অন্ধকার রাত। ১৭৬৩ সাল। পাটনার দুর্গ তখনও মীর কাসিমের শেষ আশা বহন করছে, যদিও বক্সারের যুদ্ধ আসন্ন এবং পরাজয়ের পদধ্বনি সুদূর নয়। বাইরে শিয়াল আর কুকুরের মিশ্র ডাক, আর ভেতরে নবাবের হৃদয়ের তীব্র যন্ত্রণা। তিনি তার নিজস্ব গ্রন্থাগারের গোপন কক্ষে বসে ছিলেন। তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিল পারস্যের মূল্যবান নকশা, জীর্ণ সামরিক মানচিত্র এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে আদান-প্রদান করা চুক্তির ছেঁড়া নথি। প্রতিটি নথিতে যেন বিশ্বাসঘাতকতার কালি লেগে আছে।
নবাব মীর কাসিমের চোখে ছিল গভীর ক্লান্তি, কিন্তু হৃদয়ে ছিল ইস্পাত কঠিন সংকল্প। তিনি জানতেন, তাঁর সময় শেষ। তিনি তরবারি দিয়ে লড়ছিলেন, কিন্তু তাঁর শত্রুরা জিতছিল কলম এবং শুল্কের কাগজ দিয়ে। বিশ্বাস যখন নড়ে যায়, তখন শত্রুকে পরাজিত করা যায় না। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার পর তাঁর রাজত্বে একে একে বেরিয়ে এসেছিল তাঁর বিশ্বস্ত বলে পরিচিত তিন প্রভাবশালী দেশীয় জমিদার, যারা গোপনে ইংরেজদের হাতে বাংলার অর্থনীতির চাবি তুলে দিচ্ছিল। তাদের লোভ ছিল কেবল জমিদারি নয়, শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের চূড়ান্ত ক্ষমতা। এদের মধ্যে একজন ছিলেন মানসিংহ রায়, যার বংশধররাই রণজিৎ চৌধুরী।
"মীর মনসুর," নবাব ফিসফিস করে ডাকলেন। তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক করুণ আর্তি।
তাঁর প্রধান লিপিকর, আল-কুতুব বংশের শেষ প্রদীপ, মীর মনসুর মাথা নিচু করে কক্ষে প্রবেশ করলেন। মনসুরের চোখ ছিল ক্যালিগ্রাফির সূক্ষ্ম শিল্পে নিবেদিত, কিন্তু এখন তার হাতে ছিল বিশ্বাসঘাতকতার দলিল সংরক্ষণের গুরুদায়িত্ব। মনসুর দেখলেন, নবাবের হাতে একটি রুপোর কৌটা, যা তিনি গত ছয় মাস ধরে গোপনে তৈরি করেছেন। এর প্রতিটি খাঁজে ছিল ফার্সি ক্যালিগ্রাফি আর জটিল জ্যামিতিক নকশা, যা কেবল আল-কুতুব বংশের হাতেই তৈরি হতে পারে। এই কৌটার ধাতু এমনভাবে সংমিশ্রিত, যা কেবল মানব দেহের তাপমাত্রায় সক্রিয় হয়, আর নির্দিষ্ট শব্দ তরঙ্গকে এনক্রিপ্ট করতে পারে।
"মনসুর, আমি জানি, আগামীকাল কী হবে," নবাব শান্তভাবে বললেন। "তারা আমার সোনা চায়। আমার ভূমি চায়। কিন্তু আমি তাদের দেব সেই বিষ, যা আড়াইশো বছর ধরে তাদের ভিতরের অহংকারকে ক্ষয় করবে।"
মীর কাসিম তার হাতির দাঁতের কলমটি নিলেন, যার ভেতরে একটি বিশেষ শুষ্ক কালি জমা করা ছিল। এই কালি, আল-কুতুব বংশের প্রাচীন রাসায়নিক বিদ্যা অনুযায়ী তৈরি, যা শুধু একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এবং বিশেষ তরলে মিশে পুনরুজ্জীবিত হতে পারত। এটি ছিল সত্যকে কালের গ্রাস থেকে রক্ষা করার শেষ প্রচেষ্টা।
"তুমি আমার জন্য তিনটি কাজ করবে, মনসুর। প্রথমত, এই বিশ্বাসঘাতকতার দলিলগুলো এমনভাবে এনক্রিপ্ট করো, যা কেবল ইতিহাসের সত্যকেই বহন করবে, লোভীদের সোনাকে নয়। দ্বিতীয়ত, আমার 'রৌপ্য-ভিত্তিক স্থিতিশীলতা'-এর অর্থনৈতিক ফর্মুলাটি সুরক্ষিত করো। এটিই বাংলার আসল ধন। আর তৃতীয়ত, এই বার্তাটি আমার পুত্র মোবারকের কাছে পৌঁছে দেবে। সে যেন ভুলে না যায়—'পরাজয়ের কারণ তরবারি নয়, কলম'। এই চিঠিই হবে সেই কলম।"
নবাবের কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভূত দৃঢ়তা। তিনি চিঠিটি লিখলেন। এরপর মীর মনসুর সেই চিঠিটিকে একটি বিশেষ মসলিনের ব্যাগে মুড়ে দিয়েছিলেন, যা সময়কে প্রতিহত করতে পারত।
"আমানতকে তিন ভাগে ভাগ করো, মনসুর। এক ভাগ মুর্শিদাবাদে, গুপ্ত কক্ষের প্রথম সঙ্কেতে। দ্বিতীয় ভাগ মুঙ্গেরে, যেখানে আমার শেষ অনুগতরা তাদের জীবন দেবে। আর তৃতীয় ভাগ আমার পুত্রের জন্য, যার শেষ ঠিকানা জাহাঙ্গীরনগরে (ঢাকা)। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাব যেখানে সবচেয়ে দুর্বল, সেখানেই আমার শেষ চাল কার্যকরী হবে।"
মীর মনসুর নবাবের আদেশ পালন করেছিলেন। তিনি আল-কুতুব বংশের শেষ শক্তি দিয়ে একটি রুপোর কৌটা তৈরি করলেন—যা একই সঙ্গে একটি এনক্রিপশন চাবি, একটি তাপমাত্রা সংবেদক এবং একটি চূড়ান্ত ট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করবে। এটিই ছিল সেই 'রক্তের পথ'। মনসুর সতর্কতার সাথে কৌটার ভেতরে একটি সূক্ষ্ম স্ক্রোল ভরে দিলেন, যেখানে লেখা ছিল: "যেই হাতে রক্ত লেগে আছে, সেই হাত যদি তোমার দিকেও বন্ধুত্বের জন্য বাড়ানো হয়, তবে তাকে বিশ্বাস করো না।"
চিঠিটি শেষ করে নবাব মীর কাসিম তার গ্রন্থাগারের পেছনের সিন্দুকটিতে কৌটা এবং চর্মপত্রের সঙ্কেত লুকিয়ে রাখলেন। তিনি জানতেন না, সেই চিঠি আড়াইশো বছর পর কলকাতা শহরের এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় এক গবেষকের হাতে পড়বে, যার নাম অনির্বাণ রায়। কিন্তু নবাব নিশ্চিত ছিলেন—সত্য একদিন আলোর মুখ দেখবেই। এই ছিল মীর কাসিমের শেষ চাল, সময়ের বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ বিদ্রোহ।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion