কলকাতা শহরের আকাশ ভেঙে সেদিন বৃষ্টি নামছিল। গঙ্গা পেরোনো বাতাস আর্দ্রতা আর পুরোনো ইটের গন্ধ নিয়ে ভেসে আসছিল ভবানীপুরের এক জীর্ণ নিলাম ঘরের ভেতরে। ইতিহাস গবেষক ড. অনির্বাণ রায়, যিনি জীবনের তিরিশটি বছর শুধু পান্ডুলিপি আর অপ্রকাশিত দলিলের ধুলোতেই কাটিয়েছেন, তাঁর চোখে ছিল কেবল একটি জিনিসের দিকে—একটি বিশাল, মরিচা-ধরা লোহার সিন্দুক। সিন্দুকটি ছিল এমনভাবে তৈরি যেন এটি মাটির গভীরে থাকার জন্য বিশেষভাবে বানানো। এর গায়ে খোদাই করা অস্পষ্ট ফার্সি শীলমোহর, যা মীর কাসিমের শাসনকালের শেষ দিকের বলে অনুমান করা হচ্ছিল, অনির্বাণকে এই সিন্দুক কেনার জন্য অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত করেছিল।
নিলামের হাতুড়ি শেষবারের মতো যখন সশব্দে নামল, সিন্দুকটি তখন অনির্বাণের।
পরের তিনটি দিন অনির্বাণ তার গবেষণা কক্ষের তালাবন্ধ দরজার ভেতরে কাটালেন। সিন্দুকটি বাইরে থেকে যতটাই মজবুত আর সাদামাটা লাগুক না কেন, তার ভেতরের কাঠামোর কারিগরি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ যেন একই সঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তালাশিল্পের এক জটিল মিশ্রণ। অবশেষে, একটি সূক্ষ্ম স্প্রিং চালিত কব্জা এবং একটি বিশেষ ক্রমে চাপানো দুটি শিলালিপির মাধ্যমে তিনি সিন্দুকের গোপন প্রকোষ্ঠটি খুঁজে পেলেন।
ভেতরে ছিল দুটি জিনিস। প্রথমটি, একটি ছোট, মরচে-ধরা হাতির দাঁতের কলম, যার ভেতরে কালি শুকিয়ে গেলেও তার নিবের সূক্ষ্মতা বলে দিচ্ছিল—এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো দলিল লেখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। দ্বিতীয়টি, একটি হলুদাভ, ভঙুর মসলিনের ব্যাগে মোড়ানো দীর্ঘ চিঠি।
চিঠির ভাষা ছিল ফার্সি এবং হাতে লেখা। অনির্বাণ কাঁপতে কাঁপতে অনুবাদ শুরু করলেন। এটি ছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীর কাসিম-এর হাতের লেখা, সম্ভবত পাটনা থেকে মুঙ্গেরে পালানোর ঠিক আগে লেখা, তাঁর একমাত্র পুত্র মোবারক-উদ-দৌলা-কে উদ্দেশ্য করে।
চিঠির প্রথম অংশ ছিল পিতৃত্বের উপদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় অংশে ছিল এক তীব্র আকুতি এবং সাংকেতিক ভাষা।
"...আমি জেনেছি, পরাজয়ের কারণ তরবারি নয়, কলম। যে চুক্তি আমি ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, তারা তা আবার জুড়ে দেবে। আমার সোনা, রত্ন নয়, মোবারক। আমার আমানত হলো সত্য—সেই সত্য যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔদ্ধত্যের মূলে আঘাত করবে। এর পথ দেখাবে আল-কুতুবের রক্ত, মুর্শিদাবাদের নহবতখানার শেষ সিঁড়িতে তার প্রথম সঙ্কেত..."
অনির্বাণ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ তো কেবল উইল নয়, ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের 'শেষ চাল'-এর গোপন সঙ্কেত। তিনি জানতেন, নবাব মীর কাসিমের ধনভাণ্ডার নিয়ে ইতিহাসে অনেক জল্পনা আছে, কিন্তু এটি যে সোনা-রত্ন নয়, বরং কোনো ঐতিহাসিক দলিল বা তথ্য, তা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। খুব শান্ত অথচ তীব্র সেই আঘাত। অনির্বাণ দ্রুত চিঠিটি একটি গোপন ফাইলে ঢুকিয়ে ল্যাম্প নিভিয়ে দিলেন। দরজা খুলতেই দেখলেন, বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক সুবেশা, কিন্তু নির্জীব চোখের তরুণী। তার পোশাক আধুনিক, কিন্তু তার হাবভাবে শতাব্দীর পুরোনো এক শীতল কর্তৃত্বের ছাপ।
"ডক্টর রায়?" মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, তার গলায় কোনো জিজ্ঞাসা ছিল না, ছিল এক শীতল কর্তৃত্ব। "আমি ইরা। আমরা নবাব মীর কাসিমের সিন্দুকের বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।"
অনির্বাণ বুঝতে পারলেন—তাঁর বিপজ্জনক যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। এই চক্রটি জানে, সিন্দুক পাওয়া গেছে, এবং তারা সম্ভবত জানে না যে আসল 'ধনভাণ্ডার' সোনা নয়। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য যাই হোক, তারা নবাবের সত্যকে যেকোনো মূল্যে নিজেদের দখলে নিতে চায়।
ইরাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অনির্বাণ দ্রুত তার ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটি ছোট্ট, রুপোর তৈরি নকশাদার কৌটা বের করে তার গলার স্কার্ফের নিচে লুকিয়ে নিলেন। তিনি জানতেন, এই কৌটার গায়ে খোদাই করা সূক্ষ্ম কারুকার্যই হলো আল-কুতুব বংশের 'রক্তের পথ' নামের সেই জটিল ক্যালিগ্রাফি-সঙ্কেত। এই কৌটাটি তিনি বহু বছর আগে আল-কুতুব বংশের শেষ দিকের এক জীর্ণ সংগ্রহশালার নিলাম থেকে জোগাড় করেছিলেন, যার গুরুত্ব তখন তিনি বুঝতে পারেননি।
"কোন সিন্দুক?" অনির্বাণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেন। "আমি একজন ইতিহাস গবেষক। প্রতিদিন আমি শত শত পুরোনো জিনিস কিনি।"
ইরা সামান্য হাসল। সেই হাসি অনির্বাণের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নামিয়ে দিল। "ডক্টর রায়, আপনি ইতিহাসের মানুষ। কিন্তু ইতিহাস এখন বদলে দেওয়ার সময় এসেছে। আপনার কাছে যা আছে, তা আমাদের 'বস'-এর নতুন বিশ্বব্যবস্থা-র প্রথম বীজ। আমাদের ওটা প্রয়োজন। আর দেরি করলে..."
দরজার বাইরে থেকে একটা গাড়ির ইঞ্জিনের হালকা গর্জন শোনা গেল। অনির্বাণ এক সেকেন্ডও নষ্ট করলেন না। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন—বৃষ্টিতে ভিজে থাকা সরু গলি। তিনি দেখলেন, গলির মুখে দুটি বিশালদেহী লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের একজনের পকেটে একটি তারের হেডসেট জ্বলজ্বল করছে। তাদের একজন—জামাইল—শক্তিশালী ও শীতল দৃষ্টির অধিকারী।
"আমি জানি না আপনি কী বলছেন," বলে অনির্বাণ দ্রুত পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তার হাতে এখন কেবল নবাবের শেষ চিঠি আর আল-কুতুবের গোপন কৌটা। নবাবের প্রথম সঙ্কেত মনে পড়ল—মুর্শিদাবাদের নহবতখানার শেষ সিঁড়ি...।
তাঁর মনে হলো, তিনি যেন আর অনির্বাণ রায় নন—তিনি সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া এক বার্তাবাহক, যার কাঁধে আড়াইশো বছরের পুরোনো এক বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion