Episode 102516 words0 views

নিথর পদচিহ্ন : পর্ব ১০

নিথর পদচিহ্ন (Frozen Footprints) পর্ব ১০: শেষ শিকার মায়ের ভাঙা আয়নার প্রতীক। রিমার মস্তিষ্ক তখন যেন বিদ্যুৎ গতিতে কাজ করছিল, প্রতিটি স্নায়ু চূড়ান্ত সতর্কতায় ঝলসে উঠছিল, যেন তার মাথার ভেতরের সমস্ত তারগুলো হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এক ভয়ংকর সত্য উন্মোচনের অপেক্ষায়, যা তাকে মৃত্যুর দুয়ারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তার রক্ত হিম করে দিচ্ছিল প্রতিটি মুহূর্তে। সে তার শৈশবের প্রতিটি ছবি, প্রতিটি স্মৃতি ঘেঁটে দেখতে শুরু করল, তার চোখের সামনে মায়ের উষ্ণ মুখটি ভেসে উঠল, যেন মায়ের আত্মা তাকে সতর্ক করছিল এক আসন্ন বিপদের বিষয়ে, এক অশুভ ছায়া তার পরিবারকে গ্রাস করতে চাইছে। মায়ের সেই ভাঙা আয়নাটি, যা তার ছোটবেলায় অসাবধানতাবশত ভেঙে গিয়েছিল এবং তার মা সেটিকে পরম মমতায় নতুন একটি নকশা তৈরি করে সাজিয়ে রেখেছিলেন, সেই নকশাটি ছিল তার বাড়িতে, তার মায়ের শয়নকক্ষের দেওয়ালে – একটি ব্যক্তিগত আশ্রয়, যেখানে কেবল তাদের একান্ত স্মৃতিগুলোই সংরক্ষিত ছিল, এক অভেদ্য দুর্গ যা এখন ভেঙে পড়ছে, খুনীর হাতের ছোবলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এটি ছিল তাদের পারিবারিক স্মৃতি, এক ধরণের গোপন প্রতীক, যা তাদের বন্ধনের প্রতীক ছিল। রিমার মনে হলো, নীল রায় তার মায়ের সম্পর্কেও জানে, তার সবচেয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি সম্পর্কেও সে জানে, যা রিমার মনকে এক হিমশীতল আতঙ্কে ডুবিয়ে দিল, তার আত্মার গভীরে এক অস্বস্তিকর শূন্যতা তৈরি করল, যেন তার ব্যক্তিগত জগৎ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, আর সে উন্মুক্ত এক শিকার, যার প্রতিটি শ্বাস খুনীর হাতের মুঠোয়। খুনী শুধু তার পরিচিতদের টার্গেট করছে না, সে যেন রিমার আত্মাকে, তার অতীতকে আঘাত করতে চাইছে, তাকে ভেতর থেকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে চাইছে, তাকে নিজেরই ব্যক্তিগত স্মৃতির মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে, যেখানে প্রতিটি স্মৃতি এক নতুন কাঁটা হয়ে বিঁধছে, তার আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এই প্রতীক কি তার নিজের বাড়ির দিকে নির্দেশ করছে? তার মায়ের কক্ষ? রিমার বুকটা কেঁপে উঠল, এক অপ্রত্যাশিত ভয়ে তার শরীর শীতল হয়ে গেল, যেন বরফ তার শিরায় দৌড়াচ্ছিল, তার হৃদপিণ্ড জমে যাচ্ছিল। খুনী কি তাকে তার নিজের বাড়িতেই ফাঁদ পেতেছে? তার এই দুর্বলতম স্থানে, যেখানে সে নিজেকে সবচেয়ে নিরাপদ মনে করত? তার মনে হলো, নীল রায় যেন তার প্রতিটি চাল আগে থেকেই জানত, প্রতিটি দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল, যেন সে রিমার মনের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল, তার প্রতিটি চিন্তা সে পড়তে পারছিল, প্রতিটি ভয় তার কানে ফিসফিস করছিল, তাকে উন্মাদনার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। এই ধারণা রিমার মনে এক ধরণের ভয়ংকর সংকল্প তৈরি করল। যদি নীল রায় তার বাড়িতে থাকে, তবে এই খেলা সে নিজেই শেষ করবে, তাকে নিজের হাতে শাস্তি দেবে, এই বিভীষিকার চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটাবে, যা তার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে – হয় মুক্তি, নয় ধ্বংস, আর এই ধ্বংসের পথ হবে চূড়ান্ত রক্তমাখা। রিমা এক মুহূর্তও দেরি করল না। তার সমস্ত ক্লান্তি, তার সমস্ত ব্যক্তিগত যন্ত্রণা যেন এক অদম্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল, এক বন্য, আদিম ক্রোধ যা তাকে সামনে ঠেলে দিচ্ছিল, তার চোখে জ্বলছিল এক দাহ্য আগুন। অভ্রজিৎকে সে সংক্ষেপে পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিল, তার কণ্ঠে এক ধরণের চাপা উত্তেজনা, যা কাঁপছিল। “অভ্রজিৎ, আমার বাড়িতে যাও। এখনই। খুনী হয়তো সেখানেই আছে। এটা আমার মায়ের আয়নার প্রতীক।” অভ্রজিৎ দ্বিধা করল, তার চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ আর ভয়। “ম্যাডাম, আমরা ফোর্স নিয়ে যাব। একা যাওয়াটা বিপজ্জনক। এটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু হবে না! আপনি নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে যাচ্ছেন!” রিমার চোখে এক ধরণের কঠিন দৃঢ়তা, যা অভ্রজিৎ আগে কখনো দেখেনি, এক ভয়ংকর সংকল্পের আগুন জ্বলছিল তার চোখে, যা তাকে অন্ধ করে দিচ্ছিল সব বিপদ থেকে, তাকে এক অপ্রতিরোধ্য দানবে পরিণত করছিল। “না। এটা আমার ব্যক্তিগত যুদ্ধ। নীল রায় আমাকেই চাইছে। আমি একা যাব। আমার আত্মসম্মানের প্রশ্ন এটা। আমি তাকে নিজের হাতে শেষ করব, অথবা সে আমাকে শেষ করবে, আমার দেহের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে এই গল্প শেষ হবে।” অভ্রজিৎ রিমার চোখে সেই জেদটা দেখতে পেল, যা তার ম্যাডামকে এতগুলো কঠিন কেসে জিততে সাহায্য করেছে। সে জানত, রিমাকে থামানো যাবে না। সে শুধু বলল, “আমিও আসছি, ম্যাডাম। দূর থেকে কভার দেব। আপনার চোখের আড়ালে থাকব, কিন্তু কাছাকাছিই। আপনি একা নন। মৃত্যুর মুখোমুখি আমরা একসাথে হব।” রিমা শুধু মাথা নাড়ল। সে একা যাবে, কিন্তু অভ্রজিৎ তার পেছনে থাকবে, এই নীরব সমর্থন তার প্রয়োজন ছিল, একমাত্র এই সমর্থনই তাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিচ্ছিল, এক অদৃশ্য জীবনদায়ী শক্তি, এক দুর্বল সুতোয় বাঁধা আশা। রিমার প্রতিটি পদক্ষেপে তার মনে হচ্ছিল, সে যেন এক অদৃশ্য ফাঁদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক অজানা গহ্বরে পতনের মতো, এক অতল শূন্যতার দিকে, যার শেষ কোথায় কেউ জানে না। তার নিজের বাড়ি, তার নিরাপদ আশ্রয়, এখন যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, মৃত্যুর মঞ্চে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে নীল রায় তার জন্য অপেক্ষা করছে তার শেষ অভিনয় মঞ্চস্থ করার জন্য, আর সেই মঞ্চে রক্ত ছিটকে পড়বে। রাতের অন্ধকার তখন আরও গভীর হয়ে উঠেছে, কালো ছায়াগুলো যেন চারপাশে নৃত্য করছিল, যেন তারা রিমার আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছিল, এক অশুভ উৎসবে, মৃত্যুর এক ভয়ংকর নৃত্য, যেখানে রিমাই ছিল প্রধান শিল্পী। তার মনে হলো, নীল রায় হয়তো তার জন্য অপেক্ষা করছে, তার পতন দেখার অপেক্ষায়, তার শেষ শ্বাস নেওয়ার অপেক্ষায়, এক নিষ্ঠুর দর্শক হিসেবে, যে তার যন্ত্রণায় আনন্দ খুঁজে পায়, তার প্রতিটি আর্তনাদ তার কানে সুর হয়ে বাজায়। রিমার বাড়িটি ছিল শহরের এক পুরনো, নির্জন এলাকায়, যেখানে গাছপালা আর ঝোপঝাড় এতটাই ঘন যে দিনের আলোও প্রবেশ করতে পারতো না, যেন প্রকৃতি নিজেই এই বাড়ির অশুভতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সূর্যও যেন তার আলো দিতে অস্বীকার করছিল। ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলা ছিল, যা এক অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছিল, যেন ভেতরে কোনো মৃত আত্মা তাদের আসার অপেক্ষায় ছিল, তাদের স্বাগত জানাতেই দরজা খোলা রাখা হয়েছিল, এক অন্ধকার আমন্ত্রণ। রিমা সাবধানে ভেতরে প্রবেশ করল, তার হাতের রিভলভারটি শক্ত করে ধরা, প্রতিটি পেশী প্রস্তুত ছিল যেকোনো হামলার জন্য, প্রতিটি স্নায়ু যেন তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল। ফ্ল্যাটের ভেতরে এক ঠান্ডা নিস্তব্ধতা, যা তার শ্বাসরোধ করে দিচ্ছিল, বাতাসের প্রতিটি কণায় যেন এক অদেখা ভয়ের কম্পন ছিল, এক পচনশীল, মিষ্টি গন্ধ তার নাকে এসে বিঁধল, যা মৃতদেহের দুর্গন্ধের সাথে মিশে গিয়েছিল। সবকিছু এলোমেলো, ভাঙা, যেন একটি ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে, আর প্রতিটি ভাঙা টুকরো যেন এক অস্ফুট আর্তনাদ করছিল, তাদের চোখের সামনে এক বীভৎস দৃশ্য উন্মোচিত হচ্ছিল, যা তাদের আত্মাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। আর লিভিং রুমের মাঝখানে, একটি চেয়ারে বসেছিল নীল রায়। তার মুখে এক ধরণের অদ্ভুত, প্রায় বিকারগ্রস্ত হাসি, যা তার মুখমণ্ডলকে আরও বেশি বিকৃত করে তুলেছিল, যেন এক দানবের হাসি, হাতে একটি ক্যাকটাসের শুকনো পাতা, যা সে আঙ্গুলের ডগায় ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল, আর তার চোখ দুটো যেন রিমার দিকেই তাকিয়ে ছিল, এক উন্মাদ আনন্দ নিয়ে, যেন রিমার প্রতিটি প্রতিক্রিয়া সে উপভোগ করছিল, প্রতিটি দুর্বলতা তাকে উত্তেজিত করে তুলছিল, তাকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলছিল। তার পাশেই তৃষার নিথর দেহ পড়েছিল, যা এক বিকৃত শিল্পকর্মের মতো সাজানো, তার পোশাকগুলো অদ্ভুতভাবে বিন্যস্ত, তার হাত-পা যেন কোনো এক অশুভ পুতুলের মতো বেঁকে ছিল, তার ত্বকে স্পষ্ট বীভৎস ক্ষত, যা নীল রায়ের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দিচ্ছিল, তার শরীর যেন এক নীরব আর্তনাদ করছিল। তার চোখে এক শেষ আর্তনাদ, যা রিমার কানে বাজছিল এক নীরব চিৎকারের মতো, এক অদেখা যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি, যা তার আত্মাকে বিদ্ধ করছিল।“আপনি এসেছেন, ইন্সপেক্টর,” নীল রায়ের কণ্ঠস্বর ছিল ঠান্ডা, শান্ত, কিন্তু তার প্রতিটি শব্দে এক ধরণের বিজয় আর বিদ্রূপ মিশে ছিল, যেন সে তার শ্রেষ্ঠ নাটক মঞ্চস্থ করছিল, আর রিমা ছিল তার প্রধান দর্শক, যার প্রতিটি মুহূর্ত সে উপভোগ করছিল। “আমি জানতাম আপনি আসবেন। আমার শিল্পকর্মের শ্রেষ্ঠ সমালোচক, এবং আমার শেষ শিকার।” রিমার হৃদপিণ্ডটা যেন বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠল, তার প্রতিটি ধমনী রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছিল, তার মস্তিষ্কে রক্তচাপ বাড়ছিল, তার চোখ লাল হয়ে উঠেছিল ক্রোধে। “তৃষার কী দোষ ছিল? কেন করলি এসব? কেন তুই এত বীভৎস?” তার গলায় ক্রোধ আর ঘৃণা মিশে ছিল, প্রতিটি শব্দে যেন আগুন জ্বলছিল, তার আত্মাকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল, তাকে এক অপ্রতিরোধ্য ক্রোধে উন্মাদ করে তুলছিল। নীল রায় হাসল, সেই হাসিটা রিমার কানের ভেতর পিশাচের হাসির মতো বাজল, তার মস্তিষ্কের গভীরে ঢুকে যাচ্ছিল এক অশুভ সুরের মতো, তাকে উন্মাদ করে দিচ্ছিল, তার শেষ যুক্তির বাঁধ ভেঙে দিচ্ছিল। “দোষ? তাদের কোনো দোষ ছিল না। তারা কেবল আমার শিল্পের উপাদান ছিল। আমার সৃষ্টিকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল, তাদের রক্ত আমার শিল্পকর্মের রং ছিল, তাদের আত্মা ছিল আমার ক্যানভাস। আর তৃষা… তৃষা ছিল আপনার দুর্বলতা। আপনি তার মেন্টর ছিলেন, তাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু আমি তাকে আরও বেশি ভালোবাসি, কারণ তাকে আমি আপনার থেকে কেড়ে নিয়েছি, তাকে আমার নিজের শিল্পকর্মে পরিণত করেছি, আপনার চোখের সামনে আপনারই সবচেয়ে প্রিয়জনকে আমি আমার মাস্টারপিসে পরিণত করেছি, যা আপনার চিরকালের জন্য এক অমলিন স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকবে, এক জীবন্ত অভিশাপ।” নীল রায় তার অতীতের কথা বলতে শুরু করল, তার চোখ জ্বলজ্বল করছিল এক ধরণের বিকৃত আনন্দ নিয়ে, যেন সে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো বর্ণনা করছিল, তার প্রতিটি শব্দে এক ধরণের মাদকতা ছিল। তার শৈশবের ট্রমা, মায়ের প্রত্যাখ্যান, নারীদের প্রতি তার গভীর বিদ্বেষ – যে বিদ্বেষ তাকে ধীরে ধীরে এক দানবে পরিণত করেছে, এক নির্দয় হত্যাকারীতে, যার মনে কোনো অনুশোচনা ছিল না। ড. অনিকেত রায় কিভাবে তার চিকিৎসা করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা তাকে আরও বেশি উন্মাদ করে তুলেছিল, তাকে বিকৃত পথে ঠেলে দিয়েছিল, যেন তার মামার চিকিৎসাই ছিল তার ধ্বংসের কারণ, এক নিয়তি যা এড়ানো যায় না, এক অভিশপ্ত চক্র। নীল রায় জানাল, তার মামা অনিকেত রায় নারীদের মানসিক বিকারগ্রস্ততার উপর গবেষণা করতেন, আর তার গবেষণা থেকেই নীল রায় ‘ক্যাকটাস’কে তার শিল্পের অংশ বানিয়েছিল। সে ঐন্দ্রিলার মাধ্যমে রিমার সম্পর্কে জেনেছিল, এবং রিমার অতীত, তার মায়ের সেই ভাঙা আয়না – সবকিছু সে খুঁটিয়ে দেখেছে, যেন সে রিমার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছে, তার আত্মার প্রতিটি দুর্বলতা সে জানত, এমনকি তার ঘুমন্ত স্বপ্নগুলোও সে দেখত। তার উদ্দেশ্য ছিল রিমাকে ভেঙে দেওয়া, তাকে নিজেরই ব্যর্থতার সামনে দাঁড় করানো, তাকে নিজেরই আত্মাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া, তাকে এক জীবন্ত নরকে পরিণত করা, যেখানে সে কেবল নিজেরই যন্ত্রণায় পুড়বে।নীল রায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, তার হাতে একটি তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরি, যা রাতের আলোয় ঝলসে উঠল, যেন মৃত্যুর প্রতীক, রিমার চোখের সামনে এক বিভীষিকাময় আলো ছড়াচ্ছিল, তার আত্মাকে বিদ্ধ করছিল। তার চোখ দুটো উন্মাদনায় ভরা, তার মুখে এক ধরণের ভয়ংকর হাসি। “আপনার জন্য অপেক্ষা করছে আমার শেষ শিল্পকর্ম, ইন্সপেক্টর। আপনিও হবেন আমার সৃষ্টির অংশ, আপনার আত্মাকে আমি আমার নতুন ক্যানভাসে আঁকব, যা হবে আপনার চিরকালের জন্য অভিশাপ, এক অমর বিভীষিকা।” রিমা তার রিভলভার বের করল, তার হাত কাঁপছিল না, কিন্তু তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছিল, তার প্রতিটি পেশী শক্ত হয়ে গিয়েছিল, তার শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা যেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। “থাম! কাছে আসবি না! আর এক পা বাড়ালে গুলি চালাব! আমি তোমাকে ছাড়ব না! তুমি এই খেলার শেষ দেখে যাবে!”কিন্তু নীল রায় যেন এক উন্মাদ, সে রিমার দিকেই তেড়ে এল, তার চোখ দুটোতে এক ধরণের বন্য দৃষ্টি, যেন সে এক ক্ষুধার্ত পশু, এক উন্মত্ত জানোয়ার, যা রিমার মাংসের গন্ধ পাচ্ছিল। রিমার মনে হলো, এইবার সে নিজেরই জীবনের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। নীল রায় শুধু একটি ছুরি হাতে নিয়ে আসেনি, সে যেন তার সমস্ত বিকৃত উন্মাদনা নিয়ে রিমার দিকে ধেয়ে আসছিল, এক ক্ষুধার্ত পিশাচের মতো, যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল রিমার জীবন, তার আত্মা ছিনিয়ে নেওয়া, তাকে নিজেরই অন্ধকারের গভীরে টেনে নেওয়া। রিমার মন তাকে আদেশ দিচ্ছিল, গুলি চালাও! কিন্তু তার হাত কাঁপছিল। তার সামনে শুধু একজন অপরাধী নয়, তার সামনে তার নিজেরই অতীত, তার নিজেরই ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি, যা তাকে মানসিক পক্ষাঘাতে ফেলে দিচ্ছিল, তাকে নিজেরই শক্তিকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছিল, তাকে নিজেরই মনকে বিশ্বাস করতে বাধা দিচ্ছিল। এক তীব্র ধস্তাধস্তি শুরু হলো। নীল রায়ের প্রতিটি আঘাত ছিল প্রচণ্ড, দানবীয় শক্তি নিয়ে সে রিমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রিমার সব শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করছিল, তার পুলিশ ট্রেনিং তাকে সাহায্য করছিল, কিন্তু নীল রায় যেন এক দানবীয় শক্তি নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার হাতের পেশীগুলো লোহার মতো শক্ত, তার প্রতিটি আঘাত যেন মৃত্যুর বার্তা দিচ্ছিল, রিমার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল, তাকে অসহায় করে তুলছিল। রিমার অতীতের ট্রমা, তৃষাকে হারানোর ব্যথা – সবকিছু মিলেমিশে তাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছিল, তার মন এবং শরীর উভয়ই যেন ভেঙে যাচ্ছিল, তাকে এক নিথর প্রাণহীন বস্তুতে পরিণত করছিল, এক জীবন্ত লাশে। নীল রায় তাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিল। তার চোখগুলো ছিল উন্মাদনায় ভরা। সে রিমার গলার উপর হাত রাখল, তার শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছিল, রিমার ফুসফুস যেন বাতাসের জন্য ছটফট করছিল, তার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছিল, মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ তার আত্মাকে গ্রাস করছিল, তাকে এক অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।যখন রিমা তার শেষ শ্বাস নিতে চাইছিল, তার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছিল, তার চেতনা বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে চাইছিল, তখনই তার চোখের সামনে তার মায়ের সেই ভাঙা আয়নার ছবি ভেসে উঠল। সেই আয়না, যা তাকে শিখিয়েছিল, ভাঙা হলেও সৌন্দর্য থাকে, আশা থাকে, এবং সবচেয়ে অন্ধকারেও একটি আলোর রেখা থাকে, যা তাকে পথ দেখায়, তাকে বেঁচে থাকার কারণ যোগায়। রিমার মনে এক নতুন শক্তি জন্ম নিল, এক অদম্য শিখা তার ভেতরে জ্বলছিল, যা তার সমস্ত ভয়কে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল, তাকে এক নতুন জীবন দিল, এক নতুন উদ্দেশ্য। সে চিৎকার করে উঠল, “না! আমি মরব না! আমি হারব না! তুমি আমাকে শেষ করতে পারবে না! আমার আত্মা আমারই!” তার ভেতরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে, সে নীল রায়ের হাত সরিয়ে দিল, এক অপ্রত্যাশিত আঘাতে নীল রায় কিছুটা হতবাক হয়ে গেল, তার মুখ থেকে এক অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল, তার বিকৃত হাসিটা যেন থেমে গেল। এই মুহূর্তটিই ছিল রিমার শেষ সুযোগ। সে তার পকেট থেকে তার ছুরি বের করল, যা সে গোপনে লুকিয়ে রেখেছিল, যেন এই ছুরিটি তার শেষ আশ্রয় ছিল, তার বেঁচে থাকার একমাত্র প্রতীক, তার প্রতিশোধের অস্ত্র। রিমার হাত কাঁপছিল না। তার চোখে ছিল এক ধরণের দৃঢ়তা, এক ধরণের ক্রোধ, যা তার নিজেরই ছিল না, যেন তার ভেতরে এক নতুন সত্তার জন্ম হয়েছে, এক বিচারকের সত্তা। সে সেই ছুরিটি সরাসরি নীল রায়ের বুকে বিঁধিয়ে দিল, এক নিষ্ঠুর, কিন্তু প্রয়োজনীয় আঘাতে, যা তার সমস্ত যন্ত্রণার শেষ ঘটিয়ে দিল, এই ভয়ংকর খেলার সমাপ্তি টানল।নীল রায়ের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল, তার মুখে সেই বিকৃত হাসিটা যেন থেমে গেল, এক ধরণের অবিশ্বাসে ভরা দৃষ্টি নিয়ে সে রিমার দিকে তাকাল, তার চোখ থেকে যেন জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছিল, তার সমস্ত অন্ধকার শক্তি যেন তার দেহ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। তার মুখ থেকে এক অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল, যেন তার শেষ আর্তনাদ, এক নীরব অভিশাপ, যা বাতাসে মিশে গেল। সে তার বুকে হাত দিয়ে রিমার দিকে তাকাল, তার চোখে তখনও এক ধরণের উন্মাদনা, এক ধরণের প্রশ্ন। তারপর সে ধীরে ধীরে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ল, তার বিকৃত হাসিটা তার মুখে যেন থমকে গেল, এক জীবন্ত মুখোশ হয়ে গেল, যা আর কখনো পরিবর্তন হবে না, মৃত্যুর শীতলতা তাকে গ্রাস করল, তার আত্মা হয়তো নরকের দিকে যাত্রা করল। অভ্রজিৎ ছুটে ঘরে প্রবেশ করল, তার হাতে রিভলভার। সে নীল রায়কে মৃত দেখে রিমার দিকে তাকাল, তার চোখে বিস্ময় আর এক ধরণের আতঙ্ক, যেন সে তার ম্যাডামকে চিনতে পারছিল না, তার চোখে এক নতুন, ভয়ংকর রূপ দেখছিল। রিমা দাঁড়িয়ে ছিল, তার শরীর কাঁপছে, কিন্তু তার চোখে সেই ভয়ংকর উন্মাদনার ছাপটা এখন নেই, আছে এক ধরণের শীতল শান্তি, এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা, যা তাকে অন্য জগতের মানুষে পরিণত করেছে। তার হাতে ছুরি, রক্ত লেগে আছে, কিন্তু সেই রক্ত যেন তার নিজেরই মুক্তির প্রতীক ছিল, এক নতুন জীবনের স্বাক্ষর, তার বিজয়ের চিহ্ন। তার চোখগুলো ছিল শূন্য, কিন্তু তার মনে এক ধরণের শান্তি, এক অদ্ভুত নীরবতা, যেন সে এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছে, যেখানে কেবল তার নিজস্ব নিয়ম চলবে। নীল রায় মারা গেছে। তার বীভৎস খেলা শেষ হয়েছে। তৃষা, সায়নী, অনামিকা, রুমা সেন – সবাই শান্তি পাবে। কিন্তু রিমার ভেতরের ক্ষতগুলো রয়ে গেল, যা তাকে চিরকালের জন্য তাড়া করবে, তার জীবনের অংশ হয়ে থাকবে, এক নীরব স্মৃতিচিহ্ন হয়ে। সে নীল রায়কে শেষ করেছে, কিন্তু নীল রায়ের সেই অন্ধকার অংশটা হয়তো তার নিজেরই ভেতরে রয়ে গেল, তাকে নিজেরই আত্মার গভীরে এক নতুন যুদ্ধ শুরু করতে হবে, যা চিরকাল চলবে, এক অন্তহীন সংগ্রাম। সে জানত, এই কেসটা তাকে চিরকালের জন্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। সে খুনীকে ধরেছে, কিন্তু সে নিজেও যেন এক নতুন, অন্ধকার পথে যাত্রা শুরু করেছে, এক এমন পথে যেখানে তাকে নিজেরই ছায়ার সাথে লড়াই করতে হবে, আর সেই ছায়া হয়তো নীল রায়েরই প্রতিচ্ছবি, তার নিজেরই আত্মার অন্ধকার দিক। তার মনের ভেতরে এক ধরণের শূন্যতা, কিন্তু তার চোখে ছিল এক ধরণের দৃঢ়তা – এই খেলা শেষ হয়েছে, কিন্তু তার নিজের জীবনের গল্পটা এখনও শেষ হয়নি, বরং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে হয়তো আরও অন্ধকার অপেক্ষা করছে, এবং রিমা প্রস্তুত সেই অন্ধকারকে মোকাবিলা করার জন্য, একা। ~সমাপ্ত~

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion