Episode 1828 words0 views

প্রথম পর্ব

দমদম বিমানবন্দরের বাইরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে রাত্রির নিস্তব্ধতা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছিল। বৃষ্টির ছাট এসে পড়ছে সুব্রতর মুখে, আর তার কালো কোটের কলার ভিজে ভারী হয়ে উঠেছে। দেখাচ্ছে। সুব্রত, তার চোখে–মুখে গভীর উদ্বেগের ছাপ, একটা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছে। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে, যেন এখনই লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে। গতকাল রাতে তার অফিসের বস, মৃগেনবাবু, খুন হয়েছেন। আর আজ সকালে সে জানতে পেরেছে, খুনের সন্দেহে পুলিশ তাকে খুঁজছে। কিন্তু কেন? কী এমন ঘটেছিল যে সে খুনের দায়ে অভিযুক্ত? সে তো কোনোদিনও এসবের মধ্যে ছিল না। তার শান্ত জীবনে এই ঝড় কীভাবে এলো? তার মনে হাজারটা প্রশ্ন ভিড় করে আসছে, কিন্তু কোনো উত্তর নেই। সুব্রত একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ। সে একটি ছোট আইটি কোম্পানিতে কাজ করে। তার জীবনটা একটা ছকের মধ্যে বাঁধা – সকালে অফিসে যাওয়া, কাজ করা, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা, আর রাতে বই পড়া বা সিনেমা দেখা। তার খুব বেশি বন্ধু নেই, তবে অফিসের কয়েকজন সহকর্মীর সাথে তার ভালো সম্পর্ক। সে শান্ত স্বভাবের এবং সহজে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কিন্তু গত কয়েকদিনে তার জীবনটা যেন সম্পূর্ণ উল্টে গিয়েছে। গতকাল রাতে সে অফিস থেকে একটু দেরিতে ফিরেছিল। অফিসের কাজ কিছুটা বেশি ছিল, আর বস মৃগেনবাবু তাকে কিছু জরুরি ডেটা বিশ্লেষণ করতে বলেছিলেন। কাজটা শেষ করতে তার প্রায় রাত দশটা বেজে যায়। অফিস থেকে বের হওয়ার সময় সে দেখেছিল, মৃগেনবাবু তখনও অফিসে ছিলেন। তারা সামান্য কথা বলেছিল, মূলত অফিসের কাজ নিয়েই। সুব্রত বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে যায়। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সে জানতে পারে, মৃগেনবাবু খুন হয়েছেন। খবরটা শুনে সে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। মৃগেনবাবু একজন শান্ত এবং ভদ্র মানুষ ছিলেন। অফিসে সবার সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। কে তাকে খুন করতে পারে? আর কেনই বা খুন করবে? সুব্রত দ্রুত অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। অফিসে গিয়ে সে জানতে পারে, পুলিশ তাকে খুঁজছে। প্রথমে সে বিষয়টা বুঝতে পারেনি। কিন্তু পরে জানতে পারে, গতকাল রাতে সে শেষ ব্যক্তি ছিল যে মৃগেনবাবুর সাথে কথা বলেছে। আর তাই পুলিশ তাকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে দেখছে। সুব্রত হতবাক হয়ে যায়। এটা কি করে সম্ভব? সে তো খুনের ধারে কাছেও ছিল না। সুব্রত বুঝতে পারে, তাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলে সে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে না। তাই সে ঠিক করে, পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার আগে সে নিজেই আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করবে। তার মনে একটা জেদ চেপে যায়। সে প্রমাণ করবে যে সে দোষী নয়। অনেকক্ষণ পর একটা পুরোনো আম্বাসেডর ট্যাক্সি এসে থামে তার সামনে। ট্যাক্সির ইঞ্জিনটা বিশ্রী শব্দ করছে, যেন বহু বছর ধরে চলছে তো চলছেই। চালকের আসনে মাঝবয়সী এক লোক, মুখটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না, শুধু একটা অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে যেন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখছে সুব্রত। লোকটার চোখে একটা অদ্ভুত चमक, যা সুব্রতকে আরও inquiet করে তোলে। ট্যাক্সির ভেতরের আলোটা খুব কম, আর সিটগুলো কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে। একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে আসে, যা সুব্রতকে আরও অস্বস্তিকর করে তোলে। “কোথায় যাবেন?” চালক জিজ্ঞেস করে, তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয় যেন বহু দূর থেকে আসছে। কণ্ঠস্বরটা কর্কশ এবং ক্লান্ত, যেন অনেক দিন ধরে কথা বলেনি। “গড়িয়া,” সুব্রত সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, তার গলাটা শুকনো আর ক্লান্ত। সে এই মুহূর্তে বেশি কথা বলতে চাইছে না। তার মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ট্যাক্সিটি দ্রুতগতিতে শহরের দিকে ছুটে চলে। রাতের অন্ধকারে রাস্তাটা যেন একটা লম্বা সাপের মতো এঁকেবেঁকে হারিয়ে গেছে। রাস্তায় অল্প আলো, চারপাশটা কেমন যেন রহস্যে ঘেরা। সুব্রতর মনে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মৃগেনবাবুর শেষ মুহূর্তগুলো কেমন ছিল? কে তাকে এমন নৃশংসভাবে মারল? আর কেনই বা পুলিশ তাকে সন্দেহ করছে? কোনো উত্তর খুঁজে পায় না সে। তার মনে হয়, সে যেন একটা গোলকধাঁধাঁয় আটকে পড়েছে, যেখান থেকে বেরোনোর কোনো পথ নেই। গাড়িটি যখন গড়িয়া পৌঁছায়, তখন প্রায় মধ্যরাত। চারপাশটা শুনশান, শুধু ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক শোনা যাচ্ছে। সুব্রত একটা পুরোনো বাড়ির সামনে নামে। বাড়িটি নির্জন, চারদিকে কেমন যেন একটা গা ছমছমে নীরবতা। পুরনো আমলের বড় বড় গাছপালা অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এটাই তার পৈতৃক ভিটে। বহু বছর আগে সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, আর আজ আবার ফিরে আসতে হলো। নিয়তির পরিহাস বড়ই নিষ্ঠুর। বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে সুব্রতর মনে পুরোনো দিনের অনেক কথা মনে পড়ে যায়। এই বাড়িতেই তার ছোটবেলা কেটেছে। তার বাবা–মায়ের সাথে অনেক সুখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাড়িটার সাথে। কিন্তু একই সাথে এখানে তার জীবনের কিছু দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে। এই বাড়িটা যেন তার জীবনের সুখ–দুঃখের এক জটিল সাক্ষী। বাড়ির ভেতরে ঢুকে সুব্রত দেখে, সবকিছু যেন আগের মতোই আছে। পুরোনো আসবাবপত্র, ধুলো জমা মেঝে, আর দেয়ালে তার ছোটবেলার ছবি। ছবিগুলোতে তার বাবা–মায়ের হাসিমাখা মুখগুলো দেখে তার চোখে জল এসে যায়। স্মৃতিগুলো ভিড় করে আসে তার মনে। তার বাবা ছিলেন একজন সৎ ও আদর্শবাদী মানুষ। তিনি সবসময় সত্যের পথে চলতেন এবং কাউকে কোনোদিনও ঠকাতেন না। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। মাও খুব তাড়াতাড়ি মারা যান। সুব্রত একা হয়ে যায়। এই বাড়িটা তার কাছে সুখ–দুঃখের এক জটিল সাক্ষী। সে রাতে সুব্রত ঘুমোতে পারে না। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে সে তার জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবতে থাকে। মৃগেনবাবুর কথা তার বারবার মনে হতে থাকে। লোকটা খারাপ ছিলেন না, তবে অফিসের কিছু কাজ নিয়ে তাদের মধ্যে কয়েকদিন ধরে কথা কাটাকাটি চলছিল। তাই বলে খুন? এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না সুব্রত। তার মনে হয়, কেউ যেন তার পরিচিত জগতের খোলনলচে বদলে দিয়েছে। তার শান্ত জীবনে এই ঝড় কীভাবে এলো, সে ভেবে পায় না।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion