Episode 1568 words4 views

অধ্যায় ১: ঝড় এবং দ্বীপ

বর্ষার শেষ দিক। বঙ্গোপসাগরের বুক তখনো মাঝেমধ্যে নিম্নচাপের ভ্রূকুটি দেখা যায়। তেমনই এক মেঘলা দিনে, 'সাগরকন্যা' নামের একটি মাঝারি আকারের গবেষণা নৌকা বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে এগিয়ে চলেছিল সুন্দরবনের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে। নৌকার উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রতিক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় 'নিশাচর'-এর পর উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের উপর তার প্রভাব সমীক্ষা করা। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন ডক্টর অরিন্দম বসু, দেশের একজন প্রখ্যাত সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী। চল্লিশের কোঠায় বয়স, শান্ত, স্থিতধী এবং অভিজ্ঞ। তাঁর সঙ্গী ছিলেন দুজন তরুণ গবেষক—ডক্টর রিয়া সেন, একজন প্রতিভাবান উদ্ভিদবিজ্ঞানী, যার গাছপালার প্রতি ভালোবাসা প্রায় আধ্যাত্মিক পর্যায়ে পৌঁছায়, এবং বিক্রম চ্যাটার্জী, পেশিতে ও মেজাজে সমানভাবে শক্তিশালী এক ভূতত্ত্ববিদ, যার কাছে পাহাড়-পাথর জীবন্ত সত্তার মতো। দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিল সোহম ঘোষ, টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, যার প্রধান কাজ ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি সামলানো। আর এই চারজন শহুরে মানুষকে যিনি সুন্দরবনের জটিল জলপথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি হলেন রশিদ ভাই, পঞ্চাশোর্ধ এক অভিজ্ঞ মাঝি, যার চামড়ায় নোনা জল আর রোদের সহাবস্থান স্পষ্ট। তার চোখ দুটো ছিল সমুদ্রের মতোই গভীর, যেখানে যুগ যুগ ধরে দেখা ঝড়ের অভিজ্ঞতা জমাট বেঁধে আছে। 'নিশাচর' কেবল স্থলভাগেই তাণ্ডব চালায়নি, সমুদ্রের তলার ভূগোলও অনেকাংশে বদলে দিয়েছিল। অরিন্দমের দলটির মূল লক্ষ্য ছিল নতুন জেগে ওঠা কোনো চর বা দ্বীপের সন্ধান করা এবং সেখানকার বাস্তুতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করা। প্রায় তিন দিন ধরে যাত্রা করার পর, তারা মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক গভীরে চলে এসেছিল। আকাশটা সকাল থেকেই গোমড়া মুখে ছিল। রশিদ ভাই বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছিলেন। "স্যারেরা, আহাওয়া ভালো ঠেকছে না। বাতাসটা কেমন যেন ভারী হয়ে আসছে। চলেন, কূলের দিকে ফিরে যাই," তিনি অরিন্দমকে উদ্দেশ্য করে বললেন। তার গলার স্বরে একটা চাপা উদ্বেগ ছিল, যা সাধারণত তার মতো অভিজ্ঞ মাঝির কাছে শোনা যায় না। বিক্রম হেসে বলল, "কী যে বলো রশিদ ভাই! এই তো সবে আসল জায়গায় এসেছি। এটুকু মেঘ-বৃষ্টি আমাদের অভ্যাস আছে।" কিন্তু রশিদ ভাইয়ের আশঙ্কা সত্যি হতে বেশি সময় লাগল না। দুপুরের পর হঠাৎ করেই আকাশটা যেন কেউ কালি দিয়ে লেপে দিল। উত্তাল সমুদ্রের ঢেউগুলো 'সাগরকন্যা'-কে যেন একটা খেলনার মতো দোলাতে শুরু করল। দেখতে দেখতে প্রবল ঝড়ো হাওয়া আর মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। এটা 'নিশাচর'-এর রেখে যাওয়া এক বিক্ষিপ্ত অংশ, এক ক্ষণস্থায়ী কিন্তু ভয়ঙ্কর স্কল। ইঞ্জিনের ঘরঘর আওয়াজ ছাপিয়ে বাতাসের একটানা গর্জন কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। এক বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকার মাস্তুলটা মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। আর একটা বড় ঢেউয়ের ঝাপটায় নৌকার একপাশে রাখা ডিজেলের ড্রামগুলো গড়িয়ে পড়ে বেতার যন্ত্রটা চুরমার করে দিল। সোহম অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখল, সভ্য জগতের সাথে যোগাযোগের শেষ সুতোটাও ছিঁড়ে গেল। চারিদিকে কেবল উন্মত্ত জলের গর্জন আর মৃত্যুর আস্ফালন। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলল প্রকৃতির এই উন্মত্ততা। যখন ঝড় কিছুটা শান্ত হলো, তখন সন্ধ্যা নামছে। নৌকার ইঞ্জিনটা কাশতে কাশতে একসময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। ভাঙা মাস্তুল, ছেঁড়া পাল আর বিকল ইঞ্জিন নিয়ে 'সাগরকন্যা' তখন এক দিশাহীন জলযান। অরিন্দম দূরবীণ চোখে লাগিয়ে চারপাশে দেখছিলেন। হতাশার অন্ধকারে এক চিলতে আলোর মতোই তিনি দূরে একটা অস্পষ্ট রেখা দেখতে পেলেন। "দ্বীপ! ওই যে, একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে!" রশিদ ভাই ভাঙা হালটা কোনোক্রমে সোজা করে বললেন, "আল্লাহর মেহেরবানি। চলেন, ওখানেই আশ্রয় নিতে হবে। নৌকাটা আর বেশিক্ষণ ভাসবে বলে মনে হয় না।" সকলে মিলে অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে দাঁড় বেয়ে নৌকাটাকে সেই দ্বীপের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় তারা দ্বীপের তটভূমিতে এসে পৌঁছাল। দ্বীপটা ঘন সবুজ গাছে ঢাকা। নির্জন, শান্ত। যেন সভ্য জগৎ থেকে বহু দূরে প্রকৃতির এক গোপন আশ্রয়। তারা বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বালির উপর নেমে এল। পেছনে পড়ে রইল তাদের ভাঙা নৌকা 'সাগরকন্যা', যা হয়তো আর কোনোদিন সমুদ্রে ভাসবে না। তারা জানত না, এই শান্ত, সুন্দর দ্বীপ আসলে এক ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ, যেখানে স্বাগত জানানোর জন্য কেউ নেই, আছে শুধু এক আদিম, সর্বগ্রাসী নৈঃশব্দ্য।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion