নিথর পদচিহ্ন (Frozen Footprints)
পর্ব ৯: ভাঙন ও নতুন সূত্র
চিরকুটটা হাতে নিয়ে রিমার শরীরটা যেন জমাট বরফের মতো হয়ে গেল, তার রক্ত যেন শিরায় জমাট বেঁধে যাচ্ছিল, প্রতিটি ধমনীতে বরফ জমাট বাঁধছিল এক অশুভ শীতের মতো, যা তার আত্মাকে মৃত্যুর বার্তা দিচ্ছিল। তৃষা নেই। তার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষদের একজন, তার মেন্টর, যাকে সে বাঁচাতে পারেনি। ব্যর্থতা, ক্রোধ আর এক অসীম শূন্যতা তাকে গ্রাস করল, যেন এক অদৃশ্য হাত তার কণ্ঠনালী চেপে ধরছিল, প্রতিটি নিঃশ্বাস কঠিন করে তুলছিল, বাতাসও যেন তার ফুসফুসে প্রবেশ করতে অস্বীকার করছিল, তাকে জীবন্ত শ্মশানে পরিণত করছিল। তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, চোখগুলো যেন নিজেরই অজান্তে শূন্যে তাকিয়ে ছিল, সেখানে কোনো অভিব্যক্তি ছিল না, শুধু এক তীব্র, দাহ্য যন্ত্রণা, যা তার আত্মাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছিল, প্রতিটি অনুকে ভেঙে ফেলছিল, তাকে অস্তিত্বহীন করে তুলছিল। মনে হচ্ছিল, খুনী কেবল তৃষাকেই নেয়নি, সে যেন রিমার আত্মাটাকেও ছিঁড়ে নিয়ে গেছে, তার অস্তিত্বের প্রতিটি কণা যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, এক অদেখা কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, সেখান থেকে আর কোনোদিনও সে ফিরে আসবে না। তার কান্নার ক্ষমতাটুকুও যেন হারিয়ে গিয়েছিল, শুধুই এক জমাট কান্না তার বুকের ভেতর পাথর হয়ে বসেছিল, যা তাকে প্রতিটি মুহূর্তে দমবন্ধ করে মারছিল, তার আত্মাকে চূর্ণ করে দিচ্ছিল। ফ্ল্যাটের সেই ঠান্ডা বাতাস তার শরীরে যেন এক হিমশীতল কফিন তৈরি করছিল, তাকে জীবন্ত কবর দিচ্ছিল তার নিজেরই ব্যর্থতার সমাধিক্ষেত্রে, যেখানে তার নিজেরই আত্মা সমাধিস্থ হচ্ছিল, এবং সেখান থেকে এক পচনশীল দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল। অভ্রজিৎ তার দিকে এক ধরণের অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল, তার ম্যাডামকে সে এমন অবস্থায় আগে কখনো দেখেনি, যেন তার সামনে এক জীবন্ত ছায়া বসে আছে, একটি ভেঙে যাওয়া মূর্তি, যার দিকে তাকাতেও ভয় করছিল। রিমার প্রতিটি শ্বাস যেন ছিল এক যন্ত্রণার আর্তনাদ, যা তার গলার ভেতর আটকে যাচ্ছিল, এক নিরবচ্ছিন্ন দহন, যা তার প্রতিটি কোষকে জ্বালাতন করছিল, তাকে ভেতর থেকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। ফ্ল্যাটের ভাঙা জিনিসপত্র, এলোমেলো বই, আর সেই রক্তহীন নীরবতা যেন রিমার মনের ভেতরের ভাঙনের প্রতিচ্ছবি ছিল, এক টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া আয়নার মতো, যা তার বিকৃত প্রতিচ্ছবি দেখাচ্ছিল, এক উন্মাদনার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছিল, যা রিমার নিজেরই ছিল।
রিমা যখন ধীর পায়ে ফ্ল্যাটের এক কোণে বসে পড়ল, তার মাথা নিচু, তখন অভ্রজিৎ তার দিকে এগিয়ে গেল। সে রিমার পাশে চুপচাপ বসল, কোনো কথা বলল না। সে জানত, এই মুহূর্তে কোনো সান্ত্বনাই রিমার কানে পৌঁছাবে না, প্রতিটি শব্দই কেবল বিদ্রূপের মতো শোনাবে, তার যন্ত্রণাকে আরও বাড়িয়ে দেবে, তাকে আরও বেশি একা করে দেবে। সে শুধু তার ম্যাডামের পাশে বসেছিল, তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। অভ্রজিৎ অনুভব করতে পারছিল রিমার শরীর কাঁপছে, ঠিক যেন শীতের প্রকোপে নয়, এক অশুভ সত্তার উপস্থিতিতে, এক অদৃশ্য স্পর্শ তার ম্যাডামকে গ্রাস করছিল, তাকে হিম করে দিচ্ছিল। এই নীরবতাই যেন ছিল তাদের যোগাযোগের একমাত্র ভাষা, অভ্রজিতের নীরব সমর্থন রিমার পাশে এক অদৃশ্য শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যদিও সেই শক্তি খুনীর নিথর উপস্থিতির কাছে হয়তো খুবই নগণ্য ছিল, এক অসীম অন্ধকারকে ভেদ করতে পারছিল না, বরং সেই অন্ধকার যেন তাদের দুজনকেই গ্রাস করছিল। সে বুঝতে পারছিল, রিমার এই পতন কেবল একটি ব্যর্থতা নয়, এটা ছিল তার আত্মবিশ্বাসের, তার মানসিক শক্তির চরম পরীক্ষা, এক এমন পরীক্ষা যা তার সত্তাকে চূর্ণ করে দিতে পারে, তাকে চিরকালের জন্য অন্ধকার গহ্বরে নিক্ষেপ করতে পারে, যেখানে কোনো আশার আলো নেই। অভ্রজিৎ শপথ নিল, সে রিমার পাশে থাকবে, যতক্ষণ না খুনীকে ধরা হয়, বা যতক্ষণ না তারা নিজেরাই শিকার হয়ে যায়, খুনীর নতুন শিল্পকর্মের অংশ হয়, আর তাদের রক্ত দিয়ে নতুন এক বীভৎস চিত্র আঁকা হয়।
পরের কয়েকটা দিন রিমার জীবন যেন এক অন্ধকার দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। সে অফিসে যেত, কিন্তু তার মন ছিল অন্য কোথাও, কোন এক অদেখা গহ্বরে ডুবিয়ে রেখেছিল নিজেকে, যেখানে কেবল খুনীর ছায়া তাকে তাড়া করছিল, তার প্রতিটি শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছিল। তার চোখগুলো ছিল শূন্য, প্রতিটি পদক্ষেপে এক ধরণের ক্লান্তি, যেন তার প্রতিটি পেশী ছিঁড়ে যাচ্ছিল যন্ত্রণায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন তার আত্মা বের হয়ে যাচ্ছিল, তাকে এক জীবন্ত লাশে পরিণত করছিল। সহকর্মীরা তাকে দেখলেই ফিসফিস করত, তাদের চোখে ছিল সহানুভূতি আর ভয়, কিন্তু তাদের এই সহানুভূতি যেন রিমার কাছে এক প্রকার বিদ্রূপ মনে হতো, তাদের চোখগুলো যেন তাকে পাগল বলে চিৎকার করছিল, আর তাদের ফিসফিসানি যেন খুনীর কণ্ঠস্বরের মতো শোনাচ্ছিল। ডিআইজি তাকে জোর করে ছুটি নিতে বললেন, তার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বললেন, যেন তার ভাঙন এখন সবার চোখে ধরা পড়ছে, এক খোলা ক্ষত যা পচে গলে যাচ্ছে, এবং যার দুর্গন্ধ পুরো বিভাগে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু রিমা ছুটি নিতে রাজি হলো না। সে জানত, যদি সে একবার থামে, তাহলে আর কখনোই ফিরে আসতে পারবে না, সেই অন্ধকার গহ্বর তাকে চিরতরে গ্রাস করে ফেলবে, সেখান থেকে আর কোনো মুক্তি নেই, কেবল অন্তহীন যন্ত্রণা। খুনীর সেই হাসি, সেই বিদ্রূপাত্মক ফোন কল তার কানের ভেতর অবিরাম বাজত, প্রতিটি শব্দ যেন তার মস্তিষ্কের ভেতরে জীবন্ত হয়ে উঠছিল, তাকে পাগল করে দিচ্ছিল, তার শেষ যুক্তির বাঁধ ভেঙে দিচ্ছিল, তাকে এক উন্মাদনায় ঠেলে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে তার মনে হতো, নীল রায় যেন তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, তাকে উপহাস করছে, তার প্রতিটি দুর্বলতা দেখে হাসছে, তার অসহায়ত্ব উপভোগ করছে, তার পতন দেখে আনন্দ পাচ্ছে, আর তার আত্মাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। সে ঘুমালে তার দুঃস্বপ্নগুলো আরও ভয়ংকর হয়ে উঠত, যেখানে তৃষার নিথর দেহ তাকে তাড়া করত, তার চোখের ভেতর এক ধরণের ভয়ংকর আর্তনাদ, যেন তৃষার আত্মা তার কাছে প্রতিশোধ চাইছিল, তাকে নিজেরই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করছিল, তার প্রতিটি পদক্ষেপকে প্রশ্ন করছিল। রিমার মনে হচ্ছিল, সে ক্রমশ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে, তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, তার নিজের সত্তা যেন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল, এক অদেখা ঘূর্ণিতে আটকে যাচ্ছিল, যেখানে কেবল মৃত্যু তাকে হাতছানি দিচ্ছিল। তার খাবার, ঘুম, বিশ্রাম—সবকিছুই অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল, জীবন যেন এক নিরন্তর যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না, এক জীবন্ত নরক, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত ছিল এক নতুন শাস্তি।
তৃষার ফ্ল্যাট থেকে ফরেনসিক টিম সবকিছু নিয়ে গেলেও, অভ্রজিৎ লক্ষ্য করল রিমার দৃষ্টি বারবার ফ্ল্যাটের একটি ভাঙা ছবির ফ্রেমের দিকে যাচ্ছে, যা দেওয়ালের এক কোণে পড়ে ছিল, যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে সেদিকে টানছিল, এক চুম্বকের মতো তাকে আকর্ষণ করছিল, এক অদেখা হাত তাকে সেদিকে নির্দেশ করছিল। ফ্রেমের কাঁচ ভাঙা, ভেতরের ছবিটিও আধছেঁড়া। রিমা হঠাৎ করে সেই ছবিটা তুলে নিল। ছবিটি ছিল তৃষার আঁকা একটি অসমাপ্ত চিত্রকর্ম। ছবিতে একটি ক্যাকটাস গাছ, তার চারপাশে কিছু অস্পষ্ট মুখ, আর ছবির মাঝখানে একটি নারীর ছায়ামূর্তি, যার চোখে ছিল গভীর ভয়, আর তার মুখে ছিল এক নীরব আর্তনাদ, যা রিমার কানের ভেতর বাজছিল, তার আত্মাকে বিদ্ধ করছিল, তাকে ঘুমোতে দিচ্ছিল না। কিন্তু ছবিটি সম্পূর্ণ ছিল না। ছবির এক কোণে, খুব সূক্ষ্ম হাতে, একটি ছোট, নতুন করে আঁকা প্রতীক ছিল, যা আগে ছিল না। প্রতীকটি ছিল একটি ভাঙা আয়নার মতো, আর তার চারপাশে কিছু ছোট ছোট বিন্দুর মতো চিহ্ন, যা দেখতে যেন রক্তবিন্দুর মতো লাগছিল, শুকিয়ে যাওয়া রক্তকণার মতো, যা এক নতুন মৃত্যুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
রিমার চোখ দুটি হঠাৎ ঝলমল করে উঠল, যেন অন্ধকারে এক ঝলক আলো দেখা গেল, কিন্তু সেই আলো ছিল আরও ভয়ংকর এক সত্যের ইঙ্গিত, এক নতুন অভিশাপের সূত্রপাত, এক অদেখা ফাঁদের প্রথম ধাপ। এই প্রতীক! সে এটা আগে কোথাও দেখেছে, কিন্তু কোথায়? রিমার মনটা দ্রুত কাজ করতে শুরু করল। তার অবসাদগ্রস্ত মস্তিষ্কের গভীরে হঠাৎ এক ঝলক চিন্তা বিদ্যুৎ গতিতে বয়ে গেল, যেন এক অদৃশ্য বিদ্যুতের ঝলক তার মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ুকে জাগিয়ে তুলল, তাকে নতুন করে জীবনের অর্থ দেখাচ্ছিল, যদিও সেই অর্থ ছিল অন্ধকারময়, এক বিভীষিকাময় ভবিষ্যৎ। এটা নীল রায়ের নতুন বার্তা। খুনী তৃষাকে হত্যা করার পর এই চিহ্নটি রেখে গেছে, যেন এটি তার পরবর্তী শিকারের ইঙ্গিত, অথবা আরও ভয়ংকর কিছু, যা কেবল রিমার জন্যই নিবেদিত, এক ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, এক চূড়ান্ত খেলা। এই প্রতীকটি আগের কোনো শিকারের সাথে সংযুক্ত নয়, এটি সরাসরি রিমার সাথে সম্পর্কিত, যেন এটি রিমারই ব্যক্তিগত অভিশাপ, তার অতীতের এক গোপন ক্ষত, যা এখন উন্মোচিত হচ্ছে।
রিমার মনে হলো, এই প্রতীক তার নিজেরই কোনো গোপন দিকের সাথে সম্পর্কিত। সে ভাবতে শুরু করল, এই প্রতীকটি তার জীবনের কোন অংশের সাথে জড়িত? তার শৈশব, তার পুরোনো কোনো স্মৃতি? কোন গভীর ক্ষত এই প্রতীকের সাথে বাঁধা, যা এতদিন চাপা পড়েছিল, এবং এখন নতুন করে দগদগে হয়ে উঠেছে? হঠাৎ তার মনে পড়ল, তার মায়ের একটি পুরনো আয়না ছিল, যা তার শৈশবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। সেই আয়নাটি একবার ভেঙে গিয়েছিল, আর তার মা সেই ভাঙা আয়নার টুকরোগুলো দিয়ে একটি অদ্ভুত নকশা তৈরি করেছিলেন। সেই নকশাটি ছিল এই প্রতীকের প্রায় হুবহু। রিমার শরীর হিম হয়ে গেল, যেন বরফ জমাট বাঁধল তার শিরায়, তার হৃদপিণ্ড যেন জমে যাচ্ছিল, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। নীল রায় তার মায়ের সম্পর্কেও জানে? তার শৈশব সম্পর্কেও জানে? তার সবচেয়ে ব্যক্তিগত এবং গোপন স্মৃতি সম্পর্কেও সে জানে? তার আত্মার গভীরতম কোণ সম্পর্কেও সে জানে? তার প্রতিটি দুর্বলতা সে উন্মোচন করতে পারে? খুনী শুধু তার পরিচিতদের টার্গেট করছে না, সে যেন তার ব্যক্তিগত স্মৃতি, তার আত্মাকেও আঘাত করতে চাইছে, তাকে ভেতর থেকে ধ্বংস করতে চাইছে, তাকে নিজেরই অস্তিত্বের সামনে দাঁড় করাচ্ছে, তাকে নিজেরই অতীতকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছে, তাকে নিজেরই মনকে বিশ্বাস করতে বাধা দিচ্ছে।
রিমার চোখে এক ধরণের নতুন জেদ, এক তীব্র সংকল্প জন্ম নিল, যা তার সমস্ত অবসাদকে ছাপিয়ে গেল, এক নতুন শক্তির সঞ্চার হলো তার ভেতরে, এক অদম্য শিখা তার ভেতরে জ্বলছিল, যা তার আত্মাকে জাগিয়ে তুলছিল। এইবার খেলাটা আর শুধু অপরাধীকে ধরার নয়, এটা তার ব্যক্তিগত যুদ্ধ, তার অস্তিত্বের লড়াই, তার নিজেরই আত্মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা, তার মনের মুক্তি, তার বেঁচে থাকার শেষ কারণ। নীল রায় তাকে নিজেরই জালে জড়াতে চাইছে, তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিতে চাইছে। কিন্তু রিমা হার মানবে না। তার সব অবসাদ যেন মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। তার মন এক নতুন শক্তি খুঁজে পেল, এক দানবীয় শক্তি, যা তাকে যেকোনো কিছুর মুখোমুখি হওয়ার সাহস দিচ্ছিল, এমনকি মৃত্যুরও, এমনকি নিজেরই উন্মাদনার। “নীল রায়, তুমি আমাকে শেষ করতে পারো না। এই খেলা আমি শেষ করব। তোমার এই বিকৃত খেলা আমিই থামাব, আর তুমিই আমার শেষ শিকার হবে, আমার ব্যক্তিগত নরকের শেষ প্রতিচ্ছবি, আমার বিজয়ী সমাপ্তি।”
রিমার মনে হলো, নীল রায় সম্ভবত তার পরবর্তী শিকারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এই নতুন প্রতীক, এই ভাঙা আয়নার ইঙ্গিত – এটি হয়তো তার পরবর্তী শিকারের পরিচিতি অথবা স্থানের ইঙ্গিত। তার মনে এক ধরণের ভয়ংকর উপলব্ধি হলো, খুনী তার খেলার প্যাটার্ন পরিবর্তন করেছে। সে এখন আর শুধু ক্যাকটাস পাতা ব্যবহার করছে না, সে রিমার ব্যক্তিগত স্মৃতি, তার দুর্বলতাগুলোকে ব্যবহার করছে, তার প্রতিটি দুর্বলতা যেন খুনীর হাতে এক নতুন অস্ত্র, যা রিমার আত্মাকে বিদ্ধ করতে পারে, তাকে ভেতর থেকে শেষ করতে পারে। রিমার কাছে সময় খুব কম। তাকে দ্রুত এই প্রতীকের অর্থ উদ্ঘাটন করতে হবে, তার আগেই নীল রায় তার বীভৎস খেলা শেষ করে, এবং এক নতুন বীভৎস শিল্পকর্ম তৈরি করে, যা রিমার মানসিক ভারসাম্যকে চিরতরে নষ্ট করে দেবে, তাকে উন্মাদ করে দেবে। রিমার মনে হলো, তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে, এবং সে এক ভয়ংকর গহ্বরের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে, যেখানে কেবল অন্ধকার আর পাগলামি অপেক্ষা করছে, আর সেখান থেকে আর কোনো মুক্তি নেই, কেবল নীল রায়ের হাসি। এইবার ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। এইবার সে নিজেরই জীবনের শেষ সীমা স্পর্শ করতে চলেছে, এবং এই শেষ সীমা অতিক্রম করলে হয়তো আর কখনোই ফিরে আসতে পারবে না, চিরতরে নীল রায়ের জালে আটকা পড়ে যাবে, তার নিজেরই আত্মার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।
রিমার এই নতুন সংকল্পের পর তার মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করছিল। সে অনুভব করছিল, নীল রায় কেবল তাকে ফোন করেই থেমে নেই, সে হয়তো তখনও তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে, তার অদৃশ্য চোখ যেন তাদের প্রতিটি নড়াচড়া অনুসরণ করছে, প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস সে শুনছে। রিমার অফিস, তার বাড়ি, এমনকি তার প্রতিটি ব্যক্তিগত স্থানও যেন নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। তার মনে হতো, প্রতিটি ছায়া যেন নীল রায়ের উপস্থিতি, প্রতিটি শব্দ যেন তার ফিসফিসানি। অভ্রজিৎও রিমার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। তার ম্যাডাম এখন আরও বেশি সতর্ক, আরও বেশি আক্রোশী। কিন্তু তার চোখে সেই উন্মাদনার ছাপও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। রিমার হাতে থাকা মায়ের ভাঙা আয়নার প্রতীকটি যেন তাকে আরও বেশি করে তাড়া করছিল, যেন আয়নার টুকরোগুলো তার নিজেরই আত্মার টুকরোগুলোকে প্রতিচ্ছবি করছিল, যা নীল রায়ের হাতে বন্দি। রিমার মনে হলো, এই খেলাটা এখন আর কেবল খুনী ধরার খেলা নয়, এটা এক ধরণের অস্তিত্বের লড়াই, যেখানে তার নিজেরই আত্মা বাজি। সে জানে, নীল রায় হয়তো তার পরবর্তী শিকারের পরিকল্পনা করছে, আর সেই শিকার হয়তো রিমারই খুব কাছের কেউ, অথবা স্বয়ং রিমা নিজেই তার পরবর্তী শিকার হতে চলেছে, এক বীভৎস শিল্পকর্মের নতুন উপাদান। এই অজানা আতঙ্ক রিমার স্নায়ুগুলোকে আরও বেশি সংকুচিত করে তুলছিল, তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি মুহূর্তে, কারণ সে জানত, খুনী তাকেই দেখছে, কেবল তাকেই দেখছে, তার পতন দেখার অপেক্ষায়।
চলবে……
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion