Episode 11307 words0 views

নিথর পদচিহ্ন: পর্ব ১

নিথর পদচিহ্ন (Frozen Footprints) পর্ব ১: উন্মোচন ভোর তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। কলকাতার উপকণ্ঠের সেই নির্জন রাস্তাটি সাধারণত এত ভোরে জেগে ওঠে না। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। ভোরের পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করার আগেই, কয়েকজন স্থানীয় পথচারীর আর্তচিৎকারে নীরবতা ভঙ্গ হলো। যে নীরবতা ছিল নিশ্ছিদ্র, তাকে ছিঁড়ে খান খান করে দিল মানুষের গলা থেকে বের হওয়া এক আদিম আতঙ্ক। রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ের আড়ালে পড়ে আছে এক তরুণীর নিথর দেহ। প্রথম যারা দেখেছিল, তাদের চোখে অবিশ্বাস আর বিভীষিকা। মেয়েটি চিত হয়ে শুয়েছিল, পরনের পোশাক এলোমেলো, আর উন্মুক্ত বুক থেকে অবিরত রক্তের ধারা এসে মিশেছে শিশির ভেজা ঘাসের সাথে, যেন রাতের আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা এক বিভৎস চিত্র। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে তাকে, এটুকু বুঝতে ডাক্তার হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু শরীরের কিছু অংশে যে বীভৎস চিহ্ন, তা দেখে সাধারণ মানুষও আঁতকে উঠল। যেন শুধু খুন করাই উদ্দেশ্য ছিল না, তার সাথে মিশেছিল এক বিকৃত আনন্দ আর কোনো এক অন্ধকার বার্তা। খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরই সাইরেন বাজিয়ে হাজির হলো পুলিশের ভ্যান, তাদের তীব্র আলো সেই নির্জন স্থানটিকে আরও বেশি অশুভ করে তুলল। ইন্সপেক্টর রিমা সেনগুপ্ত যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছাল, তখন সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে মাত্র। ভোরের নরম আলোয় লাশের ওপরের বীভৎসতা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল, প্রতিটি ক্ষত স্পষ্ট। চারপাশে উৎসুক জনতার ভিড় আর পুলিশের আনাগোনা। রিমা তার কালো এসইউভি থেকে নেমে গভীর চোখে একবার চারপাশটা দেখে নিল। তার মুখে একটা ক্লান্তি মাখা ভাব, চোখের নিচে হালকা কালি, যা গত কয়েক মাসের না-ঘুমোনো রাতগুলোর সাক্ষ্য বহন করছিল। গত কয়েক মাস ধরেই রিমার ব্যক্তিগত জীবনটা ঠিক চলছিল না। এক ব্যর্থ সম্পর্ক আর তার রেশ ধরে আসা কিছু পারিবারিক জটিলতা তাকে গ্রাস করে রেখেছিল। সে চেষ্টা করছিল নিজেকে পুরোপুরি কাজে ডুবিয়ে দিতে, কিন্তু এই ধরণের কেসগুলো যেন মনের সুপ্ত ক্ষতগুলোকে আরও উসকে দেয়। এই ঠান্ডা সকালের বাতাস তার স্নায়ুগুলোকে যেন আরও বেশি শীতল করে দিচ্ছিল। “ম্যাডাম, অভ্রজিৎ মিত্র,” পাশে এসে দাঁড়ানো বছর তিরিশের এক তরুণ পুলিশ অফিসার হাত বাড়াল। সাব-ইন্সপেক্টর অভ্রজিৎ মিত্র, রিমার নতুন সহকারী। ছেলেটা বেশ উৎসাহী, প্রযুক্তিগত জ্ঞানেও পারদর্শী। কিন্তু অভিজ্ঞতার দিক থেকে সে রিমার ধারেকাছেও নেই। রিমা নির্লিপ্তভাবে হাত মিলিয়ে বলল, “কেসটা দেখেছেন?” “জি ম্যাডাম। প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে,” অভ্রজিৎ বলল। রিমা মাথা নাড়ল। সে ততক্ষণে লাশের কাছে চলে গেছে। লাশ ঘিরে রাখা হলুদ ফিতাগুলো যেন তার সামনে অদৃশ্য, সে শুধু লাশের দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন খুনীর উপস্থিতি তার প্রতিটি শিরায় অনুভব করছে। রিমা হাঁটু গেড়ে বসে মৃতদেহটি খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। তার তীক্ষ্ণ চোখ মৃতদেহের প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করছিল, যেন প্রতিটি ভাঁজে খুনীর ফেলে যাওয়া কোনো গোপন চিহ্ন খুঁজছে। সায়নী দেব, বছর উনিশের এক কলেজ ছাত্রী। পরনের পোশাক ছিঁড়ে গেছে, সারা গায়ে আঁচড়ের দাগ। কিন্তু রিমার চোখ আটকে গেল মেয়েটির হাতের দিকে। কব্জিতে শক্ত করে বাঁধা দড়ির চিহ্ন, যা খুলতে গিয়ে খুনীর হাতের চাপ যেন অতিরিক্ত ছিল, যেন কোনো এক অপ্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল। এবং আরও কিছু… মেয়েটির চুলগুলো অদ্ভুতভাবে এলোমেলো, কিছু ছোট ছোট কাঁচের টুকরো চুলের সাথে লেগে আছে, যা সাধারণ কোনো সংঘর্ষের ফল বলে মনে হলো না। সবচেয়ে অস্বাভাবিক যা রিমার চোখ এড়াল না, তা হলো লাশের পাশে পড়ে থাকা এক ধরণের শুকনো, ধূসর রঙের পাতা। অদ্ভুত দেখতে, অনেকটা মটর দানার মতো ছোট ছোট অংশযুক্ত। রিমা জীবনে এমন গাছ আগে দেখেনি, বিশেষ করে শহরের উপকণ্ঠে এমন বিরল উদ্ভিদ থাকার কথা নয়। এটা কি শুধু একটা কাকতালীয় ঘটনা, নাকি খুনীর কোনো জঘন্য বার্তা? “লাশটা সরাও,” রিমা অভ্রজিৎকে নির্দেশ দিল। তার কণ্ঠে এক ধরণের চাপা উত্তেজনা। “ফরেনসিকে খবর দাও। আর ঘটনাস্থলের প্রতিটি কোণ থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করো। বিশেষ করে এই পাতাগুলো। কোনো কিছুই যেন বাদ না যায়।” অভ্রজিৎ মাথা নেড়ে নির্দেশ পালন করতে গেল। রিমা জানে, প্রথম কয়েক ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ক্ষুদ্র সূত্রই তাকে খুনীর দিকে নিয়ে যেতে পারে, অথবা তাকে এক গভীর অন্ধকার গোলকধাঁধায় ফেলে দিতে পারে। মাত্র তিন দিন কেটেছে প্রথম ঘটনার পর। পুলিশ যখন সায়নী দেবের খুনের তদন্তে সবে গতি আনতে শুরু করেছে, তখনই ঘটল দ্বিতীয় ঘটনা। এবার শিকার একজন তরুণী পেশাদার, নাম অনামিকা বসু। বয়স পঁচিশ। তার ফ্ল্যাটের কাছাকাছি একটি পরিত্যক্ত গুদামের ভেতর থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার হলো। দৃশ্যপট প্রায় হুবহু একই রকম। অনামিকাকেও ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করা হয়েছে, তার শরীরেও একই বীভৎস চিহ্ন, এবং তার হাতের কব্জিতেও দড়ির গভীর দাগ, যা সায়নীর লাশের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছিল। আর অবাক করা বিষয়, তার চুলের সাথেও সেই একই ধূসর রঙের বিরল উদ্ভিদের শুকনো পাতা লেগে ছিল, যেন খুনী তার স্বাক্ষর রেখে গেছে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে। এই খবরটা মুহূর্তেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। রিমা দ্রুত বুঝতে পারল, এটা নিছকই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কলকাতার বুকে একজন সিরিয়াল কিলার সক্রিয় হয়েছে। তার মোডাস অপারেন্ডি (MO) অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট, এবং এই পাতাগুলো তার ‘সাজেশ’ বা ট্রেডমার্ক। জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। সন্ধ্যার পর শহরের রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ল, মেয়েদের মনে এক অদৃশ্য ভয় বাসা বাঁধল। সংবাদমাধ্যমগুলো এ নিয়ে ফলাও করে রিপোর্ট করতে শুরু করল, ‘সিরিয়াল কিলারের হানাদারি’, ‘নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন’ – এমন শিরোনামে খবরের কাগজ ভরে উঠল। পুলিশের ওপর চাপ বাড়তে লাগল, দ্রুত খুনীকে ধরার জন্য। শহর যেন এক অজানা আতঙ্কে জমে গিয়েছিল। এই দুটি ঘটনা রিমার ওপর গভীর মানসিক চাপ সৃষ্টি করল। তার ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা, যা সে কাজে ডুবিয়ে রাখতে চাইছিল, তা যেন এখন এই নৃশংসতার মুখোমুখি হয়ে আরও প্রকট হয়ে উঠল। বিশেষ করে, সায়নী আর অনামিকার মতো তরুণীদের অসহায়, বীভৎস পরিণতি তাকে তাড়িত করছিল, যেন সেও কোনোভাবে এই অসহায়ত্বের অংশীদার। মেয়েদের ওপর এমন পাশবিক অত্যাচার, রিমা তার পুলিশ জীবনে অনেক দেখেছে। কিন্তু এই কেসটা যেন অন্যরকম। খুনীর পদ্ধতি, তার নির্দয়তা – সবকিছুই যেন রিমার ভেতরের ঘুমন্ত কোনো আবেগকে নাড়া দিচ্ছিল। এক ধরণের ব্যক্তিগত আক্রোশ জেগে উঠছিল তার মধ্যে। “অভ্রজিৎ,” রিমা তার অফিসে ফিরে এসে বলল, তার কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক শান্ত। “গত পাঁচ বছরে কলকাতার আশেপাশে যত ধর্ষণ ও খুনের কেস অমীমাংসিত আছে, তার সব ফাইল নিয়ে এসো। বিশেষ করে যেগুলো এই ধরণের নৃশংসতার সাথে সম্পর্কিত। চুলের সাথে এই পাতাগুলোও খুঁজবে। একটাও ফাইল বাদ দেওয়া যাবে না।” অভ্রজিৎ বিস্মিত চোখে তাকাল। “সিরিয়াল কিলার, ম্যাডাম?” “আমার তাই মনে হচ্ছে। আর এই খুনী অনেকদিন ধরেই সক্রিয়, হয়তো আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি।” রিমার চোয়াল শক্ত হলো। তার চোখে ফুটে উঠল এক ধরণের অনমনীয় দৃঢ়তা। এই খুনীকে সে খুঁজে বের করবেই, যেভাবেই হোক। এটা শুধু তার পেশাগত দায়িত্ব নয়, যেন এক ধরণের ব্যক্তিগত প্রতিজ্ঞা, এক অদৃশ্য যুদ্ধে নেমে পড়ার প্রস্তুতি। কেসটি দ্রুতই হাই-প্রোফাইল হয়ে ওঠায় রিমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, বিশেষ করে ডিআইজি, দ্রুত ফলাফল চাইতে শুরু করলেন। প্রতিদিন মিটিং, প্রেজেন্টেশন, আর প্রটোকলের চাপ বাড়ছিল। “রিমা, দ্রুত কিছু একটা করো। শহরের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আমাদের উপর জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে,” ডিআইজি প্রায় প্রতিদিনই বলতেন, তার কণ্ঠে অধৈর্যতা স্পষ্ট। এদিকে, পুলিশ বিভাগের কিছু পুরুষ সহকর্মী রিমার নারী হিসেবে এই ধরণের নৃশংস কেস সামলানোর ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিল। তাদের চোখে যেন এক ধরণের তাচ্ছিল্য আর সন্দেহ। “মেয়ে মানুষ হয়ে এমন কেস সামলাতে পারবে তো? এটা তোমার জন্য অতিরিক্ত চাপ হতে পারে,” – এমন অস্ফুট বাক্যগুলো রিমার কানে আসছিল, প্রতিটি শব্দ যেন তাকে আরও বেশি জেদি করে তুলছিল। এই ধরণের লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক মন্তব্য রিমার ভেতরের আগুনকে আরও বাড়িয়ে দিল। সে জানে, এই কেসটা তাকে শুধু খুনীকে ধরার জন্যই নয়, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্যও জিততে হবে। রাত প্রায় দুটো। অভ্রজিৎ কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চোখ লাল, শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল। রিমার নির্দেশ অনুযায়ী সে পুরনো ফাইলপত্র ঘাঁটছিল। হঠাৎ সে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠল, “ম্যাডাম! পেয়েছি! অবিশ্বাস্য!” রিমা দ্রুত তার টেবিলের দিকে ছুটে গেল, তার সমস্ত ক্লান্তি মুহূর্তেই উধাও। স্ক্রিনে একটি পুরনো, ধুলো মাখা কেস ফাইল। বছর চারেক আগে কলকাতার উপকণ্ঠে ঘটে যাওয়া একটি খুনের ঘটনা। শিকার ছিল একজন স্কুল শিক্ষিকা। কেসটা অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছিল। অভ্রজিৎ মাউস দিয়ে ছবিগুলো জুম করল। বীভৎসতা, হাতের কব্জিতে দড়ির চিহ্ন – সবকিছুই মিলে যাচ্ছে। আর হ্যাঁ, লাশের পাশে পড়ে থাকা সেই ধূসর রঙের শুকনো পাতা। হুবহু একই রকম, যেন একই গাছ থেকে তুলে আনা হয়েছে! “খুনী,” রিমা ফিসফিস করে বলল। তার চোখে এক নতুন ঝলক, এক ভয়ংকর সত্যের উন্মোচন। সে বুঝতে পারল, এই খুনী অনেকদিন ধরেই সক্রিয় এবং তার শিকারের সংখ্যা সম্ভবত আরও অনেক বেশি। এই পুরনো সূত্র রিমার কাছে একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিল, কিন্তু সেই দিগন্তের পেছনে লুকিয়ে ছিল এক বিশাল অন্ধকার, যা তাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। তার মনে হলো, সে যেন খুনীর নিথর পদচিহ্নগুলোর প্রথমটি খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু সেই পদচিহ্নগুলো কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তা তখনও অজানা। এক হিমশীতল অনুভূতি তার মেরুদণ্ড দিয়ে নেমে গেল।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion