ছায়া বনাম প্রহরী
প্রাচীন পুঁথি হাতে নিয়ে অরুণ গোপন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। তার মনে এখন স্পষ্ট ধারণা, তাকে কী করতে হবে। ‘অস্তিত্বের আলো’কে একত্রিত করে ছায়াদের পুরোপুরি ধ্বংস করা। লাইব্রেরির প্রধান হলঘরে ফিরে এসে সে দেখল, চাঁদের আলো তখনও মেঝেতে সেই বৃত্ত তৈরি করে আছে, যা গোপন কক্ষের প্রবেশপথ, যেন এটি তাদের জন্য একটি চিহ্ন, একটি শেষ লড়াইয়ের মঞ্চ।
“কীভাবে শুরু করব?” অরুণ আভা-কে প্রশ্ন করল, তার চোখে ছিল একরকম অস্থিরতা, তার হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল।
“তোমাকে তোমার হৃদয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী গল্পগুলোকে একত্রিত করতে হবে,” আভা বলল। “তোমার জীবনের সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত ভালোবাসা—সবকিছুকে একত্রিত করতে হবে। যখন তুমি তোমার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই আলো একত্রিত করবে, তখনই ছায়ারা ধ্বংস হবে। এটি একটি আত্মিক প্রক্রিয়া, যা তোমার ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলবে, এবং তোমাকে এই জগতের রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু মনে রেখো, এই আলো তোমার অস্তিত্বের সাথে গভীরভাবে জড়িত। এর ব্যবহার তোমার উপর চরম প্রভাব ফেলবে।”
অরুণ লাইব্রেরির প্রধান হলঘরে এসে দাঁড়াল। সে তার চারপাশের বইগুলোর দিকে তাকাল। প্রতিটি বই যেন তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করছে, তাদের গল্পগুলো তাকে শক্তি জোগাচ্ছে। লাইব্রেরির নীরবতা এখন আর ভীতিকর ছিল না, বরং একরকম পবিত্রতা ছিল তাতে, যেন প্রতিটি বই তাকে আশীর্বাদ করছে, তাদের শেষ আশা তার উপর।
হঠাৎ করেই লাইব্রেরির ভেতর থেকে এক তীব্র ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এল, যা সমস্ত বইয়ের পাতাগুলোকে একযোগে উল্টে দিল। ছায়ামূর্তিগুলো আবার ফিরে এসেছে। এবার তারা আরও শক্তিশালী, আরও হিংস্র। তাদের সংখ্যা অগণিত, তারা লাইব্রেরির প্রতিটি কোণ থেকে বেরিয়ে আসছিল, যেন অন্ধকার তাদের গ্রাস করছে। তাদের চোখ থেকে তীব্র লাল আলো বেরিয়ে আসছে, আর তাদের শরীর থেকে একরকম বিকট শব্দ বের হচ্ছে, যা অরুণের কানে বাজছিল, তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিতে চাইছিল, তার মনকে কলুষিত করতে চাইছিল।
“তুমি আমাদের দুর্বলতা জেনে গেছ,” ছায়াদের নেতার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সে এবার আরও বড়, আরও শক্তিশালী রূপে অরুণের সামনে এসে দাঁড়াল। তার শরীরটা যেন পুরো হলঘরকে গ্রাস করছিল, তার কালো ধোঁয়াময় শরীর থেকে একরকম অশুভ শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, যা অরুণের শ্বাসরোধ করে দিচ্ছিল। তার কণ্ঠস্বর ছিল বজ্রের মতো গভীর, যা পুরো লাইব্রেরিকে কাঁপিয়ে তুলছিল, এবং অরুণের মনে এক তীব্র আতঙ্ক জাগাচ্ছিল।
“কিন্তু তুমি আমাদের থামাতে পারবে না,” ছায়াদের নেতা গর্জন করল। “আমরা অগণিত। আমরা চিরন্তন। তুমি একা, প্রহরী, আমাদের শক্তির কাছে তুমি তুচ্ছ। তোমার নশ্বর জীবন আমাদের কাছে কিছুই নয়। আমরা তোমার সমস্ত গল্প, সমস্ত স্মৃতি গ্রাস করব, এবং তুমি আমাদেরই অংশ হয়ে যাবে!”
অরুণ ভয় পেল না। সে তার হাতে থাকা পুঁথিটি শক্ত করে ধরল। তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল, এক অদম্য সাহস। “তোমরা হয়তো অগণিত, কিন্তু তোমাদের কোনো নিজস্ব অস্তিত্ব নেই। তোমরা শুধু অন্যের গল্প চুরি করে বাঁচো। তোমরা শুধু শূন্যতা, যা আলোর স্পর্শে বিলীন হয়ে যায়। তোমরা আমার লাইব্রেরি, আমার গল্প, আমার অস্তিত্ব কেড়ে নিতে পারবে না!”
ছায়াদের নেতা গর্জন করে উঠল। সে তার কালো হাত অরুণের দিকে বাড়িয়ে দিল, যেন তাকে গ্রাস করতে চাইছে, তার সমস্ত শক্তি শুষে নিতে চাইছে। তার হাত থেকে একরকম ঠান্ডা শক্তি বেরিয়ে এল, যা অরুণের শরীরকে অবশ করে দিচ্ছিল, তার হৃদপিণ্ড যেন থেমে যাচ্ছিল। অরুণের চোখের সামনে তার জীবনের সমস্ত প্রিয় স্মৃতি ঝলসে উঠল, যেন তারা বিলীন হওয়ার পথে। অরুণ পিছিয়ে গেল, কিন্তু তার মনকে দৃঢ় রাখল, তার চোখে ছিল দৃঢ় সংকল্প।
“তোমার গল্প বলো!” আভা চিৎকার করে বলল, তার কণ্ঠস্বর যেন লাইব্রেরির প্রতিটা বই থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, যা অরুণের কানে এক নতুন শক্তি জুগিয়েছিল। “তোমার হৃদয়ের আলো দিয়ে ওদের আঘাত করো! তোমার প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি বিশ্বাস ওদের জন্য বিষ, প্রতিটি ভালোবাসা ওদের জন্য মৃত্যু! তোমার অস্তিত্বই তোমার অস্ত্র!”
অরুণ চোখ বন্ধ করল। তার মনে ভেসে উঠল তার জীবনের সমস্ত প্রিয় স্মৃতি, তার প্রিয় গল্পগুলো। তার শৈশবের দিনগুলো, তার প্রথম বই পড়ার অভিজ্ঞতা, এই লাইব্রেরিতে তার কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত। তার বাবা-মায়ের সাথে কাটানো সুখের দিনগুলো, তার প্রিয় বইয়ের চরিত্রদের সাথে তার কথোপকথন, তার স্বপ্ন, তার আশা। সে তার মন থেকে সমস্ত ভয়, সমস্ত সন্দেহ দূর করে দিল। তার মনে শুধু একটিই চিন্তা—তার লাইব্রেরিকে বাঁচানো, সমস্ত গল্পকে রক্ষা করা, এবং এই অন্ধকারকে চিরতরে দূর করা। সে অনুভব করল, তার আত্মা যেন এক বিশাল শক্তিতে ভরে উঠছে।
তার শরীর থেকে একটি উজ্জ্বল সাদা আলো বেরিয়ে এল। আলোটি ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে লাগল, আর তার চারপাশে একটি বৃত্ত তৈরি করল। এই আলো ছিল ‘অস্তিত্বের আলো’, যা তার হৃদয়ের সমস্ত জ্ঞান, বিশ্বাস আর ভালোবাসা দিয়ে তৈরি। আলোটি এতটাই তীব্র ছিল যে লাইব্রেরির অন্ধকার হলঘর আলোকিত হয়ে উঠল, ছায়ামূর্তিগুলো ভয়ে পিছিয়ে গেল, তাদের কালো শরীর থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে লাগল, যেন তারা আগুনে পুড়ছে। ছায়াদের আর্তনাদ পুরো লাইব্রেরিকে কাঁপিয়ে তুলল।
ছায়াদের নেতা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। ‘অস্তিত্বের আলো’ তার শরীরকে আঘাত করছিল, তাকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। তার কালো শরীর থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে লাগল, আর সে ক্রমশ ছোট থেকে ছোট হতে লাগল, যেন সে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট ছায়ামূর্তিগুলো ভয়ে পিছিয়ে গেল, তাদের লাল চোখগুলো নিভে যাচ্ছিল, তাদের অস্তিত্ব যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ছায়াদের নেতার চোখে তখনও একরকম ঘৃণা আর প্রতিজ্ঞা ছিল।
“তুমি আমাদের হারাতে পারবে না!” ছায়াদের নেতা শেষবারের মতো গর্জন করল, তার কণ্ঠস্বরে ছিল তীব্র ঘৃণা আর হতাশা, যেন সে তার শেষ নিঃশ্বাস ফেলছে। তার শরীরটা ধূলোর মতো ঝরে পড়ছিল, কিন্তু তার শেষ কথাগুলো অরুণের কানে বাজছিল। “আমরা আবার ফিরে আসব! যতক্ষণ মানুষ গল্প ভুলে যাবে, আমরা ততদিন শক্তিশালী হব! এই যুদ্ধ শেষ হয়নি, প্রহরী! আমরা চিরন্তন! আমরা শুধু অপেক্ষা করব, অন্ধকারে লুকিয়ে থাকব, সুযোগের অপেক্ষায়! তুমি আমাদের পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারবে না, তুমি শুধু আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারো!”
তারপর, এক ঝলক আলোর সাথে সাথে ছায়াদের নেতা অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন সে বাতাসে মিশে গেল, তার অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে মুছে গেল। তার সাথে সাথে ছোট ছোট ছায়ামূর্তিগুলোও মিলিয়ে গেল, যেন তারা কখনো ছিলই না, যেন তারা শুধু একটি দুঃস্বপ্ন ছিল। কিন্তু তাদের শেষ কথাগুলো অরুণের মনে এক গভীর ছাপ ফেলে গেল।
লাইব্রেরির ভেতরে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। এবার এই নীরবতা ছিল শান্ত, পবিত্র। বাতাসের ঠান্ডা ভাব দূর হয়ে একরকম উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। বইগুলো থেকে বেরিয়ে আসা দ্যুতি আরও তীব্র হলো, যেন তারা আনন্দিত, যেন তারা নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। কিন্তু অরুণের শরীর ছিল ক্লান্ত, তার আত্মা যেন এক গভীর শুন্যতা অনুভব করছিল। ‘অস্তিত্বের আলো’ ব্যবহার করার মূল্য তাকে দিতে হচ্ছিল। তার মনে হলো, তার নিজের কিছু অংশ যেন এই আলোর সাথে বিলীন হয়ে গেছে। তার চুল আরও সাদা হয়ে গেল, তার ত্বকে গভীর বলিরেখা দেখা দিল, যেন সে এক মুহূর্তে কয়েক দশক পার করে এসেছে।
অরুণ হাঁপাতে হাঁপাতে মেঝেতে বসে পড়ল। তার শরীর ক্লান্ত, তার আত্মা যেন শূন্য। সে ছায়াদের পুরোপুরি ধ্বংস করেছে। তার লাইব্রেরি এখন নিরাপদ। তার মনে হলো যেন এক বিশাল বোঝা তার কাঁধ থেকে নেমে গেছে, তার আত্মা যেন মুক্ত হয়েছে। কিন্তু এই মুক্তির পেছনে এক গভীর ত্যাগ লুকিয়ে ছিল।
আভা অরুণের পাশে এসে বসল। তার আলো আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, যেন সেও এই বিজয়ে আনন্দিত, তার ডানা থেকে সোনালী গুঁড়ো ঝরে পড়ছিল। “তুমি করেছ! তুমি ছায়াদের হারিয়েছ! তুমি আমাদের জগৎকে বাঁচিয়েছ! তুমি সত্যিকারের প্রহরী, এই জগতের রক্ষক।”
অরুণ হাসল। তার চোখে জল এসে গেল। সে তার লাইব্রেরির দিকে তাকাল। লাইব্রেরিটা এখন আর জীর্ণ দেখাচ্ছে না। তার দেয়ালগুলো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, আর বইগুলো থেকে একরকম মৃদু দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তার মনে হলো যেন লাইব্রেরিটা শ্বাস নিচ্ছে, আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে, তার প্রতিটি কোণ থেকে নতুন প্রাণের স্পন্দন ভেসে আসছে।
“কিন্তু এখন কী হবে?” অরুণ প্রশ্ন করল। তার কণ্ঠস্বরে ছিল একরকম দুর্বলতা। “লাইব্রেরিটা কি আবার আগের মতো হবে? মানুষ কি আবার এখানে আসবে? আমার কি আর কোনো দায়িত্ব আছে? আমি কি আগের মতো থাকব?”
“হ্যাঁ,” আভা বলল। “তুমি ছায়াদের ধ্বংস করেছ, তাই এখন বইয়ের জগৎ আবার প্রাণ ফিরে পাবে। আর তোমার লাইব্রেরিও আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে। মানুষের মনে গল্পের প্রতি ভালোবাসা আবার জেগে উঠবে। তোমার দায়িত্ব এখন আরও বড়, প্রহরী। তুমি এখন এই জগতের রক্ষক, এবং তোমার অস্তিত্ব এই লাইব্রেরির সাথে চিরতরে মিশে গেছে।”
অরুণ জানত, তার কাজ শেষ হয়নি। তাকে এখন তার লাইব্রেরিকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। তাকে মানুষকে আবার বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে, যাতে গল্পগুলো আবার প্রাণ ফিরে পায়, আর ছায়ারা আর কখনো ফিরে আসতে না পারে। কিন্তু সে অনুভব করল, তার শরীর আর মন যেন আগের মতো নেই। তার চুল আরও সাদা হয়ে গেছে, তার চোখে এক গভীর ক্লান্তি, যেন সে শত শত বছর ধরে জেগে আছে। সে বুঝতে পারল, ‘অস্তিত্বের আলো’ ব্যবহার করার ফলে সে নিজেও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। সে এখন এই লাইব্রেরির সাথে আরও গভীরভাবে সংযুক্ত, যেন সে নিজেই লাইব্রেরির একটি অংশ। তার হৃদপিণ্ড যেন লাইব্রেরির প্রতিটি স্পন্দনের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion