ঈগলস নেস্ট
মেয়েটির বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না। পরনে একটা সাধারণ খাদি কুর্তি আর জিন্স। চুলগুলো এলোমেলো করে খোঁপা করা। কিন্তু তার চোখে ছিল পাহাড়ের মতোই গভীর আর শান্ত একটা দৃষ্টি, যেখানে মেঘ আর রোদ একসাথে খেলা করে। সেই চোখে আতিথেয়তার লেশমাত্র ছিল না, ছিল একরাশ সংশয় আর বিরক্তি।
“কাকে চাই?” মেয়েটির গলা তার চোখের মতোই শীতল।
অনীশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আমি অনীশ সেনগুপ্ত। কলকাতা থেকে আসছি। এই এস্টেটের মালিক, মানে আপনার দাদু শ্রী অরুণাভ রায়ের সাথে আমার কথা হয়েছিল। উনি আমাকে এখানে কিছুদিন থেকে গবেষণা করার অনুমতি দিয়েছেন।”
মেয়েটি এক মুহূর্ত অনীশকে আপাদমস্তক জরিপ করল। তারপর বলল, “দাদু মাস ছয়েক আগে মারা গেছেন। আমি ইলা, তার নাতনি। দাদু আপনাকে অনুমতি দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে।”
অনীশের বুকটা ধক করে উঠল। এতদূর এসে যদি ফিরে যেতে হয়, তাহলে সব শেষ। সে যতটা সম্ভব নম্রভাবে বলল, “আমি আপনার দাদুর মৃত্যুর খবরটা জানতাম না। আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু আমার কাজটা খুব জরুরি। আমি শুধু পুরনো লাইব্রেরিটা ব্যবহার করতে চাই। আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না।”
ইলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার চোখে একটা দ্বিধার ছাপ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভেতরে আসুন।”
বাংলোর ভেতরটা বাইরে থেকেও বেশি বিষণ্ণ। উঁচু সিলিং, দেওয়ালে পুরনো অয়েল পেন্টিং, ভারি কাঠের আসবাবপত্র—সবকিছুতেই একটা জনশূন্যতার ছাপ। বাতাসে ড্যাম্প আর পুরনো কাগজের মিশ্র গন্ধ। ইলা তাকে একটা বসার ঘরে নিয়ে গেল, যেখানে ফায়ারপ্লেসের ওপর স্যার এডওয়ার্ড গ্রিফিনের একটা বিশাল ছবি টাঙানো। সাহেবের চোখেমুখে এক অদ্ভুত অহংকার আর বুদ্ধির ছাপ।
“দাদু মারা যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন, এই বাড়ির ইতিহাস ঘাঁটতে এলে বিপদ হতে পারে,” ইলা সোফায় বসতে বসতে বলল। তার গলায় কোনো ভয় ছিল না, ছিল এক ধরনের ক্লান্তি। “আপনার আগেও কয়েকজন এসেছিলেন। গুপ্তধনের খোঁজে। তারা বাড়ির অনেক ক্ষতি করে দিয়ে গেছে।”
অনীশ বুঝতে পারল ইলার বিরক্তির কারণ। সে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি গুপ্তধন খুঁজতে আসিনি। আমি একজন ইতিহাস গবেষক। স্যার গ্রিফিনের ডায়েরিটা আমার গবেষণার জন্য খুব দরকারি।”
“ডায়েরিটা এখানে নেই,” ইলা সরাসরি বলল। “থাকলে দাদু নিশ্চয়ই পেতেন। তিনি তার সারাটা জীবন এই বাড়ি আর এর ইতিহাস নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন।”
“হয়তো তিনি খুঁজে পাননি, বা পেয়েও তার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি,” অনীশ জোর দিয়ে বলল। “আমাকে শুধু একটা সুযোগ দিন। আমি কথা দিচ্ছি, কোনো জিনিসপত্র এলোমেলো করব না।”
ইলা তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অনীশের চোখের সততা আর আকুতি হয়তো তার মনকে কিছুটা নরম করল। সে বলল, “ঠিক আছে। দোতলার কোণের ঘরটা আপনার জন্য ঠিক করে দিচ্ছি। আর লাইব্রেরিটা সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু একটা শর্ত, কোনো বই বা কাগজ আমার অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের করতে পারবেন না।”
অনীশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “আমি আপনার সব শর্ত মেনে নেব।”
সেদিন সন্ধ্যায় নিজের ঘরে বসে অনীশ তার পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল। ঘরটা বেশ বড়, একপাশে একটা পড়ার টেবিল আর অন্যপাশে একটা পুরনো খাট। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শুধু পাইন বন আর মেঘের সমুদ্র দেখা যায়। চারপাশটা এতটাই শান্ত যে মনে হয় পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
কিন্তু এই শান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। রাতে খাওয়ার পর অনীশ যখন তার গবেষণার কাগজপত্র গোছাচ্ছিল, তখন হঠাৎ করেই ঘরের বাতিটা নিভে গেল। জেনারেটর চলার কোনো শব্দও নেই। অনীশ মোবাইলের টর্চ জ্বেলে বাইরে বেরিয়ে এল। পুরো বাংলোটা অন্ধকারে ডুবে আছে। সে ইলাকে কয়েকবার ডাকল, কিন্তু কোনো সাড়া পেল না।
অনীশ কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল। অন্ধকারে তার ঘুম আসছিল না। হঠাৎ তার মনে হলো, নিচের তলায় কেউ যেন খুব সাবধানে হাঁটছে। কাঠের মেঝেতে একটা মৃদু ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ। অনীশ কান খাড়া করল। শব্দটা ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। তার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে শুরু করল। সে নিঃশব্দে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দরজার কি-হোল দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না।
কিছুক্ষণ পর শব্দটা মিলিয়ে গেল। অনীশ ভাবল, হয়তো এটা তার মনের ভুল। পুরনো বাড়িতে এমন অনেক শব্দ হয়। সে খাটে ফিরে এসে শুয়ে পড়ল। কিন্তু তার ঘুম আর এল না। এক অজানা আশঙ্কায় তার মনটা ছেয়ে রইল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion