পুনর্জন্ম
সূর্যের প্রথম আলো যখন ‘জ্ঞানদীপ’ লাইব্রেরির বিশাল জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল, তখন অরুণ অনুভব করল এক নতুন দিনের আগমন। লাইব্রেরিটা এখন আর আগের মতো জীর্ণ দেখাচ্ছে না। তার দেয়ালগুলো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, আর বইগুলো থেকে একরকম মৃদু দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বাতাসে বইয়ের পুরোনো গন্ধের সাথে মিশেছে এক নতুন, সতেজ সুবাস, যা মনকে সতেজ করে তুলছিল, যেন লাইব্রেরি নিজেই শ্বাস নিচ্ছে, নতুন জীবন শুরু করছে।
অরুণ উঠে দাঁড়াল। তার শরীর ক্লান্ত, কিন্তু তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি। সে ছায়াদের পুরোপুরি ধ্বংস করেছে, আর তার লাইব্রেরিকে বাঁচিয়েছে। আভা তার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে সোনালী গুঁড়ো ছড়াচ্ছিল, যেন তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, তার ডানা থেকে একরকম মিষ্টি সুর বাজছিল, যা লাইব্রেরির বাতাসে এক জাদুর আভা তৈরি করছিল।
“এখন কী করবে?” আভা প্রশ্ন করল, তার কণ্ঠস্বরে ছিল একরকম কৌতূহল আর আনন্দ।
“এখন লাইব্রেরিকে আবার নতুন করে গড়ে তুলব,” অরুণ বলল, তার চোখে ছিল এক নতুন স্বপ্ন, তার মুখে ছিল এক দৃঢ় হাসি, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে ছিল একরকম গভীরতা, যা আগে ছিল না। “মানুষকে আবার বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করব। গল্পগুলো আবার প্রাণ ফিরে পাবে, আর ছায়ারা আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না। এটি আমার জীবনের নতুন লক্ষ্য, আমার নতুন উদ্দেশ্য, আমার নতুন অস্তিত্ব।”
অরুণ তার কাজ শুরু করল। সে প্রথমে লাইব্রেরির প্রতিটি তাক পরিষ্কার করল, বইগুলো সযত্নে গুছিয়ে রাখল। সে পুরনো, জীর্ণ বইগুলোর মলাট সেলাই করল, পাতাগুলো মেরামত করল। তার হাতের স্পর্শে প্রতিটি বই যেন নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছিল, তাদের মলাট থেকে একরকম মৃদু আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, যেন তারা অরুণের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে। সে লাইব্রেরির প্রতিটি কোণকে নতুন করে সাজিয়ে তুলল, প্রতিটি আসবাবপত্রকে পরিষ্কার করল। তার প্রতিটি কাজে ছিল একরকম ধীরতা, একরকম প্রাচীন জ্ঞান।
সে লাইব্রেরির প্রধান হলঘরের দরজা খুলে দিল। বহু বছর পর, ‘জ্ঞানদীপ’ লাইব্রেরির দরজা আবার সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হলো। প্রথম প্রথম কেউ এল না। মানুষ হয়তো ভুলেই গিয়েছিল যে এই গলির শেষ প্রান্তে এমন একটি লাইব্রেরি আছে, যা এককালে শহরের গর্ব ছিল, এখন শুধু একটি পুরোনো স্মৃতি।
কিন্তু অরুণ হাল ছাড়ল না। সে লাইব্রেরির বাইরে একটি ছোট সাইনবোর্ড লাগাল, যেখানে লেখা ছিল: “জ্ঞানদীপ লাইব্রেরি: যেখানে গল্পরা প্রাণ পায়। আসুন, আপনার গল্প খুঁজে নিন।” সে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত লাইব্রেরিতে বসে থাকত, বই পড়ত, আর অপেক্ষা করত। তার মনে ছিল অদম্য বিশ্বাস, যে একদিন মানুষ আবার জ্ঞানের আলোতে ফিরে আসবে, এবং গল্পের শক্তিকে অনুভব করবে।
একদিন, একটি ছোট ছেলে তার মায়ের সাথে সেই গলি দিয়ে যাচ্ছিল। ছেলেটি সাইনবোর্ডটি দেখে কৌতূহলী হলো। তার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে তার মাকে লাইব্রেরির ভেতরে যেতে বলল। মা প্রথমে ইতস্তত করল, তার মনে ছিল একরকম সংশয়, কিন্তু ছেলের আবদারে রাজি হলো। তাদের চোখে ছিল একরকম কৌতূহল আর বিস্ময়।
তারা লাইব্রেরির ভেতরে প্রবেশ করল। ছেলেটি অবাক হয়ে দেখল, লাইব্রেরিটা এত পরিষ্কার, এত সুন্দর। বইগুলো থেকে একরকম মৃদু দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে, যা তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলল, যেন প্রতিটি বই তাকে ডাকছে। সে একটি রূপকথার বই হাতে নিল। বইটি হাতে নিতেই সে অনুভব করল, তার শরীর দিয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল, যেন বইটির ভেতরে এক জীবন্ত সত্তা লুকিয়ে আছে, যা তার সাথে কথা বলতে চাইছে।
অরুণ ছেলেটিকে দেখে হাসল। তার হাসিটা ছিল আন্তরিক, কিন্তু তার চোখে ছিল এক গভীর, প্রাচীন জ্ঞান। “বই পড়তে ভালোবাসো?” তার কণ্ঠস্বরে ছিল একরকম উষ্ণতা, যা ছেলেটির মনকে শান্ত করে তুলল।
ছেলেটি মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের বাড়িতে এত বই নেই। আর এত সুন্দর বই আমি আগে কখনো দেখিনি। এগুলো কি জাদু বই?”
“এখানে অনেক বই আছে,” অরুণ বলল। “তুমি যত খুশি পড়তে পারো। প্রতিটি বইয়ের ভেতরে একটি নতুন জগৎ লুকিয়ে আছে, একটি নতুন অ্যাডভেঞ্চার অপেক্ষা করছে। আর হ্যাঁ, এগুলো সত্যিই জাদু বই, যদি তুমি বিশ্বাস করো।”
ছেলেটি বই পড়তে শুরু করল, আর তার মা অরুণের সাথে কথা বলতে লাগল। অরুণ তাদের লাইব্রেরির গল্প বলল, কীভাবে সে ছায়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, কীভাবে সে বইয়ের জগৎকে বাঁচিয়েছিল। তার কথা শুনে ছেলেটির মা অবাক হলো, তার চোখে ছিল একরকম বিস্ময় আর বিশ্বাস। সে বুঝতে পারল, এই লাইব্রেরিটা সাধারণ কোনো লাইব্রেরি নয়, এটি একটি পবিত্র স্থান, একটি জ্ঞানের মন্দির।
ধীরে ধীরে, লাইব্রেরিতে পাঠকের আনাগোনা বাড়তে লাগল। প্রথমে দু-একজন, তারপর আরও অনেকে। শিশুরা গল্প শুনতে আসত, তাদের চোখে ছিল নতুন জগতের স্বপ্ন, তাদের হাসির শব্দ লাইব্রেরির নীরবতাকে ভেঙে দিচ্ছিল। গবেষকরা পুরোনো বইয়ের সন্ধানে আসত, তাদের মুখে ছিল জ্ঞানের তৃষ্ণা, তাদের নীরবতা লাইব্রেরির পবিত্রতা রক্ষা করত। আর সাধারণ মানুষ নতুন গল্প পড়ার জন্য আসত, তাদের মনে ছিল এক নতুন আবিষ্কারের আনন্দ। ‘জ্ঞানদীপ’ লাইব্রেরি আবার জীবন্ত হয়ে উঠল, তার পুরোনো গৌরব ফিরে পেল, এমনকি তার চেয়েও বেশি কিছু।
অরুণ দেখল, যখন মানুষ বই পড়ছিল, যখন তারা গল্পগুলো নিজেদের মনে বাঁচিয়ে রাখছিল, তখন বইগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। তাদের থেকে বেরিয়ে আসা দ্যুতি আরও তীব্র হচ্ছিল, যেন তারা মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে, তাদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে বুঝতে পারল, মানুষের ভালোবাসা আর বিশ্বাসই বইয়ের জগতের মূল শক্তি। যতক্ষণ মানুষ গল্প পড়বে, ততক্ষণ ছায়ারা আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না, তাদের অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাবে, অথবা অনন্তকালের জন্য সুপ্ত থাকবে।
একদিন, অরুণ লাইব্রেরির প্রধান হলঘরে বসে বই পড়ছিল। তার পাশে আভা উড়ছিল, তার ডানা থেকে সোনালী গুঁড়ো ঝরে পড়ছিল, যা লাইব্রেরির বাতাসে একরকম জাদুর আভা তৈরি করছিল। সে দেখল, লাইব্রেরির দেয়ালগুলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, আর তার ভেতরে একরকম অদ্ভুত শক্তি খেলা করছে। লাইব্রেরির প্রতিটি কোণ থেকে যেন জীবন আর জ্ঞানের স্পন্দন ভেসে আসছিল, যা তাকে এক অদ্ভুত শান্তি দিচ্ছিল।
অরুণ বুঝতে পারল, তার জীবন বদলে গেছে। সে এখন শুধু একজন প্রহরী নয়, সে এখন একটি সেতুর মতো, যা মানুষের জগৎ আর বইয়ের জগৎকে সংযুক্ত করে। সে জানত, যতক্ষণ মানুষ গল্প পড়বে, যতক্ষণ তারা জ্ঞানকে ভালোবাসবে, ততদিন ছায়ারা আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না। তার দায়িত্ব এখন আরও বড়, আরও গুরুত্বপূর্ণ—সে এখন জ্ঞানের রক্ষক, গল্পের অভিভাবক, এবং এই জগতের নীরব প্রহরী।
‘জ্ঞানদীপ’ লাইব্রেরি আবার তার পুরোনো গৌরব ফিরে পেল, এমনকি তার চেয়েও বেশি কিছু। এটি এখন শুধু একটি লাইব্রেরি নয়, এটি একটি জাদুঘর, যেখানে গল্পরা প্রাণ পায়, যেখানে ইতিহাস শ্বাস নেয়, আর যেখানে প্রতিটি পাঠক একটি নতুন জগতের সন্ধান পায়। এটি এখন একটি জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ, যা প্রমাণ করে যে, মানুষের বিশ্বাস আর ভালোবাসার শক্তি যেকোনো অন্ধকারকে জয় করতে পারে। আর এই সবকিছুর পেছনে ছিল একজন মানুষ—অরুণ, ‘জ্ঞানদীপ’ লাইব্রেরির নিশাচর প্রহরী, যে তার ভালোবাসার মাধ্যমে একটি পুরো জগৎকে বাঁচিয়েছিল। তার নাম এখন গল্পের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, এক কিংবদন্তি হিসেবে। এবং সে জানত, যদিও ছায়ারা পরাজিত হয়েছে, তারা চিরতরে বিলীন হয়নি। তারা শুধু ঘুমিয়ে আছে, মানুষের ভুলে যাওয়ার অপেক্ষায়। তাই, অরুণকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। তার প্রহরা কখনো শেষ হবে না।
গল্পের সমাপ্তি
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion