাড়ি, চুল পরিপাটি করে খোঁপা করা। তার মুখটা অদ্ভুতভাবে অভিব্যক্তিহীন, যেন মোমের তৈরি। "আপনারা 'মেট্রো ক্রনিকল' থেকে? আমার নাম মিসেস গোমেস। আমি ডক্টর রায়ের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। স্যার আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। দয়া করে ভেতরে আসুন।" তার গলার স্বরও তার চেহারার মতোই শীতল, একঘেয়ে। তারা মিসেস গোমেসের পেছন পেছন ভেতরে ঢুকল। বাড়ির ভেতরটা ঠান্ডা। বাইরে কলকাতার ভ্যাপসা গরম, কিন্তু এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত না হওয়া সত্ত্বেও একটা হিমশীতল ভাব। লম্বা করিডোর। দামি সেগুন কাঠের মেঝেতে তাদের জুতোর শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। দেওয়ালে কোনো ছবি নেই, কোনো আসবাব নেই, শুধু আলো-আঁধারির খেলা। তাদের একটা বিশাল ঘরে নিয়ে আসা হলো। ডবল হাইট সিলিং। এটাই স্টুডিও। অনন্যা আর শুভ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ঘরটা অদ্ভুত। একদিকে মাটি, প্লাস্টার, ছেনি-বাটুলির ছড়াছড়ি। ফ্লোরে মাটির তাল লেপ্টে আছে। অন্যদিকে, ঘরের মাঝখানে, সারি সারি সাদা চাদরে ঢাকা অতিকায় সব মূর্তি। যেন কোনো কবরখানায় আত্মারা চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর দেওয়াল ঘেঁষে, ফ্লোর থেকে সিলিং পর্যন্ত কাঁচের শোকেসে রাখা শুধু মুখ। অগণিত মানুষের মুখ। কোনোটা মাটির, কোনোটা প্লাস্টারের, কোনোটা ব্রোঞ্জের। কোনোটা হাসছে, কোনোটা কাঁদছে, কোনোটা যন্ত্রণায় বিকৃত, কোনোটা আবার অদ্ভুত এক অপার্থিব শান্তিতে মগ্ন। মনে হচ্ছিল, হাজার হাজার চোখ যেন তাদের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। "অসাধারণ! এ তো মিউজিয়াম!" শুভ ক্যামেরা অন করতে করতে ফিসফিস করল। "শিল্পকে উপভোগ করার জন্য চোখ আর মন দুটোই লাগে, মিস্টার ফটোগ্রাফার। শুধু ক্যামেরা নয়।" একটা গম্ভীর, শান্ত, প্রায় সম্মোহনী গলা শুনে দুজনেই চমকে উঠল। ঘরের এক অন্ধকার কোণ থেকে একজন লম্বা, ফর্সা লোক বেরিয়ে এলেন। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, কিন্তু তার চেহারা বা চলায় বয়সের কোনো ছাপ নেই। অসম্ভব সুন্দর একটা মুখ, যেন গ্রিক ভাস্কর্য। পরনে একটা দামি সিল্কের কুর্তা, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। চুল সামান্য কাঁচাপাকা, কিন্তু পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ইনিই ডক্টর অরিন্দম রায়। তার মুখে একটা অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি। "আসুন। অনন্যা বোস। আমি আপনার লেখা পড়েছি। 'গঙ্গার ঘাটে সূর্যাস্ত'— খুব কাব্যিক। কিন্তু আপনি যা দেখেন, তার থেকেও বেশি কিছু কি দেখতে পান না? আপনি কি শুধু ওপরের ঢেউটা দেখেন, নাকি নিচের অন্ধকার স্রোতটাও আপনাকে টানে?" অনন্যা বুঝতে পারল না, এটা প্রশংসা না ব্যঙ্গ। "আমি... আমি চেষ্টা করি, স্যার।" "করতে হবে," অরিন্দম রায় একটা অর্ধসমাপ্ত মাটির মূর্তির পাশে এসে দাঁড়ালেন। "শিল্পীর কাজ হলো চামড়ার নিচের সত্যিকে খুঁজে বের করা। আমার বাবা, অমল রায়, তিনি পাথর খোদাই করে সত্য খুঁজতেন। আমি খুঁজি মানুষের মাংসে, চামড়ায়। আমার ক্যানভাসটা একটু আলাদা।" তিনি একটা সাদা চাদর সরালেন। একটা ব্রোঞ্জের মূর্তি। এক বৃদ্ধ ভিখারির। তার প্রতিটা বলিরেখা, তার শীর্ণ হাত, তার কোটরের গভীরে বসা চোখ—সবকিছু জীবন্ত। মনে হচ্ছে, এখুনি সে হাত পেতে চাইবে। "এর নাম জীবন," অরিন্দম রায় বললেন। "কদর্য, কিন্তু সত্যি।" শুভ ছবি তুলতে শুরু করল। অনন্যা তার রেকর্ডার অন করল। "ডক্টর রায়, পনেরো বছর আপনি লোকচক্ষুর আড়ালে। কেন?" "কারণ লোকচক্ষু সত্যিকে দেখতে পায় না, অনন্যা। তারা শুধু ওপরের আবরণটা দেখে," অরিন্দম রায় শান্তভাবে উত্তর দিলেন। "তারা সুন্দর মুখ খোঁজে, আমি খুঁজি নিখুঁত মুখ। দুটোর মধ্যে তফাৎ আছে। আমার বাবা বলতেন, আমার কাজে খুঁত বেশি। আমি সেই খুঁতগুলোকেই ঠিক করার চেষ্টা করি। আমি নিখুঁত সৃষ্টিতে বিশ্বাসী। আর নিখুঁত জিনিস তৈরি করতে সময় লাগে। বাইরের কোলাহল, মিডিয়ার আলো—এগুলো আমার কাজে বাধা দেয়।" "কিন্তু আজ পনেরো বছর পর হঠাৎ রাজি হলেন কেন?" অরিন্দM রায় হাসলেন। তিনি সরাসরি অনন্যার চোখের দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি এতই তীব্র যে অনন্যার অস্বস্তি হতে লাগল। "কারণ, আমার 'মাস্টারপিস' প্রায় তৈরি। আর আমি চাই, পৃথিবী সেটা দেখুক। আপনার চোখ দিয়ে।"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion