This entry is part 1 of 11 in the series নেতাজির সংকেতপাহাড়ের ডাক
ইতিহাসের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। অনীশ সেনগুপ্ত মনেপ্রাণে এটা বিশ্বাস করত। পুরনো বইয়ের পাতা থেকে ওঠা ধুলোর গন্ধ, তামার মুদ্রার ওপর জমে থাকা বহু বছরের সবুজাভ আস্তরণের গন্ধ, কিংবা পুরনো চিঠির কালির ভেতর লুকিয়ে থাকা স্মৃতির গন্ধ—এইসব কিছুই অনীশকে নেশার মতো টানত। তার কাছে ইতিহাস শুধু সাল-তারিখের নীরস তালিকা ছিল না, ছিল জীবন্ত মানুষের না বলা কথা, চাপা দীর্ঘশ্বাস আর হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের কোলাজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর থেকে ব্রিটিশ লাইব্রেরির আর্কাইভ পর্যন্ত তার অবাধ বিচরণ ছিল শুধু এই গন্ধের টানেই।
তবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান রহস্যের প্রতি তার এই তীব্র আগ্রহের পেছনে ছিল এক ব্যক্তিগত কারণ। তার দাদু, অম্বুজ সেনগুপ্ত, আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন সাধারণ সৈনিক ছিলেন। যুদ্ধের পর সহযোদ্ধারা ফিরে এলেও তিনি ফেরেননি। পরিবারের কাছে তার অন্তর্ধান ছিল এক না শুকানো ক্ষত। ছোটবেলায় বাবার কাছে শোনা দাদুর বীরত্বের গল্প আর তার শেষ লেখা একটা অসম্পূর্ণ চিঠি—এটুকুই ছিল অনীশের সম্বল। সে বিশ্বাস করত, নেতাজির শেষ দিনগুলোর রহস্যের সাথেই জড়িয়ে আছে তার নিজের দাদুর হারিয়ে যাওয়ার উত্তর। তাই স্যার এডওয়ার্ড গ্রিফিনের ডায়েরির খোঁজটা তার কাছে শুধু একটি অ্যাকাডেমিক গবেষণা ছিল না, ছিল নিজের শিকড় খুঁজে বের করার এক ব্যক্তিগত প্রতিজ্ঞা।
দার্জিলিং-এর এই ডাকটা এসেছিল হঠাৎ করেই। এক বর্ষার দুপুরে, যখন সে নেতাজির ফাইল ঘাঁটছিল, তখন একটি ফুটনোট তার চোখ আটকে দেয়। স্যার এডওয়ার্ড গ্রিফিন, দার্জিলিং-এর এক প্রাক্তন ব্রিটিশ কমিশনার, তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে উল্লেখ করেছিলেন—’The Eagle has information that could burn the Empire.’ অর্থাৎ, ‘ঈগলের কাছে এমন তথ্য আছে যা সাম্রাজ্যকে পুড়িয়ে দিতে পারে।’ ঈগল বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু অনীশের মন বলছিল, এই ঈগল কোনো ব্যক্তি নয়, সম্ভবত কোনো স্থানের নাম।
কয়েক সপ্তাহের অক্লান্ত গবেষণার পর সে খুঁজে পেয়েছিল—দার্জিলিং থেকে কিছুটা দূরে, লেবং কার্ট রোডের ধারে অবস্থিত একটি পুরনো ব্রিটিশ এস্টেটের নাম ছিল ‘ঈগলস নেস্ট’। স্যার এডওয়ার্ড গ্রিফিনের শেষ জীবনটা এখানেই কেটেছিল। লোকমুখে শোনা যায়, তার মৃত্যুর পর তার ব্যক্তিগত ডায়েরি বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ নথি খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেন পাহাড়ের কুয়াশা এসে সবকিছু গ্রাস করে নিয়েছিল।
অনীশের ভেতরটা উত্তেজনায় কাঁপছিল। যদি সেই ডায়েরি খুঁজে পাওয়া যায়? যদি তাতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এমন কোনো অধ্যায়ের কথা লেখা থাকে, যা ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে গিয়েছিল? এই ভাবনাটাই তাকে কলকাতা থেকে শিয়ালদহগামী দার্জিলিং মেলের টিকিট কাটতে বাধ্য করেছিল।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যখন ট্রেনটা থামল, ভোরের আলো সবে ফুটছে। বাতাসটা ভেজা, শীতল। পাহাড়ের সেই পরিচিত গন্ধ, যা সমতলের মানুষ প্রথমবার পেলে শিউরে ওঠে, অনীশের নাকে এসে লাগল। একটা পুরনো ল্যান্ড রোভার ভাড়া করে সে যখন আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল, মেঘেরা তখন তাকে স্বাগত জানাতে রাস্তার ওপর নেমে এসেছিল। পাইন গাছের সারি মেঘের চাদর ফুঁড়ে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল। অনীশের মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো রহস্যময় জগতে প্রবেশ করছে, যেখানে প্রতিটি বাঁক এক নতুন গল্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গাড়ির চালক, শেরিং, একজন বয়স্ক লেপচা। তার মুখে বলিরেখার মানচিত্র, আর চোখে পাহাড়ের গভীরতা। অনীশ কথা বলার জন্য জিজ্ঞেস করল, “ঈগলস নেস্ট এস্টেটটা চেনেন?”
শেরিং-এর মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। স্টিয়ারিং-এ ধরা হাতটা শক্ত হলো। নিচু গলায় বলল, “ওই বাড়িতে কেন যাচ্ছেন বাবু? ওটা ভালো জায়গা নয়। পাহাড় ওখানে শান্তিতে ঘুমায় না।”
“কেন? কী হয়েছে ওখানে?” অনীশের কৌতূহল বাড়ল।
“লোকে বলে, সাহেব মরে যাওয়ার পর থেকে ও বাড়ির শান্তি চলে গেছে। রাতের বেলা কারা যেন কাঁদে। কেউ বলে ওটা বাতাস, আমি বলি ওটা পাহাড়ের কান্না। নিজের বুকে অনেক কষ্ট চেপে রেখেছে তো, তাই কাঁদে।” শেরিং একটু থেমে আবার বলল, “শুধু তাই নয় বাবু। ওই বাড়ির ছাদের কোণে যে গারগয়েলের মূর্তিগুলো আছে, লোকে বলে অমাবস্যার রাতে নাকি ওগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। অনেকেই নাকি ওগুলোকে ছাদের ধারে নড়াচড়া করতে দেখেছে।”
অনীশ হাসল। লোককথা সে অনেক শুনেছে, কিন্তু বিশ্বাস করেনি। তার কাছে ইতিহাস হলো তথ্য আর প্রমাণের খেলা, কান্নার শব্দ বা ভূতের গল্প নয়। কিন্তু শেরিং-এর চোখের ভয়টা তার মনে একটা কাঁটার মতো বিঁধে রইল।
গাড়িটা যখন ‘ঈগলস নেস্ট’-এর বিশাল লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গেটের ওপর মরচে পড়া একটা পেঁচার মূর্তি, তার চোখে যেন বহু বছরের ক্লান্তি। চারপাশটা বুনো ঝোপঝাড়ে ভরা। বোঝা যায়, বহুদিন এদিকে কারও যত্নশীল হাত পড়েনি। অনীশ ভাড়া মিটিয়ে শেরিং-কে বিদায় জানাতেই সে প্রায় পালিয়ে গেল, একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না।
পুরনো পাথরের রাস্তা ধরে অনীশ যখন মূল বাংলোর দিকে এগোচ্ছিল, তখন তার মনে হলো, সময় যেন এখানে থমকে গেছে। বাংলোটা যেন এক বৃদ্ধ অভিজাত, যে তার পুরনো গৌরব আঁocre ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে পুরু শেওলার আস্তরণ, জানালায় বুনো অর্কিডের ঝাড়। অনীশ এবার শেরিং-এর বলা গারগয়েলগুলোর দিকে তাকাল। সত্যিই, বাংলোর গথিক স্থাপত্যের অংশ হিসেবে ছাদের কার্নিশে কয়েকটা পাথরের বীভৎস মূর্তি রয়েছে। তাদের মুখগুলো এমনভাবে তৈরি, যেন তারা অনন্ত যন্ত্রণা বা ক্রোধে চিৎকার করছে। এই মেঘলা বিকেলে মূর্তিগুলোকে অস্বাভাবিক রকম জীবন্ত মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন তারা অনীশের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখছে। চারপাশটা এতটাই শান্ত যে নিজের হৃৎস্পন্দনও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। এই নিস্তব্ধতাই যেন সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিকর। অনীশ তার কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে যে বেরিয়ে এল, তাকে দেখে অনীশ কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion