সকালের আলো ফুটতেই দ্বীপের আসল রূপ প্রকাশ পেল। দ্বীপটি খুব বড় নয়, কিন্তু গাছপালায় অবিশ্বাস্য রকমের ঘন। লম্বা লম্বা অচেনা গাছের জঙ্গলটা যেন একটা সবুজ প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সৈকতটা পরিষ্কার, সোনালী বালিতে ঢাকা। কিন্তু এই সৌন্দর্যের মধ্যেও কোথায় যেন একটা খটকা ছিল। একটা অস্বস্তিকর শূন্যতা।
রিয়া সেন সবার আগে ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। "অরিন্দমদা, একটা জিনিস খেয়াল করেছ?"
"কী?" অরিন্দম ভাঙা নৌকা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নামাতে নামাতে জিজ্ঞেস করলেন।
"দ্বীপটা বড্ড বেশি চুপচাপ। কোনো পাখির ডাক নেই, পোকামাকড়ের গুঞ্জন নেই। কিচ্ছু না। যেন... যেন জঙ্গলটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে না।"
রিয়ার কথা শুনে বাকিরাও কান পাতল। সত্যিই তো! এই ধরনের ক্রান্তীয় দ্বীপে যে স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্যের কোলাহল থাকার কথা, তার কিছুই এখানে নেই। কেবল সমুদ্রের ঢেউয়ের একটানা গর্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পরিবেশটা অবাস্তব রকমের শান্ত। যেন কোনো অদৃশ্য পরিচালক প্রকৃতির ঐকতানকে জোর করে থামিয়ে দিয়েছে।
রশিদ ভাই কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বললেন, "এমন নিঝুম বন আমি আমার জীবনে দেখি নাই, স্যার। সুন্দরবনের সবচাইতে গভীর জঙ্গলেও কত রকমের আওয়াজ। এ জায়গাটা ভালো না। এখানকার বাতাসটাও কেমন যেন ভারী।"
বিক্রম অবশ্য এসবে পাত্তা দেওয়ার পাত্র নয়। সে তার ভূতত্ত্বের নেশায় মগ্ন। বালির গঠন, পাথরের স্তর পরীক্ষা করতে করতে বলল, "অসাধারণ! এখানকার শিলার গঠন একদম অন্যরকম। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সমুদ্রের তলা থেকে উঠে এসেছে, তাই হয়তো এখানকার বাস্তুতন্ত্র এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি।"
সোহম বিধ্বস্ত রেডিওটা নিয়ে বসেছিল। অনেক চেষ্টার পর হতাশ হয়ে বলল, "কোনো আশা নেই, অরিন্দমদা। ট্রান্সমিটারটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।"
অরিন্দম পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলেন। তারা এক অজানা দ্বীপে আটকা পড়েছে। সঙ্গে খাবার জল এবং শুকনো খাবার যা আছে, তাতে হয়তো সপ্তাহখানেক চলবে। কিন্তু তারপর? উদ্ধারের কোনো আশাও নেই, কারণ কেউ জানে না তারা ঠিক কোথায় আছে।
"আমাদের প্রথম কাজ হলো একটা অস্থায়ী শিবির তৈরি করা এবং পানীয় জলের উৎস খোঁজা," অরিন্দম শান্তভাবে নির্দেশ দিলেন।
তারা সকলে মিলে নৌকার ভাঙা কাঠ, ত্রিপল দিয়ে সৈকতের ধারে, জঙ্গল থেকে কিছুটা দূরে একটা ছোট আশ্রয় তৈরি করল। বিক্রম আর রশিদ ভাই জঙ্গলের ভেতরে জলের সন্ধানে গেল। অরিন্দম আর রিয়া দ্বীপের উদ্ভিদ জগৎ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। গাছগুলো অদ্ভুত রকমের বড় আর পাতাগুলো অস্বাভাবিক রকমের পুরু। কোনো গাছে ফল বা ফুল নেই। রিয়া একটা পাতা ছিঁড়তেই দেখল, ভেতর থেকে দুধের মতো সাদা, ঘন এক ধরনের রস বেরিয়ে আসছে, যার গন্ধটা কেমন যেন অচেনা, কিছুটা অস্বস্তিকর।
কিছুক্ষণ পর বিক্রম আর রশিদ ভাই ফিরে এল। তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারা সফল। বিক্রমের হাতে একটা জলের বোতল। "মিষ্টি জল। জঙ্গলের ভেতরে একটা ছোট ঝর্ণা আছে।"
এই খবরটা সকলের মনে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এল। অন্তত জলের চিন্তাটা মিটল। তারা সবাই মিলে ঝর্ণা থেকে জল ভরে আনল। দিনটা এভাবেই কেটে গেল। দ্বীপের অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যটা ধীরে ধীরে তাদের স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল, যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি সব শব্দ শুষে নিচ্ছে।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে সেই নিস্তব্ধতা আরও গভীর, আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। তারা আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ভেজা কাঠে আগুন জ্বলল না। অগত্যা, তারা ঠাণ্ডার মধ্যেই কাঁচা খাবার খেয়ে রাত কাটানোর জন্য প্রস্তুত হলো। চাঁদের আলোয় দ্বীপটাকে রহস্যময় দেখাচ্ছিল। চারদিকে শুধু সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ আর তাদের নিজেদের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি।
রশিদ ভাই বিড়বিড় করে বললেন, "পুরোনো দিনের মানুষেরা বলত, সুন্দরবনের দক্ষিণে আছে 'নিঃশব্দ বন', যেখানে সব আওয়াজ হারিয়ে যায়। জীবজন্তু সেখানে ভয়ে ঢোকে না। ভাবতাম সব গালগল্প।"
তার কথাগুলো যেন হিমশীতল বাতাসের মতো সকলের শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। এই দ্বীপ কি তবে সেই কিংবদন্তীর 'নিঃশব্দ বন'?
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion