নিথর পদচিহ্ন (Frozen Footprints)
পর্ব ২: দ্য হন্টিং প্যাটার্ন
সকাল হতেই রিমা তার পুরনো ফাইল ঘাঁটার কাজ শুরু করে দিল। অভ্রজিৎ তখনও ক্লান্ত চোখে তার পাশে বসে ছিল, কিন্তু রিমার চোখে এখন এক অদ্ভূত, প্রায় হিংস্র উন্মাদনা। রাতারাতি তার ক্লান্তি যেন উধাও হয়ে গেছে, তার স্নায়ু যেন লোহার মতো দৃঢ়। পুরনো ফাইলটি খুলতেই একটা ভ্যাপসা, পুরনো কাগজের গন্ধ নাকে এল, যেন চাপা পড়ে থাকা দীর্ঘদিনের গোপনীয়তা তার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। সালটা ছিল প্রায় চার বছর আগের, শিকার স্কুল শিক্ষিকা রুমা সেন। সায়নী আর অনামিকার মতোই তাকেও ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করা হয়েছিল, আর তার শরীরেও ছিল সেই একই বীভৎস চিহ্ন, যা প্রতিটি ভুক্তভোগীর ওপর যেন একটি অদৃশ্য স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছিল। রিমার দৃষ্টি বারবার রুমা সেনের লাশের ছবিগুলোর ওপর স্থির হচ্ছিল। প্রতিটি খুঁটিনাটি মিলে যাচ্ছে, যেন কোনো এক অন্ধকার, অদৃশ্য শক্তি এই অপরাধগুলোকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে, একটি জঘন্য চিত্রকর্মের মতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই ধূসর রঙের শুকনো পাতা। রুমা সেনের হাতের মুঠোতেও ছিল সেই পাতা, যা তখন নিছকই আবর্জনা ভেবে উপেক্ষা করা হয়েছিল, যেন খুনী তাদের নাকের ডগায় তার অপরাধের প্রমাণ ফেলে গিয়েছিল, আর তারা তা দেখেও দেখতে পায়নি।
“চার বছর আগে, অভ্রজিৎ,” রিমা ফিসফিস করে বলল, তার কণ্ঠস্বর এক হিমশীতল নীরবতার মধ্যে চাপা ক্রোধে কাঁপছিল। “চার বছর ধরে এই খুনী সক্রিয় ছিল, আমাদের নাকের ডগায়, আর আমরা জানতেও পারিনি। এই প্রতিটি পাতার পেছনে লুকিয়ে আছে এক জীবন, এক স্বপ্ন, যা নিষ্ঠুরভাবে, অকথ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিটি শিকারের জীবন যেন এক নিথর আর্তনাদ, যা এতকাল কেউ শুনতে পায়নি।”
অভ্রজিৎ মাথা নাড়ল, তার মুখেও এক ধরণের অবসাদ আর বিস্ময়। “ম্যাডাম, তখন কি ফরেনসিক রিপোর্ট এই পাতাগুলো নিয়ে কিছু বলেছিল?”
“না। তখন এটাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সম্ভবত, এটা কোনো গাছের পাতা হিসেবেই ধরা হয়েছিল যা ঘটনাস্থলের আশেপাশে থাকতে পারে,” রিমা বলল, তার চোখে এক ধরণের আত্ম-ধিকার। “কিন্তু এখন এটা তার ‘সাজেশ’। তার অশুভ স্বাক্ষর। আমরা এতদিন তার খেলাটা বুঝতে পারিনি।”
রিমা নির্দেশ দিল, রুমা সেনের কেস ফাইল থেকে সকল ফরেনসিক রিপোর্ট পুনরায় পর্যালোচনা করতে। প্রতিটি সূত্র, প্রতিটি সাক্ষ্যপ্রমাণ, প্রতিটি খুঁটিনাটি আবার খতিয়ে দেখতে হবে, এবার আরও সতর্কতার সাথে, যেন তারা কোনো গুপ্তধনের সন্ধান করছে।
রুমা সেনের কেস ফাইলের সূত্র ধরে ফরেনসিক টিমের উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি হলো। রিমার বিশেষ নির্দেশে, তিনটি লাশের কাছ থেকে পাওয়া সেই বিরল ধূসর পাতাগুলোর উপর পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা শুরু হলো। রিমার মনে একটা ক্ষীণ আশা, হয়তো এই পাতাগুলোই তাদের খুনীর কাছে নিয়ে যাবে, সেই অন্ধকার গলিপথটি উন্মোচিত করবে যেখানে খুনী লুকিয়ে আছে।
কয়েক ঘণ্টা পর, ফরেনসিক ল্যাব থেকে ফোন এল। “ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত, আমরা সেই পাতাগুলো নিয়ে কিছু অস্বাভাবিক তথ্য পেয়েছি,” ডক্টর ভট্টাচার্য, সিনিয়র ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, বললেন, তার কণ্ঠে এক ধরণের চাপা উত্তেজনা। “এগুলো কোনো সাধারণ উদ্ভিদ নয়। এগুলো এক ধরণের ক্যাকটাসের শুকনো পাতা, যা পশ্চিমবঙ্গে খুব একটা দেখা যায় না। মূলত মরুভূমি বা শুষ্ক অঞ্চলে এর জন্ম। তবে কলকাতার আশেপাশে দু-একটি নার্সারিতে এই ক্যাকটাসের প্রজাতি আমদানি করা হয়েছে, মূলত গবেষণার উদ্দেশ্যে।”
রিমার হৃদস্পন্দন দ্রুত হলো। “নার্সারি? কোন নার্সারি? এর আর কোনো তথ্য?”
“আমরা সে তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, পাতাগুলো থেকে এক ধরণের রাসায়নিকের অবশেষ পাওয়া গেছে, যা ক্যাকটাস থেকে নির্গত হওয়ার কথা নয়। মনে হচ্ছে, পাতাগুলো কোনো কৃত্রিম, রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় শুকানো হয়েছে, যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলোকে বিকৃত করেছে।”
রিমার মনে হলো, সে যেন এক বিশাল ধাঁধার একটা অংশ খুঁজে পেয়েছে। খুনী শুধু হত্যাই করেনি, সে যেন এক ধরণের বিকৃত শিল্প সৃষ্টি করছিল, যেখানে প্রতিটি উপাদানই ছিল তার অন্ধকার মনের অংশ, এক হিমশীতল, বিকৃত নিবেদন।
প্রতিটি নতুন তথ্য রিমার মনে গভীর ছাপ ফেলছিল, যা তার আত্মাকে বিদ্ধ করছিল। ব্যক্তিগত জীবনের চাপ, আর এই নৃশংস কেসগুলোর মধ্যে একটা অদৃশ্য, অভিশপ্ত যোগসূত্র সে অনুভব করতে শুরু করেছিল। রাতে তার ঘুম আসত না। যখনই চোখ বন্ধ করত, সায়নী, অনামিকা আর রুমা সেনের বীভৎস মুখগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠত, তাদের নিথর শরীর আর শূন্য দৃষ্টি যেন তাকে নীরব প্রশ্ন করত, “কেন? কেন এমন হলো?” রিমা নিজেকে বলত, “আমি তোকে ধরব। তোকে শাস্তি দেব। তোকে থামাব।”
রিমার অতীতের এক বেদনাদায়ক স্মৃতি তাকে তাড়া করছিল: তার নিজের জীবনেও এক সময় সে এক ধরণের ‘অসহায়ত্বের’ শিকার হয়েছিল, যদিও তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। সেই স্মৃতি এখন এই ভুক্তভোগীদের সাথে মিলেমিশে তাকে আরও বেশি সংকল্পবদ্ধ করে তুলছিল, যেন এই কেসটি তার নিজের ভেতরের ক্ষত সারাতে এক ধরণের ব্যক্তিগত মুক্তি। তার রাগ, হতাশা, এবং এক ধরণের গোপন, চাপা প্রতিশোধের আগুন যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপকে আরও নির্ভীক করে তুলছিল, তাকে এক অদৃশ্য শক্তি দিচ্ছিল। অভ্রজিৎ লক্ষ্য করেছিল রিমার এই পরিবর্তন। তার ম্যাডাম যেন আরও বেশি একা, আরও বেশি আক্রোশী হয়ে উঠছেন, তার চোখদু’টো যেন কেবল খুনীর রক্তের নেশায় লাল হয়ে আছে। কিন্তু অভ্রজিৎ জানত, এই কেসটা রিমার জন্য শুধু একটা চাকরির অংশ নয়, এটা তার ব্যক্তিগত যুদ্ধ, যা তাকে অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যেতে পারে।
ডক্টর ভট্টাচার্যের তথ্যের ভিত্তিতে রিমা এবং অভ্রজিৎ কলকাতার কয়েকটি বিশেষ নার্সারিতে অনুসন্ধান শুরু করল। এই ধরণের বিরল ক্যাকটাসের খোঁজ করা সহজ ছিল না, যেন খুনী তাদের জন্য এক জটিল পথের নকশা তৈরি করে রেখেছিল। তৃতীয় নার্সারিতে গিয়ে তারা একটা সূত্র পেল। নার্সারির মালিক, একজন বয়স্ক লোক, প্রথমদিকে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, যেন কোনো কিছু গোপন করছে। অবশেষে সে বলল, “হ্যাঁ, এমন ক্যাকটাস কিছুদিন আগে এক ভদ্রলোক আমাদের কাছ থেকে কিনেছিলেন। দেখতে বেশ অদ্ভুত, তাই আমার মনে আছে। উনি বলতেন, উনি নাকি উদ্ভিদবিদ, গবেষণা করছেন।”
“ভদ্রলোক কেমন দেখতে ছিলেন? কোনো ঠিকানা দিয়েছিলেন?” রিমা দ্রুত প্রশ্ন করল, তার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছিল।
“উনি বলেছিলেন যে তিনি একজন উদ্ভিদবিদ, গবেষণা করছেন। ঠিকানা দিয়েছিলেন, তবে একটু দূরের। তবে উনি মাঝে মাঝে এখানে আসতেন। দেখতে বেশ শান্ত স্বভাবের ছিলেন, কিন্তু তার চোখগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ছিল। কেমন যেন ঠান্ডা, নিষ্পাপ অথচ গভীরে কিছু লুকিয়ে আছে এমন,” মালিক বলল, তার মুখে এক ধরণের অজানা ভয়।
মালিকের দেওয়া ঠিকানাটি ছিল শহরের এক কোণায়, একটি পুরনো, নির্জন বাড়ির। চারপাশে আগাছার জঙ্গল, আর ভাঙা দেয়াল। ঠিকানাটি নিয়ে তারা যখন ফিরে এল, তখন রিমার মন এক অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠল। এটা কি সত্যিই খুনীর ঠিকানা, নাকি আরও একটি প্রতারণা, একটি ফাঁদ? সে অনুভব করছিল, তারা খুনীর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, কিন্তু এই নৈকট্যই ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক। খুনী যেকোনো মুহূর্তে তার শিকারকে পরিবর্তন করতে পারে, অথবা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, অথবা তাদের দিকেই ফিরে আসতে পারে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল, প্রতিটি কাঁটার শব্দ যেন তাদের শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছিল।
নার্সারির সূত্র পাওয়া গেলেও পুলিশের উপর চাপ কমেনি। সংবাদমাধ্যমগুলো প্রতিদিন নতুন নতুন খবর পরিবেশন করছিল, সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্ষোভ বাড়ছিল, যেন একটি টাইম বোমা ক্রমশ ticking করছে। ডিআইজি রিমার উপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করলেন, “রিমা, দ্রুত কিছু একটা প্রমাণ চাই। এই লিডটা কি সত্যি? নিশ্চিত হও। এরপর যদি ভুল হয়, তাহলে কিন্তু তোমার ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। আমরা আর কোনো ভুল সহ্য করতে পারব না।”
রিমার সহকর্মীরাও তাদের সন্দেহের তীর ঘুরিয়েছিল, তাদের চোখ যেন প্রশ্ন করছিল, “একজন নারী কি পারবে এই কঠিন দায়িত্ব সামলাতে?” এই ধরণের একটি হাই-প্রোফাইল কেসে একজন নারী অফিসারের সাফল্য তাদের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল, এবং তারা যেন রিমার সামান্যতম ভুল ধরার জন্য অপেক্ষা করছিল। রিমা জানত, তাকে প্রমাণ করতে হবে যে সে এই কেসটা একা সামলাতে সক্ষম। তাকে দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। নার্সারির দেওয়া ঠিকানাটি নিয়ে তারা যখন প্ল্যান করছিল, রিমার মনে হচ্ছিল, খুনী তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক অস্থির প্রতীক্ষা, এক অদৃশ্য খেলা শুরু হয়ে গেছে। তারা জানে, তারা এক অদৃশ্য, ঠান্ডা মাথার শত্রুর মুখোমুখি, যে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে, এবং হয়তো তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করছে, একটি ফাঁদ পেতে। পরের পদক্ষেপটা খুব সতর্কতার সাথে নিতে হবে, প্রতিটি নিঃশ্বাস গুনে গুনে।
চলবে…….
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion